জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।
একাত্তরের ডিসেম্বরে পরাধীনতার শিকল পরে থাকা বাঙালি জাতি যেন ঘুম ভেঙে উঠে বুঝতে শুরু করে, স্বাধীনতার অসীম আনন্দের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে এসে হাজির হয় রাষ্ট্র নির্মাণের বিরাট দায়িত্ব। এই নির্মাণও নানামুখী—অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক। সম্পদ ও অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতার কারণে রাষ্ট্র নির্মাণের এই কঠিন প্রক্রিয়া বাঙালি জাতির জন্য হয়ে উঠেছিল কঠিনতর।
অন্য সব নিত্যপ্রয়োজনীয় খাতে (কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো, শিল্প-বাণিজ্য) অগ্রাধিকার দেওয়ার ফলে নবীন বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের দিকে যতখানি নজর দেওয়া দরকার ছিল, ততখানি দেওয়া যায়নি। কিন্তু মানুষ শুধু ভাত-কাপড়ে বাঁচে না, সমৃদ্ধ জীবনের জন্য তার চাই বুদ্ধির চর্চা, চিন্তার উৎকর্ষ। শুধু জাতীয় উৎপাদন আর মাথাপিছু আয় কোনো জাতির সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে না। সত্যিকারের স্বাবলম্বী, মর্যাদাবান জাতির দরকার হয় সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়ন।
বাংলাদেশের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক উন্নয়ন নিয়ে এ রকম চিন্তা যাঁরা করছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা কলেজের শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। শিক্ষক হিসেবে তো বটেই, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, লেখক-সম্পাদক আর সুবক্তা হিসেবেও তাঁকে চিনত দেশের মানুষ। এসব পরিচয়ে নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিতে পারতেন একটি জীবন। কিন্তু নবীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিকাশের স্বপ্ন দেখলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আমরা ঘুমিয়ে যে স্বপ্ন দেখি, তা ছোট স্বপ্ন।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ দেখেছিলেন বড় স্বপ্ন। মানুষের ঘুম হারাম করে দেয় এসব স্বপ্ন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকেও এক অনিশ্চিত পথে নেমে পড়তে হলো। চাল-ডাল-আটা-আলুর জোগাড় ফেলে আলোকিত মানুষের সন্ধানে নেমে পড়লেন তিনি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ জানতেন, এই সন্ধানের জন্য চাই সংগঠন। এমন একটি সংগঠন, যার লক্ষ্য হবে জাতির মানসিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ। আর এই চাহিদা থেকেই জন্ম নিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
১৯৭৮ সালের ১৭ ডিসেম্বরে শুরু হয় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের যাত্রা। স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স তখন মোটে সাত বছর। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে একটি পাঠচক্রে অংশ নিয়েছিলেন মাত্র ১৫ জন মানুষ। তাঁরা প্রতি সপ্তাহে একটি করে বই পড়তেন, বই নিয়ে আলোচনা করতেন। ছোট এই পাঠচক্র থেকে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের সার্থক যাত্রা শুরু হতে পারে না, এমন সন্দেহ সে সময়ে অনেক মানুষের মনেই ছিল। কিন্তু তাঁরা জানতেন না, ছোট একটা বীজ থেকেই জন্মাতে পারে বিশাল গাছ। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের যাত্রায় সঙ্গী হলেন আরও অনেক আশাবাদী মানুষ, ক্রমেই প্রসারিত হতে থাকল কেন্দ্র, বাড়তে লাগল কাজের পরিধি। ইন্দিরা রোড থেকে ১৭ ময়মনসিংহ রোডে এল কেন্দ্র। এখানেই এক টুকরা সবুজ মাঠের পেছনে জড়ো হতে লাগলেন দেশের বহু চিন্তাশীল, উদ্যমী মানুষ।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কাজের গুরুত্ব কী, খালি চোখে তা দেখা কিংবা চট করে বোঝা মুশকিল। ৪৫ বছর ব্যক্তির জীবনে বড় দীর্ঘ সময়, জাতির সাংস্কৃতিক বিকাশের পক্ষে খুবই অল্প। সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের প্রক্রিয়ার বড় অংশটাই ধীর, গভীর, পরোক্ষ।
