জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক—সব সময় যাঁকে আমি ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতাম—প্রথম তাঁকে দেখি ১৯৬১ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। স্যারের টিউটোরিয়াল গ্রুপেও আমি ছিলাম। স্যারের পড়ানোর ধরন ছিল অন্য শিক্ষকদের চেয়ে আলাদা। তিনি শিক্ষার্থীদের প্রথমে প্রশ্ন করতেন, প্রশ্নোত্তরের পর লেকচার দিতেন। টিউটোরিয়াল ক্লাসে তিনি রচনা লিখতে দিতেন না। তিনি আশা করতেন, আমরা তাঁকে প্রশ্ন করব, বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা, তর্কবিতর্ক হবে। তখন বুঝতে পারিনি, কিন্তু পরে যখন নিজে শিক্ষক হলাম, তাঁর পড়ানোর স্টাইলের মহত্ত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। বুঝতে পারলাম, কেন তিনি কতগুলো গড়পড়তা ছাত্রের শিক্ষক নন; বরং শিক্ষকেরও শিক্ষক। সব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে এবং কোনো বিষয়কে নতুন আঙ্গিকে দেখতে শেখানোটাই ছিল তাঁর শিক্ষকতার প্রধান লক্ষ্য।
স্যারের সঙ্গে আলোচনার একটা প্রধান প্রাপ্তি ছিল তাঁর সুতীক্ষ্ণ পর্যালোচনা। সব বিষয়ে তাঁর একটা বিশেষ অন্তর্দৃষ্টি ছিল, যেকোনো গবেষককে যা দিকনির্দেশনা দিতে পারত। মনে পড়ে, ১৯৬৮ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পিএইচডি থিসিসের জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে যখন ঢাকায় আসি, তখন স্যার আমাকে বললেন যে কেবল ছয় দফা দিয়ে বাঙালিকে আর সন্তুষ্ট করা যাবে না, দেশের লোক এখন চায় পাকিস্তানের বলয় থেকে মুক্তি। অন্য কেউ সে সময় কথাটা এমন স্পষ্ট করে বলেনি, তাই সেটা আমার মনে গেঁথে গেল। তাঁর সঙ্গে কথার পর আমার বিশ্বাস জন্মাল যে গবেষণার ক্ষেত্রে আমি ঠিক পথেই চলছি, পাকিস্তান আর বেশি দিন টিকবে না। তারপর আমি দ্রুতই ১৯৬৯ সালে পিএইচডি থিসিসটা শেষ করে ফেলি। পরে ১৯৭২ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস আমার গবেষণাটি বই আকারে প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল পাকিস্তান: ফেইলিউর ইন ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন। কী কারণে পাকিস্তান ভাঙল এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হলো—এ বিষয়ে এটিই ছিল প্রথম প্রকাশিত গবেষণা।
১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর থেকে স্যারের সঙ্গে আমার আলোচনার পরিধি আরও বাড়ল। কী কী বিষয়ে নতুন নতুন গবেষণা হতে পারে, মূলত এটাই ছিল আলোচনার বিষয়। স্যার আমাকে সামাজিক বা অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিষয় নিয়ে গবেষণার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু আমার উৎসাহ ছিল সমসাময়িক রাজনীতির বিষয়বস্তু নিয়ে। আমি ১৯৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচন ও জাতীয় সংসদের সদস্যদের ওপর জরিপভিত্তিক গবেষণা শুরু করলাম। স্যারের পছন্দের বিষয় না হলেও আমার গবেষণার কাজে সমর্থন দিয়েছিলেন তিনি।
১৯৭৩ সালে হঠাৎই স্যার জানালেন, নতুন নিয়ম অনুসারে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হয়ে আর থাকবেন না। জ্যেষ্ঠ সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে আমাকেই সেই দায়িত্ব নিতে হবে। আমি তাঁকে অধ্যাপক পদের জন্য আবেদন করে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব চালিয়ে যেতে অনুরোধ করি। তিনি রাজি হননি। জ্যেষ্ঠ প্রভাষক হিসেবেই থেকে গেলেন। অবশ্য অবসরে যাওয়ার পর সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্তি দিয়েছিল। আসলে ব্যক্তিগত কোনো জিনিসের প্রতি স্যারের কোনো দিন মোহ ছিল না, কোনোকালে কোনো পদের জন্যও আগ্রহ দেখাননি। তাঁর একমাত্র নেশা ছিল বই