বাংলার মুখ

সূক্ষ্ম নকশার বড় ওস্তাদ

জামদানি কারিগর জামাল হোসেন
ছবি: দিনার মাহমুদ

তিন ভাইয়ের মধ্যে বাবার কাছে জামদানির কাজ শিখেছিলেন শুধু মাহমদ আলী। দারিদ্র্যের জাঁতাকলে পড়ে সেই পেশা বেছে নেওয়ার জন্য পরে অনুতপ্তও হয়েছিলেন মাহমদ। পেশা বদলে পাটকলে চাকরি নিয়েছিলেন। তখনই ঠিক করেছিলেন, তাঁর ছেলে জামাল হোসেনের জীবন জামদানির সুতায় জড়াবেন না। পড়াশোনা করে ছেলে বড় চাকরি করবে। 

কিন্তু পড়ায় জামাল হোসেনের মন বসত না। ক্লাস পালিয়ে ছুট দিতেন খেলার মাঠে। বেয়াড়া ছেলেকে শাস্তি দিতেই জামদানির কারিগর ভাইয়ের কাছে পাঠিয়েছিলেন জামালের মা হুলচেহারুন। মায়ের দেওয়া শাস্তিই যেন জামালের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। সূক্ষ্ম নকশার জামদানি বুনে দেশ–বিদেশে নাম হয়েছে। জয় করেছেন দারিদ্র্য, পেয়েছেন দেশসেরা কারুশিল্পীর পুরস্কার। সূক্ষ্ম নকশার জামদানি কারিগরদের কাছে জামাল এখন বড় ওস্তাদ। 

জামালের বাড়িতে একদিন

জামাল হোসেনের বয়স ৩৮। বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সাদিপুর বরগাঁও। গ্রামের অনেকেই বংশপরম্পরায় জামদানি তাঁতি। হেমন্তের এক রোদমাখা দুপুরে গিয়েছিলাম বরগাঁও। জামাল হোসেনের বাড়িতে পা রাখতেই চোখে পড়ল ‘পাখি জামদানি উইভিং ফ্যাক্টরি’ লেখা সাইনবোর্ড। ভেতরে সারি সারি তাঁতে বোনা হচ্ছে জামদানি। দেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের কারিগরদের দক্ষ হাতের নিপুণ বুননে চিকন সুতার জমিনে ফুটে উঠছে বাহারি নকশা। জামাল হোসেনের দেখা সেখানেই পাওয়া গেল। 

কথায় কথায় জানা হলো জামালের ক্লাস–পালানো শৈশব থেকে জামদানির ওস্তাদ হয়ে ওঠার গল্প। মামা ইউনুস আলীর কাছে চার বছর শিখে ২০০০ সালে বাড়ি ফিরে আসেন জামাল। জমানো টাকায় একটি তাঁত চালু করেন। কারখানার নাম দেন পাখি জামদানি। ২০০৬ সাল থেকে ঢাকায় জামদানি বিক্রি শুরু করেন। তখন এক ক্রেতার পরামর্শে কারখানার নাম হয় পাখি জামদানি উইভিং ফ্যাক্টরি। 

শুরুতে জামালের পুঁজি ছিল হাজার পাঁচেক টাকা। ২২ বছরের পথচলায় পাঁচ হাজার থেকে তাঁর ব্যবসার পুঁজি এখন কম করেও দেড় কোটি টাকা। মানভেদে ৫০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হয় জামালের কারখানায় বোনা শাড়ি। তাঁর নিজের হাতে বোনা শাড়ির সর্বোচ্চ দাম পেয়েছেন ছয় লাখ টাকা। মাসে গড়ে ১৫ থেকে ১৬ লাখ টাকার জামদানি বিক্রি করেন। খরচ বাদে মুনাফা থাকে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা।

জামদানিতে প্রসিদ্ধির মাধ্যমে আরও অনেকের জীবনবদলে সহায়ক হয়েছেন জামাল। তাঁর বাড়ির কারখানায় ২৪ জন শ্রমিক কাজ করেন। চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন আরও ২৬ জন। পরোক্ষভাবে অনেকেই এখন তাঁর ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। 

‘এহন আমার কারিগরেরাও ২০০ কাউন্টে বুনতে পারে’: জামাল হোসেন

জামালের নামডাক

সূক্ষ্ম সুতায় মিহি কাজের জন্যই জামালের প্রসিদ্ধি। সাধারণত, ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৮৪ কাউন্টের সুতায় বোনা হয় জামদানি। সুতার কাউন্ট ২৫০-এর ওপরে গেলে তাকে বলে মসলিন। ২০০ কাউন্ট সুতায় জামদানি বোনেন জামাল, সাধারণ জামদানির চেয়ে যা কয়েক গুণ মিহি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য শাড়ি বোনেন জামাল। শাড়ির জন্য এশিয়া ও ইউরোপের ক্রেতারাও তাঁর বাড়িতে আসেন। জামাল জানান, এত সূক্ষ্ম সুতায় কাজের অভিজ্ঞতা শুরুতে তাঁর ছিল না। ২০১৭ সালের দিকে তাঁকে ২০০ কাউন্টের শাড়ি বোনার কাজ দেয় টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির। সে সময় কাজটা তাঁর কাছে রীতিমতো অসম্ভব মনে হয়েছে। নানান প্রশিক্ষণের পর প্রায় এক বছরের চেষ্টায় পরে তিনি ২০০ কাউন্টের একটি শাড়ি বোনেন। ২০১৯ সালে জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘জামদানি উৎসব’–এ শাড়িটি প্রদর্শিত হয়। উৎসবে শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পীর পুরস্কার পান জামাল। 

জামাল বলেন, ‘কাজটা সহজ ছিল না। সূক্ষ্ম শাড়ি বুনতে যাইয়া পুরা এক বছর সময় লাগছে। দিন–রাইত চেষ্টা করি, কিন্তু এত চিকন সুতায় কাজ অয় না। সুতা ছিঁড়া যায়। এমন করতে করতে ছয়–সাতটা শাড়ি নষ্ট হয়। এক বছর অন্য কোনো কাম না হওয়ায় আয়–ইনকামও বন্ধ। তহন নিজের কেনা ১১ শতাংশ জমি বেচতে হইসে। এহন আমার কারিগরেরাও ২০০ কাউন্টে বুনতে পারে।’ 

কেবল দেশেই নন, হস্তশিল্পের জন্য ওয়ার্ল্ড ক্রাফট কাউন্সিল অ্যাওয়ার্ড অব এক্সিলেন্স ২০২১-২২ পেয়েছে জামালের পাখি জামদানি। জামাল স্বপ্ন দেখেন ধীরে ধীরে ঐতিহ্যের মসলিন বুনবেন। নিজের বুননকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যাবেন যেন যে কেউ দেখলেই আলাদা করতে পারে তাঁর বুনন।

লেখক: প্রথমআলোর নারায়ণগঞ্জ সংবাদদাতা