চীন–বাংলাদেশ সহযোগিতার সোনালি সাফল্য 

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্বদেরও মনোযোগ আকর্ষণ করেছে প্রথম আলোপ্রথম আলোর জন্য তাঁরা লিখেছেন বিশেষ শীর্ষ রচনা, দিয়েছেন একান্ত সাক্ষাৎকার। সেসবের নির্বাচিত একটি অংশ রইল এখানে।

সি চিন পিং

বাংলাদেশ এক অদ্ভুত সুন্দর ও মনোরম স্থান। এখানে আছে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার মতো তিনটি বড় নদী; আছে হাজার হাজার বর্গমাইলের উর্বর ভূমি। বছরের অধিকাংশ সময়ই বাংলাদেশ সবুজ জেড পাথরের মতো রঙিন। ফসল তোলার সময় এই দেশই আবার সোনালি পোশাকে আবৃত হয়। অদ্বিতীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই দেশের মানুষ পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমান। বাঙালি ও বাংলা ভাষার রয়েছে হাজার বছরের উজ্জ্বল ইতিহাস। বাংলায় সাহিত্য চর্চা করে বিশ্বখ্যাত হয়েছেন নোবেলজয়ী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

চীন ও বাংলাদেশের জনগণ প্রাচীনকাল থেকেই পরস্পরের ভালো প্রতিবেশী ও বন্ধু। প্রাচীনকালের দক্ষিণ রেশমপথ এবং সামুদ্রিক রেশমপথ ছিল দুই পক্ষের যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার মূল মাধ্যম। এ নিয়ে হাজার বছর ধরে প্রচলিত অনেক গল্প-কাহিনিও রয়েছে। চীনের ফাহিয়েন ও হিউয়েন সাং বৌদ্ধধর্মগ্রন্থের সন্ধানে এ অঞ্চলে এসেছিলেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের অতীশ দীপঙ্কর চীনে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেছেন।

চীনের মিং রাজবংশ আমলের সমুদ্রচারী চাং হো-ও দুবার বাংলা সফর করেন। তিনি লিখেছেন: ‘এ অঞ্চলের রীতিনীতি সরল। এলাকাটি জনবহুল ও শস্যসমৃদ্ধ। এখানকার উর্বর জমিতে প্রচুর ফলন হয়।’ বঙ্গদেশের তৎকালীন রাজা চীনের মিং রাজবংশ আমলের সম্রাটকে একটি জিরাফ উপহার দিয়েছিলেন। তখন ওই জিরাফ চীনে ‘চীনা ড্রাগন ছিলিন’ নামে খ্যাতি অর্জন করেছিল।

চীনারা বলে, ‘মনের মিল থাকলেই কেবল দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্ব হতে পারে।’ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর ৪১ বছর ধরেই চীন বাংলাদেশকে আন্তরিক বন্ধু ও উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে গণ্য করে আসছে।

চীন ও বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রজন্মের নেতারা দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে সুষ্ঠু যোগাযোগ বজায় রাখার নীতি অনুসরণ করে এসেছেন এবং দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে বরাবরই কাজ করে গেছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের শীর্ষ সম্মেলন চলাকালে আমার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ হয়। তখন আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ, যৌথভাবে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ কৌশল বাস্তবায়ন ও ‘বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডর’ নির্মাণকাজ ত্বরান্বিত এবং দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে নতুন পর্যায়ে উন্নীত করতে একমত হই।

চীন ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সর্বাধুনিক নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শাহজালাল সার কারখানা ও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্র। বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণের ‘স্বপ্নের সেতু’ পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। পরিবহন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, টেলিযোগাযোগসহ নানা ক্ষেত্রে চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এই নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত আছে। চীনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক প্রথম দফায় যেসব প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্পও অন্তর্ভুক্ত। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের এক কোটির বেশি গ্রামবাসী উপকৃত হবেন। 

আমরা পরস্পরের উন্নয়নকৌশল সমন্বয় করে পারস্পরিক কল্যাণ অর্জন করব। চীন ও বাংলাদেশের সহযোগিতার সুপ্তশক্তি বিশাল। আমরা চীনের ত্রয়োদশ পাঁচসালা পরিকল্পনা এবং বাংলাদেশের সপ্তম পাঁচসালা পরিকল্পনার মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এতে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক আদান-প্রদান সম্প্রসারিত হবে এবং অবকাঠামো, উৎপাদন, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, পরিবহন, তথ্য, টেলিযোগাযোগ, কৃষিসহ নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আমরা ‘বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডর’-এর কাঠামোতে দুই পক্ষের বাস্তব সহযোগিতা জোরদার করব, যাতে দুই দেশের জনসাধারণ সত্যিকার অর্থেই উপকৃত হতে পারে।

আমি বিশ্বাস করি, চীন ও বাংলাদেশের জনগণের যৌথ প্রচেষ্টায় দুই দেশের সহযোগিতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও সম্প্রসারিত হবে এবং এ সহযোগিতার সোনালি ফসল ঘরে তুলতে আমরা সক্ষম হব।

সি চিন পিং: চীনের প্রেসিডেন্ট

প্রথম আলোর শীর্ষ খবর হিসেবে লেখা

১৪ অক্টোবর ২০১৬