পড়া। তিনি আমার দেখা একমাত্র মানুষ, যিনি কেবল মনের আনন্দের জন্য বই পড়তেন, বই বা নিবন্ধ লেখার জন্য পড়তেন না। নিজে লেখালেখি না করলেও সব সময় স্যার অন্যদের গবেষণা করতে, লিখতে উৎসাহিত করতেন। অনেক নামীদামি গবেষক, লেখক স্যারের কাছ থেকে অনেক গবেষণা ও লেখার সূত্র পেয়েছেন। অনুপ্রাণিত হয়েছেন। অধ্যাপক খালিদ বিন সায়িদ ও আনিসুজ্জামান উভয়েই তাঁদের লেখায় স্বীকার করেছেন, যেসব বিষয় নিয়ে তাঁরা কাজ করেছেন, সেগুলোর বেশ কয়েকটির প্রাথমিক ধারণা পেয়েছিলেন রাজ্জাক স্যারের কাছ থেকে।
মনেপ্রাণে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমর্থক, সামরিক শাসনের ঘোর বিরোধী। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশের সমস্যার সমাধান একমাত্র রাজনৈতিকভাবেই করতে হবে; এবং তা করবেন রাজনীতিবিদেরা। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন তিনি। সমাজে উপেক্ষিত জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে সম্ভব না, তা তিনি বিশ্বাস করতেন। তাঁর এসব চিন্তাধারা ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের মূল চেতনাকে বিকশিত করতে সহায়তা করেছে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই নয়া রাষ্ট্র যে অগণতান্ত্রিক পন্থা নিয়েছিল, তার বিরোধিতা করা প্রথম ভিন্নমতাবলম্বীদের একজন ছিলেন স্যার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রগতিশীল অংশ হিসেবে পরিচিত যে দলটি ছিল, তিনি ছিলেন তাঁদেরই একজন, যাঁরা স্বায়ত্তশাসন, স্বশাসন, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অর্থনৈতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে বাঙালির দাবিকে সমর্থন করেছিল। মুসলিম লীগ–বিরোধী রাজনীতিকদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ১৯৫৬-৫৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পূর্ব পাকিস্তান পরিকল্পনা বোর্ডের একজন সদস্য হিসেবে তাঁকে নিয়োগ দেয়। সেই একবারই তিনি সরকারি পদ গ্রহণ করেছিলেন। তারপর রাজনীতিকদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল, কিন্তু তিনি কোনো সরকারি বা রাজনৈতিক পদ পাওয়ার জন্য আগ্রহী হননি। উপদেশ-পরামর্শের জন্য রাজনীতিকেরা তাঁর কাছে আসতেন, কিন্তু তাঁকে কখনো স্বেচ্ছায় রাজনৈতিক নেতাদের কাছে যেতে দেখিনি।
স্যার প্রচারবিমুখ ছিলেন। বক্তৃতা দিতে বা লিখতে তাঁর আগ্রহ ছিল না। তাঁর প্রধান শক্তি ছিল ঘরোয়া আলোচনার মাধ্যমে মানুষের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করা। অবশ্য যে কটি বই ও নিবন্ধ তিনি লিখেছেন, তাতে তাঁর চিন্তাধারার বলিষ্ঠ প্রকাশ আমরা দেখতে পাই। ১৯৫০ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর লেখা থিসিস, যা পরে ২০২২ সালে পলিটিক্যাল পার্টিস ইন ইন্ডিয়া (ভারতের রাজনৈতিক দল) শিরোনামে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত হয়, তাতে তিনি আমাদের দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল সম্বন্ধে অনেক সুদূরপ্রসারী মন্তব্য করেছেন। তিনি লিখেছিলেন, ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর তেমন কোনো সামাজিক, অর্থনৈতিক নীতি বা পরিকল্পনা নেই। এদের কর্মসূচি নেতিবাচক। তাই এদের আসলে রাজনৈতিক দল বলা যায় না; বরং এরা হলো রাজনৈতিক আন্দোলন। ৭০ বছর আগে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর যেসব দুর্বলতা তিনি চিহ্নিত করেছিলেন, আজও তা প্রযোজ্য।
১৯৫৯ সালে সামরিক শাসনের দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরে রাজ্জাক স্যার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন। সামরিক শাসনামলে সেই শাসনের এমন সমালোচনায় স্যারের নির্ভীক মনের পরিচয় পাওয়া যায়। লেখাটা পড়ার পর এক পাকিস্তানি আমলা খেপে গিয়ে আমাকে বলে ছিলেন, রাষ্ট্রদ্রোহের জন্য রাজ্জাক স্যারকে শাস্তি দেওয়া উচিত।