শুরু থেকেই কিশোর-তরুণদের নিয়ে কাজ করেছে কেন্দ্র। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ জানতেন, জাতির ভবিষ্যৎ নেতাদের সাংস্কৃতিক বিকাশ নিশ্চিত করতে পারলেই পুরো জাতির সাংস্কৃতিক বিকাশ নিশ্চিত করা যায়। আর সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য খুব কার্যকর একটি উপায় হচ্ছে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা।
সে কারণে ১৯৮৪ সাল থেকেই স্কুল–কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য দেশভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রম চালিয়েছে কেন্দ্র, যার আওতায় ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের বছরে ১৬ থেকে ২৫টি বাছাই বই পড়ানো হয়েছে। বহু প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে এই কার্যক্রম। ‘আউট’ বই পড়লে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা নষ্ট হবে, বইগুলো শিশু-কিশোরদের উপযোগী নয়—এ রকম নানা অজুহাতে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই কার্যক্রমে অংশ নিতে চায়নি। কিন্তু ক্রমেই এই উদ্যোগের সার্থকতা সম্পর্কে শিক্ষক ও অভিভাবকেরা নিশ্চিত হয়েছেন। ২০২৩ সালে ২ হাজার ১০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় আড়াই লাখ ছেলেমেয়ে এই কার্যক্রমের আওতায় বই পড়ছে।
এই কার্যক্রমের সাফল্য বাংলাদেশ সরকারকেও উৎসাহিত করেছে। ২০১০ সাল থেকে ‘পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি’র আওতায় কেন্দ্রের সঙ্গে মিলে ১২ হাজারের বেশি স্কুলে ৮৩ লাখ ছেলেমেয়ের বই পড়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার। শুধু ছাত্রদেরই নয়, ২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর ১২ হাজার প্রশিক্ষণার্থী প্রাথমিক শিক্ষককেও ১২টি করে বই পড়াচ্ছে কেন্দ্র। আলোকিত শিক্ষকেরাই যে শিশুদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা দিতে পারেন, নিজের শিক্ষকজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তা জানতেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
কম খরচে বই পড়ার শ্রেষ্ঠ জায়গা লাইব্রেরি। কিন্তু দেশে গ্রন্থাগারের সংখ্যা কম। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের যে গ্রন্থাগার, সেখানে দুই লাখ বই আছে, প্রায় ১০ হাজার পাঠক এর সদস্য। কিন্তু সব মানুষ তো আর কেন্দ্রে আসতে পারবে না। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ঠিক করেছিলেন, পাঠক গ্রন্থাগারের কাছে না আসতে পারলে গ্রন্থাগারই যাবে পাঠকের কাছে। শুভ সংস্কৃতির চর্চায় সেটাই নিয়ম—শুঁড়ি মদ বিক্রি করে নিজের দোকানে বসে, কিন্তু গোয়ালা দুধ নিয়ে যায় বাড়ি বাড়ি। ১৯৯৯ সালে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি–ব্যবস্থার প্রচলন করে শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই বিস্ময় জাগিয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি (মানে বইভর্তি লরি) এখন তিন শ উপজেলার তিন হাজার জায়গায় সপ্তাহে অন্তত একবার এক-দুই ঘণ্টা বই দেওয়া-নেওয়া করে। এই ব্যবস্থা বহু মানুষ, বিশেষ করে গৃহিণী ও বয়সীদেরও পাঠক করেছে।
বই প্রকাশেও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের সেরা বইগুলো প্রকাশ করছে তারা। এ বছরেই ‘বাঙালির চিন্তা কর্মসূচি’র আওতায় ১৬টি বিষয়ে ২০০ খণ্ডে ৭৪ হাজার পৃষ্ঠায় জাতির শ্রেষ্ঠ মনীষীদের মৌলিক চিন্তার এক সংকলন প্রকাশ করে কেন্দ্র জাতির ঐতিহ্য সংরক্ষণের একটি কঠিন এবং প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন করেছে।
