প্রথম আলো ২৫ বছর ধরে অসংখ্য অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছেপেছে। পেয়েছে অগণিত পাঠকের অকুণ্ঠ প্রশংসা। এর অনেক প্রতিবেদন দুর্নীতির স্বরূপ উন্মোচন করেছে। আবার মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে কোনো কোনোটি। এমন একটি প্রতিবেদনের চুম্বক অংশ তুলে আনা হলো এখানে।
পলান সরকার। কেউ তাঁকে বলেন বইপ্রেমী, কেউ বলেন বইপাগল। শিশুরা বলে বইদাদু। যে নামেই ডাকা হোক, মানুষটির জন্মই হয়েছিল যেন জ্ঞানের আলো ছড়ানোর জন্য। তিনি বলতেন, ‘সবচেয়ে বড় দান হচ্ছে জ্ঞানদান। তাই আমি পণ করেছি, যেটুকু পারি আমি বড় দানই করে যাব।’ তাই পিছিয়ে পড়া জাতিকে শিক্ষিত করার জন্য নিজের টাকায় বই কিনে মানুষের বাড়ি দিয়ে আসতেন। আবার পড়া বই ফেরত নিয়ে নতুন বই দিয়ে আসতেন।
মানুষটি ১৯২১ সালের ১ আগস্ট নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার নূরপুর মালঞ্চী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেখানেই তিনি মাইনর (চতুর্থ শ্রেণি) পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ পান। শৈশবে বাবা হারান। তারপর আর পড়াশোনা হয়নি। তখন থেকে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামের নানার বাড়িতে বড় হয়েছেন।
পলান সরকারের কেতাবি নাম হারেজ উদ্দিন। অদম্য ইচ্ছা থাকার পরও অভিভাবকহীন এই শিশুর পড়াশোনার সুযোগ হয়নি। নানার গ্রাম বাউসায় মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ার কোনো বিদ্যালয় ছিল না। এই মনঃকষ্ট থেকেই পরবর্তী জীবনে তিনি বাউসা গ্রামে নিজের জমি দিয়ে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও বই পড়া ছাড়েননি তিনি, বরং নিজের টাকায় বই কিনে পাঠকের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতেন। এভাবে পড়ার আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি। সমাজসেবায় এই অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ২০১১ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। পদক নিয়ে পলান সরকার সোজা প্রথম আলোর ঢাকা কার্যালয়ে আসেন। ২০০৭ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁর বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার করে দেওয়া হয়।
২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে প্যারিসভিত্তিক একটি সংগঠন ‘স্পার্ক নিউজ’ ইতিবাচক উদ্যোগের ওপরে লেখা আহ্বান করে। বাংলাদেশ থেকে প্রথম আলো ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ শিরোনামে পলান সরকারের বই পড়ার আন্দোলন নিয়ে লেখা পাঠায়। ২০ সেপ্টেম্বর লেখাটি সারা পৃথিবীর ৪০টি প্রধান দৈনিকে ছাপা হয়। এর মধ্যে ১০টি পত্রিকার প্রধান শিরোনাম হয় আলোর ফেরিওয়ালা।
প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ২০১৪ সালে পলান সরকারকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করা হয়। ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে নিয়ে প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘ছুটির দিনে’ প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয় ‘বিনি পয়সায় বই বিলাই’। তাঁকে নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত এটিই প্রথম প্রতিবেদন। এর আগে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রচারিত হয়।
শেষের দিকে পলান সরকার বই পড়ার আন্দোলনটাকে শুধু তাঁর পাঠাগারকেন্দ্রিক না রেখে একটু অন্যভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বই বিতরণের জন্য এলাকাভিত্তিক পাঁচটি বিকল্প বই বিতরণ কেন্দ্র তৈরি করেন। এ জন্য কোনো বাজারের বইপ্রেমী দোকানিকে তিনি বেছে নেন। দোকানমালিক তাঁর দোকানে মালামালের পাশাপাশি পলান সরকারের বইও রাখেন। সেখান থেকে স্থানীয় লোকজন বই নিয়ে যান। মাসে এক-দুবার করে পলান সরকার দূরবর্তী এই কেন্দ্রগুলোয় ছেলে হায়দার আলীর সঙ্গে মোটরসাইকেলে চেপে গিয়ে নতুন বই দিয়ে পুরোনো বই নিয়ে আসতেন। তবে শেষ বয়সে এ কাজগুলো ছেলেকে দিয়েই বেশি করাতেন। ২০১৯ সালের ১ মার্চ না–ফেরার দেশে চলে যান পলান সরকার। এখন তাঁর পাঠাগার রয়েছে। স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পাঠাগার থেকে বই নিয়ে যায়। পড়া বই আবার ফেরত দিয়ে যায়। পলান সরকার একুশে পদকের সঙ্গে যে অর্থ পেয়েছিলেন, তা ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রেখে দিয়েছেন। সেখান থেকে যে মুনাফা আসে, তা তাঁর পাঠাগারের কল্যাণে ব্যয় করা হয়।
প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৭