দেশভাগের পর ভারতের গুজরাটের একদল কাপড় ব্যবসায়ী নতুন ব্যবসার সন্ধানে ছুটছিলেন করাচি-ঢাকা। এই দলে ছিলেন গুজরাটের আম্রেলি জেলার দাউদি বোহরা সম্প্রদায়ের আলীভাই খানভাইয়ের পাঁচ সন্তান। ব্যবসার ফাঁকে তাঁদেরই একজন চট্টগ্রামে ঘুরতে আসেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালা প্রথম পা রাখেন চট্টগ্রামে। এখানে এসে লৌহসমৃদ্ধ খাওয়ার পানির স্বাদে মজে যান তিনি। পানির স্বাদে ঢাকা-করাচি নয়, চট্টগ্রামেই ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন দ্রুত। এই সিদ্ধান্ত শুধু চট্টগ্রাম নয়, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রডশিল্পের গোড়াপত্তন করেছিল।
কীভাবে এই রডশিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা জানা যায় আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালার পরিবারের ইতিহাস থেকে। দেশভাগের পর গুজরাটে কাপড়ের ব্যবসা ছেড়ে স্ক্রু ব্যবসায় নেমেছিলেন আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালা। ঢাকা থেকে স্ক্রু কিনে বিমানে করাচি নিয়ে বিক্রি করতেন তিনি। এ ব্যবসায় বেশ লাভ হয়। চট্টগ্রামে যখন তিনি বেড়াতে আসেন, তখন পানির স্বাদ বেশ ভালো লেগে যায় তাঁর। এক বছরের মাথায় স্ক্রু তৈরির কারখানা দিয়ে বসলেন চট্টগ্রামে। জোবেদা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস নামে এই কারখানায় স্ক্রু, কোদালসহ হস্তচালিত লোহার নানা যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি হতো। ১৯৫১ সালে যখন এই কারখানা গড়ে তোলেন সে সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কোনো রড তৈরির কারখানা ছিল না। আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালার বড় ভাই তাহেরালী পরামর্শ দিলেন—রড কারখানা গড়ে তোলার।
গুজরাটি ব্যবসায়ী হিসেবে আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালা সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করলেন না। কারখানা নির্মাণের জন্য কলকাতা থেকে একজন দক্ষ কারিগর আনা হলো। সেখান থেকে আনা কাঠের প্যাটার্ন দিয়ে ঢালাই করে কারখানার যন্ত্রপাতি বানানো হয়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা হলো দক্ষ শ্রমিক। ১৯৫২ সালের শুরুর দিকে চট্টগ্রামের নাছিরাবাদ শিল্প এলাকায় এভাবে সনাতন পদ্ধতিতে রড তৈরির কারখানা গড়ে তোলা হলো। কারখানার নাম দেওয়া হলো ‘ইস্ট বেঙ্গল স্টিলস রি-রোলিং মিলস লিমিটেড।’ স্বাধীনতার পর এই কারখানার নাম পাল্টে রাখা হয় বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস বা বিএসআরএম। প্রথম আলোর সঙ্গে এক দীর্ঘ আলাপচারিতায় এমন তথ্যই জানিয়েছিলেন আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালার সন্তান ও বর্তমানে বিএসআরএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আলীহোসাইন আকবরআলী।
শুরু থেকে নেতৃত্বে যে কারখানা
ইস্ট বেঙ্গল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড চালুর বছরে গুজরাট ফেরত আরেক ব্যবসায়ীর ‘মোহাম্মদী আয়রন অ্যান্ড স্টিল ওয়ার্কস লিমিটেড’ নামে আরও একটি কারখানা চালু হয়েছিল। এই কারখানাটিও পরে কিনে নেয় ইস্ট বেঙ্গল স্টিলস রি-রোলিং মিলস লিমিটেড বা আজকের বিএসআরএম। এ হিসাবে বিএসআরএমের হাত ধরে ৭১ বছর আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ বাংলাদেশে পথচলা শুরু হয় ইস্পাতশিল্পের। ১৯৫২ সালে কারখানা দুটি চালুর আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রড তৈরির কোনো কারখানা ছিল না। আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালাই পথ দেখিয়েছেন রডশিল্পের।
আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালার জন্ম হয়েছিল আফ্রিকার দেশ মাদাগাস্কারে। তাঁর বাবা গুজরাট থেকে ১৯২৯ সালে ব্যবসার জন্য ছুটে গিয়েছিলেন মাদাগাস্কারে। প্রায় এক দশক ছিলেন সেখানে। সেখানেই জন্ম হয় আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালাসহ চার সন্তানের। আবার গুজরাট হয়ে চট্টগ্রামে আসেন আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালা। কাপড় ও স্ক্রু ব্যবসার পর মূলত রডের ব্যবসায় উত্থান ঘটে এই পরিবারের।