স্যারের শেষ লিখিত প্রকাশনা ১৯৮০ সালে দেওয়া একটি পাবলিক লেকচার, যা ১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশ: স্টেট অব দ্য নেশন নামে প্রকাশিত হয়। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের শাসন আমলে লেখা এই লেকচারটিতেও নির্ভীকভাবে সামরিক শাসনের সমালোচনা করে স্যার বলেছেন, সামরিক শাসন হলো সর্বনাশা, এটা হলো নিজ দেশকে দখল করা। একই সঙ্গে এ লেখায় তিনি বঙ্গবন্ধুকে আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতীক বলে উল্লেখ করেছেন। লেখাটিতে আবারও আমরা তাঁর গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, নাগরিক অধিকার, সমতা—এসব মূল্যবোধের পরিচয় পাই। তিনি বলেন, মাটি, পানি ও মানুষ বাংলাদেশের প্রধান সম্পদ। যদি দেশের উন্নয়ন করতে হয়, তাহলে সেই প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রে থাকবে এই তিন সম্পদের উন্নয়ন।
চিরকাল বইয়ের পাতায় ডুবে থাকা অধ্যাপক রাজ্জাক অকৃতদার হলেও ছিলেন পুরোদস্তুর পরিবার–অন্তঃপ্রাণ। তাঁর ভাই ও ভাইয়ের পরিবার তাঁর সঙ্গে থাকতেন। তিনি বাজার করতে এবং লোকজন খাওয়াতে পছন্দ করতেন। তাঁর বাড়িতে বহু লোকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, পরে যাঁরা আমার আজীবনের বন্ধু হয়েছেন। কেবল খাবারের মান নয়, স্যারের খাবারের টেবিলে যে অতিথিরা থাকতেন, তাঁরাও শিক্ষা, চিন্তা, রুচি আর শিল্পবোধে ছিলেন অত্যন্ত উঁচু দরের মানুষ। তিনি যে কেবল কেতাবি মানুষদের নেমন্তন্ন করতেন, তা নয়। তাঁর খাবার টেবিলে কেউ সাহিত্যিক, কেউ চিত্রশিল্পী, কেউ আমলা, কেউ আবার ব্যাংকার বা ব্যবসায়ী। কেউ তরুণ, কেউবা বৃদ্ধ। স্যার সব সময় মেধাবী অল্প পরিচিত তরুণ মুখদের সমাজে প্রতিষ্ঠিতদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পছন্দ করতেন। মানুষের দক্ষতা আর যোগ্যতার ভিন্নতাকে গভীরভাবে মূল্যায়ন করতেন তিনি।
অনেক বিষয়ে আমাদের ভিন্নমত ছিল, কিন্তু স্যার আমাকে কখনো মত পরিবর্তনের জন্য চাপ দেননি। ভিন্নমত গ্রহণের একটা অসাধারণ মানসিকতা তাঁর ছিল। মানুষের জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নেওয়া সিদ্ধান্তের প্রতি তিনি ছিলেন সহানুভূতিশীল ও শ্রদ্ধাশীল।
স্যার এখন আর আমাদের মাঝে নেই। কেউ তাঁর শূন্যতা পূরণ করতে পারেনি। তিনি ছিলেন একজন প্রথাভাঙা চিন্তাবিদ, যিনি প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতিকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন; ছিলেন এমন একজন শিক্ষক, তুমুল আলোচনার জন্য যাঁর দুয়ার সব সময় ছিল খোলা, যিনি সদা সচেষ্ট ছিলেন তরুণ মেধাবীদের চিহ্নিত করতে; এমন একজন বুদ্ধিজীবী, যিনি মনের খোরাক মেটানোর জন্য জ্ঞান আহরণ করতেন; ছিলেন সমানুভূতিশীল এক মানুষ, যিনি সবাইকে সমানভাবে অনুভব করতে জানতেন, এক উদার হৃদয়ের অধিকারী, যিনি মানুষের দুর্বলতাকে সহজেই ক্ষমা করে দিতে পারতেন।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তাঁর চিন্তাচেতনার উত্তরাধিকার আমাদের দিয়ে গেছেন। তাঁর প্রকাশিত কাজগুলো প্রতিনিয়ত তরুণ প্রজন্মকে বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন তোলার সাহস জোগাবে। স্যার শিখিয়েছেন, একজন সত্যিকারের জ্ঞানী মানুষ কখনো যাচাই না করে ‘অফিশিয়াল’ তথ্য বা প্রতিষ্ঠিত মতবাদকে মেনে নেবেন না। বৈষম্যমূলক সমাজ এবং অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কোনো জাতির জন্য মঙ্গল ডেকে আনবে না।
রওনক জাহান: আব্দুর রাজ্জাকের শিক্ষার্থী; রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)