সেই রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ছাত্রদের মারা হচ্ছিল। পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হয়ে উঠেছিল। খবরটা শুনে খুব খারাপ লেগেছিল, সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। পরদিন চিন্তা করলাম, কিছু একটা করতে হবে। আমি গানটা পারি। ১৬ জুলাই দুপুরের মধ্যে লিখে ফেললাম ‘কথা ক’। ঘোরের মধ্যে রেকর্ড শেষ করলাম; সেদিন সন্ধ্যা নাগাদ গানটা প্রকাশ করি।
গানটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। যারা আমার গান আগে কখনোই শোনেনি, তাদের কাছেও গানটা পৌঁছেছে। এর কারণ হয়তো সাধারণ মানুষ গানটাতে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে; গানের কথাগুলোকে প্রাসঙ্গিক মনে করেছে।
‘কথা ক’ প্রকাশের পর কেউ কেউ বলেছেন, ‘তোর বিপদ হবে, ঝামেলায় পড়বি। বাংলাদেশে এসব চলে না।’ মাঝখানের সময়ে বিপত্তিতে পড়তেও হয়েছিল। একটি পক্ষ গানটাকে কপিরাইট স্ট্রাইক দিয়ে ‘মিউট’ করে দিয়েছিল। অনেক চেষ্টা করেও সেটিকে আনমিউট করতে পারিনি। ‘মিউট’ থাকা অবস্থায়ও গানটা আট মিলিয়নের মতো মানুষ শুনেছে। এটাকে আন্দোলনের অংশ হিসেবেই নিয়েছে। গান মিউট করে দেওয়াও তো দমনের কাতারেই পড়ে। আসলে এত মানুষ ‘কথা ক’ শুনবে, ভাবতেও পারিনি।
গানে আমি গণমানুষের কথা বলছি, আমাদের ট্যাক্সের টাকায় গুলি আমাদের ওপর চালাবে কেন? তারাও ছাত্র, ছাত্ররা ছাত্রদের ওপর কেন আক্রমণ করে? এই ব্যাপারগুলো কাউকে না কাউকে বলতে হতোই। আমার মনে হয়েছে, ফলে আমিই বলেছি। ওই সময় দেশের অবস্থা খারাপ ছিল। ছোট ভাইবোনেরা মার খাচ্ছে। ওই সময় চিন্তা করেছিলাম, মানুষ হয়তো গানটা শোনার মানসিকতায় নেই। কিন্তু এ গান এত মানুষ শুনেছে, যা অবাক হওয়ার মতো।
আন্দোলনের মধ্যে র্যাপ গান সাধারণ শ্রোতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ‘কথা ক’সহ বেশ কয়েকটি গান সাধারণ শ্রোতাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা গানে পেলে সেটার মধ্যে শ্রোতারা নিজেকে খুঁজে পায়। দেশের সবাই তখন একই রকম সংকটের মধ্যে ছিল। গানে ওটা নিয়ে কথা বলেছি, ফলে সবাই গানের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে। র্যাপ গান বাইরের সংস্কৃতি, সবাই ভালো চোখে দেখে না। অনেকে নাক সিঁটকায়—এগুলো কী বলছে। শ্রোতারা তখন বুঝেছে, এটা শুধু হাসিতামাশা নয়; আমাদের কথাই বলছে। আমরা বিভিন্ন বিষয়ে গান করি, এটা এমন একটা বিষয় ছিল, যেটাকে সারা দেশের মানুষের ভালো লেগেছে।
অনেকে বলে, সেই পরিস্থিতিতে এমন গান করার ঝুঁকিটা কেন নিয়েছিলাম? আমি বরাবরই বলে আসছি, তখন আরও অনেকে ঝুঁকি নিয়েছিল। ফলে গান লেখাটাকে ঝুঁকি মনে করিনি। আমরা সবাই মিলে আন্দোলনে গিয়েছি। গানটা ছাড়ার পরদিন থেকেই আমি একটু এলাকার বাইরে ছিলাম। ‘আওয়াজ উডা’ গানের র্যাপার হান্নানকে গ্রেপ্তারের পর আমার ওপর চাপ আরও বেড়েছে। ওই সময় এলাকা থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল।
আমার বেড়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পাগলা এলাকায়। এখানেই থাকি। গান প্রকাশের পর এলাকার অনেকে রাজনৈতিক স্বার্থ চিন্তা করে আমাদের সঙ্গে পল্টি নিয়েছে। তারা আমাকে ধরিয়ে দিতে চেয়েছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা চেয়েছে, আমার ক্ষতি হবে; ধরে নিয়ে যাবে। শুনছি, আমাকে নাকি মেরে ফেলবে। বাড়িতে পুলিশ এসে খুঁজেছে। এলাকায় খবর নিয়েছে। অনেক ঝামেলা গেছে। গানটা প্রকাশের পর এলাকায় থাকলেও বাসায় ছিলাম না। যখন খবর পেলাম আমাদের খুঁজতেছে, এক পর্যায়ে পরিবারের সদস্যরা বলেছে, তুমি এলাকায় থেকো না।
বাধ্য হয়ে এলাকার বাইরে চলে গেলাম। আমি যেই এলাকায় বড় হয়েছি, সেখান থেকে যেকোনো কারণে চলে যেতে হবে বা দূরে থাকতে হবে, সেটা অনেক কষ্টের। ওই সময় ছোট ভাই র্যাপার হান্নানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আমরা এলাকায় থাকলে কোর্ট–কাছারিতে যেতাম। তবে ওই সময় পরিস্থিতি এমন ছিল, আমরা গেলে আমাদেরও গ্রেপ্তার করত। আমরা কেউ যেতে পারিনি। আমরা জানতাম, আমাদের একটা ক্ষতি হবে। তবে কতটা ক্ষতি হবে, সেটা বুঝিনি।
১৬ জুলাই গান প্রকাশের পরদিন ১৭ জুলাই নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলাম। আন্দোলনে যাওয়ার পরপরই ছবিগুলো ছড়িয়ে যায়। এগুলো নিয়ে অনেক চাপ আসতে থাকে। পুলিশ, ডিবি খোঁজা শুরু করে। একটা পর্যায়ে এলাকাছাড়া হতে হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিনও আমি এলাকাছাড়া ছিলাম। সরকারের পতনের পর দেশের মানুষ শান্তি পেয়েছে। বিপদ থেকে নিস্তার পেয়েছে। মানুষ মন খুলে কথা বলতে পারছে। সেদিনও পাগলা এলাকায় গ্যাঞ্জাম ছিল। ৬ আগস্ট আমি বাসায় ফিরেছি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। নির্বাচনের পর নতুন সরকার আসবে। সামনে যারা ক্ষমতায় আসবে, তাদের প্রতি অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়ার চাওয়া থাকবে। যেকোনো দল এসেও একই রকম কাজ করলে আমরা কেউই চুপ থাকব না। ছাত্র থেকে রিকশাওয়ালা—সবাই আওয়াজ তোলা শিখে গেছে। নিজের দাবিদাওয়া চাইতে শিখে গেছে। সর্বোচ্চ বল খাটায়েও তো আমাদের দমায়ে রাখতে পারেনি। ওই ক্ষেত্রে যে কেউই আসুক, আমাদের ওপর একই অত্যাচার চালালে আমরা রুখে দাঁড়াব। তবে আমরা নিজেদের মধ্যে কলহ, বিবাদ চাই না। দিন শেষে সবাই আমরা বাংলাদেশি।
* সেজান : আন্দোলনের পক্ষে গান গাওয়া র্যাপার