রুশ লেখক এস এস বারানভ পূর্ব বাংলা: অর্থনৈতিক উন্নয়নের বৈশিষ্ট্য গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ষাটের দশকের শেষ দিকে সম্প্রদায়ভিত্তিক যে বৃহৎ শিল্পপতি পরিবার ছিল, আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালা পরিবার তাদের অন্যতম। এই বইতে ইস্ট বেঙ্গল রি-রোলিং মিলস, ন্যাশনাল আয়রন অ্যান্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ, মেঘনা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, জুবেদা ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে তাদের অংশীদারি ছিল বলে তুলে ধরা হয়।
ইস্ট বেঙ্গল রি-রোলিং মিলসের পথ অনুসরণ করে শুরুর দিকে নাসিরাবাদেই গড়ে তোলা হয় একের পর এক ইস্পাত কারখানা। ধীরে ধীরে ঢাকা ও খুলনায় রড তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। চট্টগ্রামে নিউ এরা স্টিল মিলস লিমিটেড, মালিক রি-রোলিং মিলস ও জিএম স্টিলস লিমিটেড, ঢাকায় প্রিন্স আয়রন অ্যান্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ, খুলনায় চন্দরপুরে খুলনা ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড ট্রেডিং করপোরেশনের নাম উল্লেখ করার মতো। পাকিস্তান আমলে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা এসব কারখানার সব কটিতেই সাধারণ মানের রড উৎপাদন হতো। চাহিদা ছিল কম। আবার কারখানাগুলোর বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ছিল দুই থেকে সাত হাজার টন। এসব কারখানার অনেকগুলোর অস্তিত্ব নেই এখন। শুধু আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালার ইস্ট বেঙ্গল রি-রোলিং মিলস কারখানাই এগিয়েছে।
বিকাশও চট্টগ্রামে
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার এক দশক পর বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসেন। এ সময় ইস্পাত খাতের কারখানা নির্মাণে লাইসেন্স নেওয়ার প্রথা তুলে দেওয়া হয়। সে সময় সীতাকুণ্ডে জাহাজভাঙাশিল্পের উত্থান ঘটে। জাহাজভাঙায় যুক্ত হন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা। রড তৈরির কাঁচামাল ছিল এই জাহাজভাঙার প্লেট ও লোহার টুকরো।
তবে জাহাজভাঙাশিল্পের কারণে সীতাকুণ্ড ও নাসিরাবাদে ছোট ছোট কারখানা গড়ে তোলেন উদ্যোক্তারা। এসব কারখানায় ৪০ গ্রেডের রড তৈরি হতো। কারখানাগুলো ছিল সনাতন।
আবার ইস্পাতের মধ্যবর্তী কাঁচামাল বিলেট তৈরির কারখানাও ছিল চট্টগ্রামে। ১৯৬৭ সালে চালু হওয়া চিটাগাং স্টিল মিলস কারখানায় ঢেউটিন ও ইস্পাত পাতের পাশাপাশি বিলেটও উৎপাদন হতো। ১৯৯৯ সালে এই সরকারি কারখানাটি বন্ধ হয়ে গেলেও এখানে বেসরকারি খাত এগিয়ে আসে। ১৯৯৬ সালে বিএসআরএম তৎকালীন বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ বিলেট তৈরির কারখানা গড়ে তোলে।
চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকায় ও খুলনা নদীবন্দর ঘিরে ইস্পাত খাতের কারখানা গড়ে উঠেছিল। তবে পণ্যের চাহিদা বাড়ার পর এই দুই এলাকায় চট্টগ্রামের মতো বিকাশ হয়নি। যেমন বিএসআরএম খুলনায়ও সেকশন স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ নামে কারখানা গড়ে তুলেছিল। ১৯৮০-এর দশকে কয়েক বছর চালু ছিল সে কারখানা। তবে গ্যাসের অভাবে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় চালুর তিন বছরের মাথায় বন্ধ করে দেওয়া হয়। চট্টগ্রামের পর বেশ কিছু কারখানা গড়ে উঠেছিল ঢাকায়। ঢাকার কারখানাগুলো চট্টগ্রামের মতো বড় হতে পারেনি।
উদ্যোক্তারা জানান, ইস্পাত খাতের কেন্দ্রবিন্দু চট্টগ্রাম হওয়ার মূল কারণ বন্দর-সুবিধা। ইস্পাতের কাঁচামাল আমদানি করতে দরকার বন্দর-সুবিধা। এই ভারী কাঁচামাল যাতে সহজে কারখানায় নেওয়া যায় সে জন্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেশির ভাগ কারখানা গড়ে তুলেছেন উদ্যোক্তারা। এক দশকে যেসব কারখানা সম্প্রসারণও হয়েছে, তা-ও চট্টগ্রামে।
