কর্মীর লেখা

প্রথম আলো দায়িত্ব নেয়, দায়িত্ব নিতে শেখায়

প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।

২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩

সকাল থেকেই হাজারো শিক্ষার্থীর পদচারণে মুখর, শিক্ষার্থী–অভিভাবকের পরিপূর্ণ থিম পার্ক। পাখির কিচিরমিচির মিছিলের মতো একঝাঁক শিক্ষার্থী, যারা আগামীর বাংলাদেশ। কেউ এসেছে মা–বাবাকে নিয়ে, কেউ বন্ধুর সঙ্গে, কেউবা ছোট ভাইবোনকে নিয়ে। বলছি ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় অবস্থিত ফ্যান্টাসি কিংডমের কথা। যেখানে চলছে শিখো–প্রথম আলো জিপিএ-৫ প্রাপ্ত কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা।

স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বাইরের গেটে দায়িত্ব শেষ করে। মাত্রই বসেছি প্রথম আলোর স্টলে। বেলা ১১টার দিকে এক নারী শিক্ষার্থী রাইড থেকে নামতে পা পিছলে পড়ে যায়। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে এক্স-রে করানো হয়। বড় কোনো সমস্যা না থাকায় চিকিৎসক তাকে বাসায় বিশ্রামে থাকতে বলেন। আমি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বিষয়টি শেয়ার করামাত্রই সবাই ফোন করতে থাকে, মেয়েটির কী অবস্থা, কোথায় আছে? মেয়েটিকে এনে ভিআইপি রেস্টরুমে বসাই। ততক্ষণে সুমি আপা, অরূপদা, মামুন ভাই, আকরাম ভাইসহ অনেকে উপস্থিত হয়ে যান সেখানে। তার পা প্রচণ্ড ফুলে গেছে। তাড়াতাড়ি বরফের ব্যবস্থা করে আহত স্থানে প্রয়োগ করা হয়। যেন ব্যথাটা কমে যায়। ‘মা, তোমার কেমন লাগছে? তুমি কি বাসায় যেতে চাও? আমরা কি বাসায় পৌঁছে দেব?’ সুমি আপা জানতে চান।

পাশ থেকে এক অভিভাবক অন্যজনকে বলেন, ‘এটাই প্রথম আলো। এরা দায়িত্ব নিতে জানে। এ জন্যই বাচ্চাকে এখানে নিয়ে এসেছি। আমার বাচ্চাও যেন এ রকম দায়িত্ব নিতে শেখে।’

কথাগুলো আমার কানে আটকে যায়। আমি যেন ফিরে যাই আমার সেই শৈশবে। ছোটবেলায় আমার সব অসুস্থতার ওষুধ ছিল আমার মা। মা পাশে থাকলেই আমি সুস্থতা বোধ করতাম। মা জানতে চাইত, ‘বাবা, তোমার কেমন লাগছে?’ কথাটা বারবার আমার কানে বাজতে থাকল। মেয়েটি উত্তরে বলল, সে বাসায় যেতে চায় না। ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন এই সংবর্ধনা। তাই অনুষ্ঠান শেষ করে যেতে চায়। আমি খাবারসহ প্রয়োজনীয় সব উপকরণ এনে দিই। পাশ থেকে এক অভিভাবক অন্যজনকে বলেন, ‘এটাই প্রথম আলো। এরা দায়িত্ব নিতে জানে। এ জন্যই বাচ্চাকে এখানে নিয়ে এসেছি। আমার বাচ্চাও যেন এ রকম দায়িত্ব নিতে শেখে।’

৪ আগস্ট ২০২৪

সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির প্রথম দিন। সরকার-সমর্থক নেতা-কর্মী ও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। আমাদের একজন নারী সহকর্মী অফিসে আসার পথে সংঘর্ষের সামনে পড়লে একটি নিরাপদ আশ্রয় নেন। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে অফিসে চলে আসেন। এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রাথমিক চিকিৎসায়ও স্বাভাবিক হতে পারেন না। তাঁর শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসকের পরামর্শ, তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।

অফিস থেকে বিভিন্ন হাসপাতালে ফোন করেও যখন অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন উপসম্পাদক লাজ্জাত ভাই, হেড অব এইচআর শামীম ভাই, হেড অব অ্যাডমিন উৎপলদা ও কবীর ভাই সিদ্ধান্ত নিলেন, অফিসের কাজের জন্য রাখা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করেই হাসপাতালে নিতে হবে। আপাকে বার্তাকক্ষ থেকে নামানো হলো। সঙ্গে যাচ্ছেন পরামর্শক (সংবাদ) মিতি আপা, মানবসম্পদ বিভাগের সঞ্চিতাদি। সঙ্গে একজন পুরুষ সহকর্মীকে যেতে হবে।

আপাকে বাসায় পৌঁছে দিতে চাই কিন্তু কারওয়ান বাজার মোড়ের আগেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদের ফিরিয়ে দেয়। সিএনজিতে বসে আছি আর ভাবছি, সত্যিই ‘প্রথম আলো দায়িত্ব নেয়, দায়িত্ব নিতে শেখায়’।

যখন আমাকে যেতে বলা হলো, বুকের ভেতর কেমন যেন ধাক্কা দিল। এ রকম পরিস্থিতিতে আগে কখনো বাইরে যাইনি। আমাকে যখন বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরতে দেওয়া হলো, তখন আমি সংবিৎ ফিরে পেলাম। কী করব, ভাবতে পারছি না। ঠিক তখন মনে পড়ে গেল সেই অভিভাবকের কথা, যিনি বলেছিলেন, এরা দায়িত্ব নিতে জানে।

বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে সিএনজির সামনে বসে যাচ্ছি। ঠিক তখনই ছোট বোনের ফোন, কান্না জড়ানো কণ্ঠে জানায়, আমাদের সপ্তম শ্রেণিতে পড়া ভাগনে রোহান সকালে প্রাইভেট পড়তে গিয়ে আর বাসায় ফেরেনি। আমি চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করি। আমাদের টাঙ্গাইল প্রতিনিধি শেখরদাকে ফোন করে জানতে চাই, সেখানে কোনো হতাহত হয়েছে কি না? কিছুক্ষণ পর আবার ফোন আসে, ওর বন্ধুরা বলেছে, রোহান কাঁদানে গ্যাসের শেল খেয়ে রাস্তায় পড়ে রয়েছে। আমি আর কিছু ভাবতে পারি না। তাকে সাহস দিয়ে বলি, কাঁদানে গ্যাসের শেলে তেমন ক্ষতি হয় না। কিন্তু ভেতর থেকে কী যেন ভেঙে যাচ্ছে। ততক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছে গেছি। আপাকে নিয়ে জরুরি বিভাগে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে। ভয়ের কিছু নেই।

আপার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র পৌঁছে দিয়ে রিসেপশনে বসতেই জানতে পারি, রোহান কাদামাটি মাখা শরীরে বাসায় ফিরেছে। আপার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়েছে। তাকে বিশ্রামে থাকতে হবে। চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র দিয়ে হাসপাতাল থেকে আমাদের ছেড়ে দেন। আপাকে বাসায় পৌঁছে দিতে চাই কিন্তু কারওয়ান বাজার মোড়ের আগেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদের ফিরিয়ে দেয়। সিএনজিতে বসে আছি আর ভাবছি, সত্যিই ‘প্রথম আলো দায়িত্ব নেয়, দায়িত্ব নিতে শেখায়’।

আতিকুর রহমান, প্রশাসনিক সহযোগী