জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আমার আলাপ-আলোচনা সেই সত্তর দশক থেকেই। সদ্য স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ, সবার মধ্যে একধরনের তাগাদা ও চিন্তা, কীভাবে দেশকে এগিয়ে নেওয়া যায়। গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর বিশেষ দৃষ্টি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান হিসেবে ইউনূস ভাই গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর অ্যাকশন রিসার্চ শুরু করেছেন। ওই কার্যক্রমের সূত্র ধরেই ক্ষুদ্রঋণের প্রাতিষ্ঠানিক ধারণার উদ্ভব ও সময়ের ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাপী বিস্তার ও স্বীকৃতি। তখন সমাজ পরিবর্তনের ধারণাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ধারণ করে বেশ কিছু প্রাণবন্ত আলোচনা চক্র ক্রিয়াশীল ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে ও পরে পাস করে বিআইডিএসে কাজ করার সময় এ ধরনের অনেক আলোচনার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতারও সুযোগ হয়েছিল। স্যার ফজলে হাসান আবেদ, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী—বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিবর্তনে বেসরকারি খাতের তিন কান্ডারি—অবশ্য আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে অন্য উচ্চতায় উপনীত হয়েছিলেন।
আজকে ক্ষুদ্রঋণের কথা সবাই জানি। এর শুরু কিন্তু ইউনূস ভাইয়ের একটি মৌলিক দর্শন থেকে। কীভাবে কার্যকর পন্থায় তৃণমূলের মানুষকে নিজ ভাগ্য পরিবর্তনের এজেন্টে (নিয়ন্তা) রূপান্তরিত করা যায়, সে জন্য নারীদের ঋণ দেওয়ার আগে তাঁদের দিয়ে পাঁচজনের এক একটা গ্রুপ করেছেন তিনি। ‘ষোলো সিদ্ধান্ত’ নামে একটি বিষয়ও ছিল। এই ষোলো সিদ্ধান্তের একটি ছিল নারীরা একত্র হয়ে প্রথমে শরীরচর্চা করবেন।
ছিল সময়মতো বৈঠক করার বাধ্যবাধকতা। ড. ইউনূস মনে করতেন, নারীদের পরিবর্তনের নিয়ন্তা হতে হলে প্রথমে জড়তার প্রাচীর ভাঙতে হবে। শুরুতে তাঁদের মানসিক, সামাজিক ও শারীরিক জড়তা থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি। নারীরা উন্নয়নের এজেন্ট হওয়ার জন্য একত্র হচ্ছেন। তৎকালীন বাংলাদেশে এটা একটা বৈপ্লবিক ধারণা ছিল। তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক করার পেছনের গল্প কিন্তু এটাই।
ক্ষুদ্রঋণের ধারণা ঐতিহাসিকভাবে আমাদের মধ্যে ছিল। সেটা জাকাতের মাধ্যমে হোক বা প্রতিবেশীর বিপদে সহযোগিতার মাধ্যমে হোক। কিন্তু ড. ইউনূসের বড় সফলতা হলো, ক্ষুদ্রঋণের পুরো বিষয়কে একটি মডেল হিসেবে দাঁড় করানো। কোনো একটি বিষয় মডেল হলে এর বিস্তার হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাঁর একটা লক্ষ্য ছিল এটি চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়া। গ্রামীণ মানুষের জড়তার প্রাচীর ভাঙা ছিল এই মডেলের অংশ। ড. ইউনূস ক্ষুদ্রঋণের কার্যক্রম প্রথমে চট্টগ্রামে করলেন। বিশেষ করে জোবরা গ্রামের কথা প্রায় সবাই জানি। তখন মানুষ মনে করল এক জায়গায় হয়েছে, অন্য এলাকায় হয়তো হবে না। তখন তিনি টাঙ্গাইলে গেলেন। পরবর্তী সময় দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বের বহু দেশে ছড়িয়ে পড়ল এ কার্যক্রম। ক্ষুদ্রঋণ ধারণাকে গ্রহণ করে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান এখন দেশে–বিদেশে দারিদ্র্য বিমোচন ও সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। বৈশ্বিক স্বীকৃতি হিসেবে অধ্যাপক ইউনূস নোবেল পুরস্কারেও ভূষিত হলেন। নোবেল মুখপাত্র তাঁকে মনোনীত করার কারণ তুলে ধরতে গিয়ে বলেন:
নিচ থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে তাঁদের প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে নরওয়েজীয় সমান দুই অংশে ভাগ করে ২০০৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নরওয়েজীয় নোবেল কমিটি। বৃহৎ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে না পেলে স্থায়ী শান্তি অর্জিত হতে পারে না। ক্ষুদ্রঋণ এমনই একটি পন্থা। নিচ থেকে উন্নয়ন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে এগিয়ে নিতেও সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
মুহাম্মদ ইউনূস নিজেকে এমন এক নেতা হিসেবে তুলে ধরেছেন, যিনি শুধু বাংলাদেশই না, বিশ্বের আরও অনেক দেশের কোটি কোটি মানুষের কল্যাণে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম। আর্থিক কোনো জামানত ছাড়া গরিব মানুষকে ঋণ দেওয়াটাকে মনে করা হতো অসম্ভব একটা ভাবনা। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে, তিন দশক আগে যার সামান্য সূচনা হয়েছিল, ড. মুহাম্মদ ইউনূসই প্রথম এবং সর্বাগ্রে ক্ষুদ্রঋণকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রধান হাতিয়ার করে তোলেন। ক্ষুদ্রঋণকে কেন্দ্র করে বিশ্বজুড়ে যে প্রচুর প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, গ্রামীণ ব্যাংক হয়ে উঠেছে তাদের ভাবনা ও মডেলের এক উৎস।
সম্মানজনক একটি জীবনযাপনের সম্ভাবনা ও অধিকার পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষেরই রয়েছে। মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়েছে, বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং সভ্যতার দরিদ্রস্য দরিদ্রও নিজের উন্নয়নে কাজ করতে পারে।
বিশেষ করে নারীদের যেখানে দমনমূলক সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়, এমন সমাজে ক্ষুদ্রঋণ একটি গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিদায়ী শক্তি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। মানবজাতির অর্ধেক নারী সমানতালে পুরুষের সঙ্গে যদি তাল মেলাতে না পারেন, তাহলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক গণতন্ত্র পরিপূর্ণভাবে অর্জিত হবে না।
বিশ্বকে দারিদ্র্যমুক্ত করা ইউনূসের দীর্ঘমেয়াদি স্বপ্ন। শুধু ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে পারে না। কিন্তু মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়েছে যে সেই স্বপ্ন অর্জনের অব্যাহত প্রচেষ্টায় ক্ষুদ্রঋণ অবশ্যই একটি প্রধান ভূমিকা পালন করবে।
অধ্যাপক ইউনূস প্রসঙ্গে ক্ষুদ্রঋণ আলোচনাটাই প্রধান হয়ে উঠলেও তাঁর অবদানের আরেকটি দিকও মনোযোগের দাবি রাখে। দারিদ্র্যের বহুমাত্রিকতাকে বিবেচনার মধ্যে এনে ড. ইউনূস আরও কয়েকটি সেবার দিগন্ত উন্মোচিত করেছিলেন। এখানে মূল চিন্তা ছিল সার্বিকভাবে দারিদ্র্য অবস্থার মোকাবিলার সক্ষমতা কীভাবে বাড়ানো যায়। গ্রামীণ ব্যাংকের গ্রহীতা, তথা গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারের ঘরগুলো খুবই নাজুক ছিল। অল্প প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ঘরবাড়ি ভেঙে যেত। চার কোনায় কংক্রিটের খুঁটি স্থাপনের মাধ্যমে দরিদ্র পরিবারের ঘরগুলোকে মজবুত করার একটি ধারণাগত পরিবর্তন উসকে দিতে ড. ইউনূস অগ্রদূত হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। এসব বিষয় ইতিহাসের পাতায় সেভাবে উঠে আসেনি। যেমন আরেকটি বিষয় ছিল ঋণগ্রহীতা পরিবারের অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে কি না, বোঝার জন্য ১০ সূচকের একটি কাঠামো। এ সূচকের তথ্য দিয়ে বোঝার চেষ্টা ‘গ্র্যাজুয়েশন’ বা ক্রমোন্নতি হচ্ছে কি না। আমি নিজেও দাউদকান্দিতে গ্রামীণ ব্যাংকের অনুরোধে এটি নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলাম।
তৃণমূল পর্যায়ে সৌরপ্রযুক্তির প্রসারেও অধ্যাপক ইউনূসের উন্নয়নদর্শন চিন্তার জট খোলার কাজটি করেছিল। সত্তর ও আশির দশকে গ্রাম মানেই সন্ধ্যার পর অন্ধকার। তখন ধারণাগত যে পরিবর্তন দরকার ছিল, তা হলো, ঘরের মধ্যে ন্যূনতম একটি বাতি কীভাবে জ্বালানো যায়, যাতে ঘরের মানুষেরা আরও কিছু সময় অর্থকরী কাজে ব্যয় করতে পারেন, ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার কাজটা আরও ভালোভাবে করতে পারে। এখানে পল্লি বিদ্যুতায়ন কার্যক্রম যেমন কার্যকর ভূমিকা রেখেছে, সমান্তরালভাবে গ্রামীণ শক্তির মাধ্যমে সোলার হোম সিস্টেমের প্রসারও জট ভাঙার ও দ্রুত বিস্তারের কাজটি করেছে। সব ক্ষেত্রেই ড. ইউনূসের উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখেছে বলা যাবে না। গ্রামীণ চেক, মৎস্য, পুষ্টি দই—চমকপ্রদ এসব উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের ঢেউ তুলতে সক্ষম হয়নি।
বাংলাদেশের পাঁচ দশকের পরিবর্তনে অধ্যাপক ইউনূসের মৌলিক অবদান শুধু ক্ষুদ্রঋণে সীমাবদ্ধ নয়; দারিদ্র্য মোকাবিলা সক্ষমতার বহুমাত্রিক বিকাশের দর্শনও তাঁর মৌলিক অবদানের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এ–ও তাৎপর্যপূর্ণ যে ৮৩ বছর বয়সেও তিনি থেমে নেই। এখন তিনি বৈশ্বিক অর্থনীতির নৈতিক ঘাটতিকে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে আনায় সচেষ্ট রয়েছেন। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথচলার জন্য এটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি চিন্তা–পাথেয়। চেষ্টায় বিরতি দেওয়া যাবে না, কাজ অনেক বাকি, যেতে হবে আরও বহুদূর।
হোসেন জিল্লুর রহমান: নির্বাহী চেয়ারম্যান, পিপিআরসি ও অর্থনীতিবিদ