শুধু বই–ই না, সংস্কৃতির অন্য উপাদানগুলোর বিকাশেও কাজ করে চলেছে কেন্দ্র। বিশ্বসাহিত্য ভবনে নিয়মিত অনুষ্ঠান আয়োজনের সুযোগ পায় বহু সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠন। কেন্দ্র নিজেও নানাবিধ বিষয়ে বক্তৃতা, আলোচনা বা সংগীতের অনুষ্ঠান আয়োজন করে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বিশ্বাস করেন, উদার দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ গড়ে তুলতে হলে তাকে সংস্কৃতির সব শাখা, বিশেষ করে সংগীত, সাহিত্য, চিত্রকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চলচ্চিত্র, ইতিহাস, ধর্ম, বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজবিদ্যা, অর্থনীতি, রাজনীতি, মনস্তত্ত্ব, শিক্ষা, পরিবেশ ইত্যাদিতে বিচরণ করার সুযোগ দিতে হবে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সফলতার একটি বড় কারণ, সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশের বিবর্তনের তুমুল গতির সঙ্গে এটি পাল্লা দিতে পেরেছে। দেশের অর্থনৈতিক পরিধি, অবকাঠামো, যোগাযোগের সুযোগ যত বেড়েছে, কেন্দ্রও তার কার্যক্রমের পরিধি ও সক্ষমতা তত বাড়িয়েছে। অন্য বহু প্রতিষ্ঠানের মতো ছোট গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে সন্তুষ্ট থাকেনি।
তাতে সংগঠনের ঘরোয়া, অপ্রাতিষ্ঠানিক ভাবটি হয়তো হারিয়ে গেছে, সবুজ জমিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ৯ তলা ভবন, কিন্তু শেষ বিচারে আগের চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যক মানুষের জীবনে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে, আরও বহু মানুষকে আলোকযাত্রায় শামিল করতে পেরেছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ছোট লড়াইয়ে আপস করেছেন, কিন্তু বড় যুদ্ধে হার মানেননি।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কাজের গুরুত্ব কী, খালি চোখে তা দেখা কিংবা চট করে বোঝা মুশকিল। ৪৫ বছর ব্যক্তির জীবনে বড় দীর্ঘ সময়, জাতির সাংস্কৃতিক বিকাশের পক্ষে খুবই অল্প। সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের প্রক্রিয়ার বড় অংশটাই ধীর, গভীর, পরোক্ষ। সে কারণেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের যাত্রার পথ সহজ হয়নি।
নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং তাঁর সহযাত্রীরা কেন্দ্রের খরচ চালানোর জন্য বহু প্রতিষ্ঠানের কাছে সাহায্য চাইতে বাধ্য হয়েছেন, অল্প কিছু দূরদর্শী প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিরা সাহায্য করতে রাজি হয়নি। যে জ্ঞানচর্চায় সনদ নেই, রোজগার বাড়ানোর নিশ্চয়তা নেই, সেই জ্ঞানচর্চা নিতান্ত অকাজের—এমন কথাও অনেকে বলেছেন। এরপরও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিকাশ ও উৎকর্ষে যে ভূমিকা রেখেছে, তা আজ দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা ও সমাদর পেয়েছে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আলোর স্পর্শে অনুপ্রাণিত, উজ্জীবিত মানুষ অদূর ভবিষ্যতে যখন বেশি সংখ্যায় দেশকে নেতৃত্ব দেবেন, তখন এই আলোকযাত্রা স্বাধীন বাংলাদেশের ১০০ বছরের অগ্রযাত্রার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠবে—এ আশা আমরা করতেই পারি। সেই সঙ্গে স্বপ্নদর্শী আবদুল্লাহ আবু সায়ীদও থেকে যাবেন বাংলাদেশের স্মৃতিতে—দেশের সাংস্কৃতিক বিকাশ ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষে তাঁর নিরলস অবদান এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের জন্য। তাঁর এই কথা তো এখন আমরা বাংলাদেশের প্রায় সবাই বিশ্বাস করি, ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।’
খন্দকার স্বনন শাহরিয়ার: লেখক ও গবেষক; ব্যবস্থাপনা পরিচালক, কিমেকার্স কনসাল্টিং লিমিটেড