শুরুর দিকে ইস্পাতশিল্পে ৪০ গ্রেডের রড তৈরি হতো। ১৯৮০-এর দশকে আসে ৬০ গ্রেডের রড। শুরুতে অবশ্য ঢাকার মিরপুরের প্রিন্স আয়রন অ্যান্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ কারখানা প্রথম ৬০ গ্রেডের রড তৈরি করে।
তবে দাম ছিল বেশি। তাতে খুব জনপ্রিয়তা পায়নি। শুরুর মতো এবারও এগিয়ে আসে চট্টগ্রামের বিএসআরএম। ১৯৮৭ সালে গ্রুপটি ৬০ গ্রেডের রড তৈরি করে।
খুব দ্রুত সাড়া পড়ে যায়। কোনো স্থাপনায় ৪০ গ্রেডের তুলনায় এই রডের ব্যবহার অন্তত ৩০ শতাংশ সাশ্রয়ী, এমন প্রচারণায় খুব ভালো বাজার পায় বিএসআরএম।
ইস্পাতশিল্প এখন
ইস্পাতশিল্পে প্রতি দশকে রূপান্তর ঘটছে। বিশ শতকের ছোট-মাঝারি কারখানা থেকে একুশ শতকে বড় কারখানায় রূপান্তরের ইতিহাসও চট্টগ্রামের উদ্যোক্তাদের হাতে লেখা হয়। এ শতকের প্রথম দশকে শুরু হয় কারখানার উৎপাদনক্ষমতা, উৎপাদন প্রযুক্তি ও পণ্যবৈচিত্র্যের প্রতিযোগিতা। বরাবরই এখানেও এগিয়ে আছে চট্টগ্রাম।
বিএসআরএম গ্রুপের পর আবুল খায়ের গ্রুপ ও কেএসআরএম গ্রুপ বড় কারখানা স্থাপন করে। এ শতকের দ্বিতীয় দশকে যুক্ত হয় জিপিএইচ ইস্পাত। এই চার শিল্পগ্রুপের একেকটি কারখানার উৎপাদনক্ষমতা ৮ থেকে ১২ লাখ টন। আনয়ন চুল্লির উৎপাদনের প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আবুল খায়ের গ্রুপ প্রথম ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস প্রযুক্তি নিয়ে আসে। জিপিএইচ নিয়ে আসে উইনলিংক ও কোয়ান্টাম আর্ক ফার্নেসে রড উৎপাদনের প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির বিশেষত্ব হলো পুরোনো লোহার টুকরো গলিয়ে ৮০ মিনিটে সরাসরি রড তৈরি করা যায়।
শুধু উৎপাদনক্ষমতাই বাড়েনি, উচ্চশক্তির রড তৈরির প্রতিযোগিতাও যেন চলছে এক দশকের বেশি সময় ধরে। ২০০৮ সালের ৫০০ গ্রেডের রডের পর সুউচ্চ স্থাপনা, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট, টানেল, ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা, উপকূলীয় এলাকার জন্য লবণাক্ততা ক্ষয়রোধী, এমন সব বিশেষায়িত পণ্য নিয়ে আসেন উদ্যোক্তারা। দেশের বড় বড় প্রকল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে চট্টগ্রামের কারখানায় উৎপাদিত রড। দেশে আন্তর্জাতিক মানের স্থাপনা হলেও বিদেশ থেকে রড আমদানি করতে হচ্ছে না। অর্থাৎ দেশেই এখন আন্তর্জাতিক মানের রড তৈরি হচ্ছে। শুধু রড তৈরি নয়, সীমিত আকারে রপ্তানিও হচ্ছে। চীনে রড তৈরির মধ্যবর্তী কাঁচামাল বিলেট রপ্তানি করেও তাক লাগিয়ে দিয়েছে চট্টগ্রামের কারখানা জিপিএইচ ইস্পাত।
শুরুর মতো ইস্পাতশিল্পের বিকাশ যেমন হয়েছে, তেমনি উৎপাদন অংশীদারিতেও এখনো শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে চট্টগ্রাম। শুধু চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় চারটি কোম্পানি বিএসআরএম, আবুল খায়ের, কেএসআরএম ও জিপিএইচের ইস্পাত পণ্য রড উৎপাদনক্ষমতা এখন ৪৪ লাখ টন। শীর্ষ এই চারটি গ্রুপ ছাড়াও পঞ্চম অবস্থানে থাকা এইচএম স্টিল কারখানার অবস্থানও চট্টগ্রামে। অর্থাৎ ইস্পাত পণ্য রড উৎপাদনেও ৭১ বছর ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছে চট্টগ্রাম।
ইস্পাত খাতের বিশ্লেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. সেলিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ভারী শিল্পের জন্য প্রথমে বন্দর ও নদীপথে পরিবহন-সুবিধা দরকার। কারণ, কাঁচামাল আনা-নেওয়া ও প্রস্তুত পণ্য রপ্তানি বা দেশের নানা জায়গায় নেওয়ার জন্য বন্দর দরকার। চট্টগ্রামে বন্দর থাকায় শুরুতে যেমন এখানে সবচেয়ে বেশি কারখানা গড়ে উঠেছিল, তেমনি বিকাশও হয়েছে চট্টগ্রামে। সামনে মিরসরাই থেকে মাতারবাড়ী উপকূল পর্যন্ত এলাকায় এই ভারী শিল্পের বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে।