আধুনিক প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান অংশ হচ্ছে নির্বাচন। নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্বাচন অনুষ্ঠান ছাড়া কোনো রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক বলা যায় না। গবেষকেরা বলেন, যদি গণতান্ত্রিক সরকারকে সর্বোত্তম সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়, তবে এর মূল স্তম্ভই হলো নির্বাচন এবং এই দুইয়ের মধ্যে গভীর সাযুজ্য রয়েছে।
বস্তুত, গণতন্ত্রে সরকারের ক্ষমতা উৎসারিত হয় ভোটারদের প্রদত্ত ম্যান্ডেট থেকে আর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জনগণের হয়ে প্রক্সি দেন। স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা অর্জনের প্রক্রিয়ায় ব্যাপকভিত্তিক জন-অংশগ্রহণের মাধ্যমে, বিশেষত সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর প্রকাশ ও তাদের প্রত্যাশা পূরণের পদ্ধতি উদ্ভাবনসহ যথাযথ প্রয়োগ নির্দেশ করে নির্বাচন। এর ফলে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র বিকাশে ও সংহতকরণে নির্বাচনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান সর্বজনস্বীকৃত।
রাজনৈতিক ব্যবস্থার কার্যকারিতা এবং রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান অঙ্গ, তথা সংসদ, নির্বাহী ও বিচারিক সংস্থাসহ সম্পৃক্ত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মসম্পাদনে নির্বাচনী ব্যবস্থার যোগসূত্র থাকে। সমগ্র জনপ্রশাসনের কর্মতৎপরতা ও সরকারি কর্তৃক নির্ভর করে নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনের ওপর। এভাবে জননীতি প্রণয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, উন্নয়নকর্ম পরিচালন এবং রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক কাজ জনসেবাদানের অনুষঙ্গ হলো গ্রহণযোগ্য জন-আস্থাসম্পন্ন নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখা।
জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক সরকারে অংশ নেয় মুক্তভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে। এভাবে জনগণের জন পরিমণ্ডলে প্রবেশাধিকার থাকে আর সরকারি কর্তৃপক্ষের মূল দায়িত্ব হচ্ছে জন-ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানো। এ ইচ্ছার প্রকাশ ঘটে নিয়মিত বিরতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান ও মুক্ত ভোট প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে।
রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর, শাসক ও শাসিতের মধ্যে নিত্য যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিনিধিত্বের ও শাসনের ক্ষেত্রে শাসিতের সম্মতির নিশ্চয়তার ধারক ও বাহক হলো নির্বাচন।
বিশ্বব্যাপী শাসনপদ্ধতি সূচকে ছয়টি প্রধান দিক বিবেচনায় নেওয়া হয়; মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও জবাবদিহি, সহিংসতামুক্ত স্থিতিশীল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, সরকারের দক্ষতা, তদারকির সক্ষমতা, আইনের সমপ্রয়োগ এবং প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে দুর্নীতি দমন। এই বিষয়গুলোর সঙ্গে গণতান্ত্রিক সুশাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের সুগভীর সম্পর্ক বিদ্যমান।
রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণমূলক আচরণ ও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পূর্বশর্ত হচ্ছে দেশের নির্বাচকমণ্ডলীর সমর্থন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নির্বাচনকে যথাযথভাবে প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া, জনগণের ভোট প্রাপ্তির প্রতিযোগিতা, সরকার পরিবর্তনসহ বিভিন্ন বিশেষণে ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের মত হচ্ছে, নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির আচরণগত ফলাফলই হলো গণতন্ত্রায়ণ।
রাষ্ট্রে শাসনের ক্রিয়াশীলতা ও জাতীয় বিরাজমান বিভিন্নমুখী সমস্যা সমাধানে আনুষ্ঠানিক অঙ্গীকার নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তুলে ধরা হয়। এর প্রকৃত অর্থ দাঁড়ায় যে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোট, পক্ষ ও দলগুলোর মধ্যে চলমান আর্থসামাজিক রাজনৈতিক বিষয়ে মতভেদ থাকলেও রাষ্ট্রীয় মৌল বিষয়াদিতে তারা সহমত প্রদর্শন করে।
গণতান্ত্রিক কাঠামোয় এ ধরনের মতৈক্য নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপরে সংশ্লিষ্ট সবার আস্থা তৈরি করে এবং পরাজিত পক্ষের সম্মতিতে বিজয়ী দল সরকার গঠন করে, যা সমঝোতাপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। প্রকৃতপক্ষে একটি দেশের গণতন্ত্রের মাত্রা নিরূপণ করা যায় সেই দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
নির্বাচনী প্রক্রিয়া হলো শাসকগোষ্ঠী ও জনগণের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, নির্বাহীর স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ন্ত্রণ, দলীয় অঙ্গীকার ও জনদাবি বাস্তবায়ন এবং তদারকি কর্মকাণ্ডে জনসম্পৃক্ততা। এই বিষয়গুলো একটি দেশের নাগরিকদের মানবাধিকার সমুন্নত রাখে।
নির্বাচনে একটি দেশের রাজনৈতিক বিভক্তি, দ্বন্দ্ব, ভিন্নমত এবং গোষ্ঠীস্বার্থের প্রতিফলন থাকলেও জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত কর্তৃপক্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল, অংশীগোষ্ঠী এবং সচেতন মহলের দায়িত্ব রয়েছে ভোটারদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা, নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরা, প্রার্থীদের দক্ষতা সম্পর্কে প্রচারণা এবং সুশাসন ও উন্নয়নের সমস্যা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফল হলো রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যথাক্ষেত্রে দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা ও কায়েমি স্বার্থের বিপরীতে সামগ্রিকভাবে নাগরিকের স্বার্থ রক্ষা করা।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যায়, ঠান্ডা যুদ্ধ শেষে ‘গণতন্ত্রের তৃতীয় তরঙ্গে’ সংশ্লিষ্ট যেসব দেশ বহুদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে, তাদের সংখ্যা গত দেড় দশকে প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব নির্বাচন বহুত্ববাদের পরিচায়ক।
তবে নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অর্জন এবং গৃহীত নীতিমালা বাস্তবায়নে নির্বাচন কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে না। অবাধ এবং সব দলের অংশগ্রহণে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচনী কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষ ও অংশীদারির পারস্পরিক সহযোগিতা বিশেষ জরুরি।
নির্বাচনী কর্তৃপক্ষের মূল দায়িত্বের মধ্যে নির্বাচনের আগে ও পরে নির্বাচনী কর্তৃপক্ষের কিছু সুনির্দিষ্ট ও মূল দায়িত্ব রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে নির্বাচনী রোডম্যাপ তৈরি, বাজেট প্রস্তুত করা, ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা, দলের নিবন্ধন, নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ, আচরণবিধি প্রণয়ন, প্রার্থী বাছাই, তথ্য প্রকাশ, নির্বাচনী কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, নির্বাচনী দ্বন্দ্ব নিরসন, ফলাফল প্রকাশ এবং নিরপেক্ষতা বজায় রেখে স্বচ্ছতার সঙ্গে সমগ্র প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধান করা।
পরস্পর সহযোগিতামূলক এসব কার্যক্রম একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার পরিচায়ক। সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন রাজনৈতিক বৈধতার ভিত্তি তৈরিসহ চলমান যে কোনো সংকট উত্তরণ, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের শান্তিপূর্ণ নিরসন ও অংশগ্রহণের সমস্যা দূর করে। এসব উপাদান কর্তৃত্ববাদের বিপক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণের নির্ণায়ক হয়।
উল্লেখ্য, তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচনসহ রাষ্ট্রের মৌল বিষয়ে সহমতের অভাব দৃশ্যমান হয়। এ ক্ষেত্রে সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে নির্বাচন পরিচালন পদ্ধতিতে মতানৈক্য, দ্বন্দ্বমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপস্থিতি, অংশগ্রহণের অভাব ইত্যাদি। ফলে, এসব রাষ্ট্রে নিয়মিত বিরতিতে নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতা, জন-অনাস্থা, সহিংস পরিবেশ বিদ্যমান থাকে, যা গণতন্ত্রচর্চায় নেতিবাচক বার্তা দেয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তি জনপ্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের বিধিবিধান সমুন্নত রয়েছে। গত দেড় দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৃশ্যমান উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি সংঘটিত হয়েছে, যা দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। তবে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ক্রমবর্ধমান বিভক্তি ও বিবাদ নিঃসন্দেহে হতাশাব্যাঞ্জক।
বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে সাধারণ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীন তিনটি সাধারণ নির্বাচন হলেও একে খণ্ডিত বা সাময়িক রাজনৈতিক সমঝোতা হিসেবে দেখা যেতে পারে।
তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিল ও পুনরায় রাজনৈতিক সরকারের অধীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান রাজনৈতিক মতপার্থক্যের জন্ম এবং নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে সমস্যাসংকুল করে তুলেছে। সর্বস্বীকৃত নির্বাচনব্যবস্থা নির্মাণে আর্থসামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শর্তাবলির অনুপস্থিতি, কাঠামোগত দুর্বলতা ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিচর্চা গণতন্ত্রের সহায়ক শক্তিগুলোর ইতিবাচক ভূমিকা পালনে বাধা দেয়।
বলা বাহুল্য, গণতন্ত্রচর্চায় নির্বাচনী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা প্রধান পূর্বশর্ত। একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই গণতন্ত্রের লক্ষ্য অর্জন হয়েছে ভাবার কোনো কারণ বা অবকাশ নেই। নির্বাচনী গণতন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে কোন প্রক্রিয়ায় দেশের রাজনীতি আবর্তিত হবে এবং এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিচর্চায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসমৃদ্ধ বিধিবিধান অনুসরণে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলো কতখানি আন্তরিক তার ওপর।
এ দেশে সর্বসম্মত নির্বাচনী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও জোটের সহনশীল আচরণ, পারস্পরিক সাংঘর্ষিক সম্পর্ক পরিহার এবং রাজনৈতিক সংলাপ আয়োজনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এ ব্যাপারে কার্যকর তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা রয়েছে, তবে বাইরের কোনো শক্তির চেয়ে দেশের ভেতর থেকেই দায়িত্বশীল বিভিন্ন কাঠামো আর নাগরিক সমাজ ও অংশীজনদের এগিয়ে আসা উচিত।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আস্থা তৈরি উদ্যোগের কথা শোনা যায়। এর প্রায়োগিক দিকগুলো এ দেশের দলগুলোর মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরীক্ষা করা যেতে পারে। অতীতে বিদেশিদের উদ্যোগ সফল হয়নি। তাই অভ্যন্তরীণ সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামোর আন্তরিকতা ও সংশ্লিষ্টতা প্রয়োজন। ২০২৪ সালের শুরুতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের দিকে এখন সবার দৃষ্টি। চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তির ভূরাজনৈতিক স্বার্থের প্রেক্ষাপটে এ দেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা ও জোরদার করা জরুরি।
আগে উল্লেখিত বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে বলা যায় যে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান যথাযথ ভারসাম্যমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনের জন্য জরুরি। এখন প্রয়োজন হলো সমঝোতার ভিত্তিতে বিপরীতমুখী পক্ষগুলোর তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ ও সফল বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার অনুসন্ধান।
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক।