গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে এই আন্দোলনের পুরো টাইমলাইনকে আমি আমার রাজনৈতিক যোগাযোগের ব্যবহারিক বাস্তবতা হিসেবে দেখতে পারি। ২০১৮ সালে আমি যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা শুরু করি, তখনই শুরু হয় প্রথম কোটা সংস্কার আন্দোলন। ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ বলে তাঁরা আন্দোলন করছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দোহাই দিয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন একটু বড় হলে রাস্তায় ফেলে বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলামকে দিনদুপুরে হাতুড়িপেটা করতে দেখলাম। একই বছর পুরো বাংলাদেশ কাঁপিয়ে দেয় নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। এসবের পরে এল ২০১৮ সালের নিশি ভোটের নির্বাচন। সবকিছু কেমন যেন এ দেশের মানুষ, বিশেষত মধ্যবিত্ত সমাজ মেনে নিয়েই চলছিল। যা কিছু হোক, তরুণ প্রজন্ম খুব একটা কথা বলতে আগ্রহী নয়। অদৃশ্য এক মাফিয়াতন্ত্রে রয়েসয়ে নিজেকে গুছিয়েই চলছিল সবাই। কিন্তু মাফিয়াদের দুঃশাসন আর অত্যাচারের ফলে জনমানসে নীরবে যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল, সে ক্ষোভের আগুন সামলানোর সাধ্য কারও নেই—এই ধ্রুব সত্য তারা কখনো টের পায়নি, বুঝতেও চেষ্টা করেনি, উল্টো দম্ভভরে হম্বিতম্বি করতেই দেখা গেছে। মানুষ একটা গণবিস্ফোরণের অপেক্ষাই করছিল।
যেকোনো ক্ষমতাকে প্রশ্নের ওপর রাখতে সাংবাদিকতার একটা গোল্ডেন রুল আছে। সেটা হলো, ‘টু কমফোর্ট দ্য অ্যাফ্লিক্টেড অ্যান্ড টু অ্যাফ্লিক্ট দ্য কমফোর্টেবল’ (নিপীড়িতদের স্বস্তির ব্যবস্থা করা এবং শান্তিতে থাকা ক্ষমতাধরদের উৎপীড়নে রাখা)। পাঁচ থেকে ছয় বছরের ছোট্ট সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে আমি মৌলিকভাবে এবং সাধ্যমতো এই চর্চাটা করতাম। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার অস্ত্রটা মাফিয়াতন্ত্রের কলকবজার দিকেই যাচ্ছিল। করোনা–পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সিট–বাণিজ্য সিন্ডিকেট উন্মোচন করে আমার একটা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের কিছুদিন পর পত্রিকা থেকে আমাকে বিনা নোটিশে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ক্যাম্পাসে আমি হয়ে যাই পরিচয়হীন সাংবাদিক। তবে সাংবাদিকতা হারালেও সংবাদ–সোর্স তো আমি হারাইনি। এই সময়ে সাংবাদিক থেকে আমি রাজনীতির মানুষ হয়ে যাই। নানান মত ও পথের লোকের সঙ্গে তৈরি হতে থাকে যোগাযোগ। গত কয়েক বছরে ক্যাম্পাসে যেকোনো আন্দোলনমুখী ন্যারেটিভ কাজে লাগানোর মতো একটা যোগাযোগ আমাদের তৈরি হয়ে যায়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তথা রাজশাহীর সর্বস্তরের জনগণ এই আন্দোলনে যুগান্তকারী কিছু ভূমিকা পালন করেছেন। হাসিনাকে তাড়ানো সম্ভব কি না, সেটা মাঠের বাস্তবতায় বেশ আগেই করে দেখিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১৪ ও ১৫ জুলাই দেশব্যাপী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের হামলার শিকার হচ্ছিলেন। ১৫ জুলাই দিনভর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের পাশবিক হামলা-নির্যাতনের শিকার হন।
১৫ জুলাই রাতে আমরা কয়েকজন মিলে পরিকল্পনা করি, একটা সুনির্দিষ্ট জমায়েত স্থান নয়, বরং চার থেকে পাঁচটা স্থানে শিক্ষার্থীদের হল ও মেস থেকে বিচ্ছিন্নভাবে জমায়েত করা হবে। মাত্র ৫০ থেকে ৬০ জন ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী হুমকি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি শিক্ষার্থীদের দমিয়ে রাখার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু ছাত্রলীগের বিদ্রোহী অংশের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ থাকায় তাদের হুমকির পেছনের শক্তিমত্তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেয়ে যাই।
এই আন্দোলনে মাফিয়াতন্ত্রের হাতে নিপীড়িত বহু ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ জনতার সঙ্গে রাজপথে নেমে এসেছিলেন। তাঁরা সেদিন আমাদের বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে ছিলেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। ১৬ জুলাই আমাদের কর্মসূচি ছিল বেলা আড়াইটায়। তবে শিক্ষার্থীদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি নস্যাৎ করতে এক ঘণ্টার ব্যবধানে একই স্থানে জমায়েতের ডাক দেয় ছাত্রলীগ। কিন্তু আমরা সবকিছু গোপন রেখে দু-তিন ঘণ্টা আগে থেকে শিক্ষার্থীদের বের হয়ে আসতে বলি। বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকার মেস থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে প্রবেশের ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে শহীদ জিয়াউর রহমান হলের শিক্ষার্থীরা হলের সামনে অবস্থান নেওয়া ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হলের ভেতর থেকে প্রতিহত করতে শুরু করেন। সেখানে ইটপাটকেল খেয়ে মাদারবক্স হলের সামনে যায় সন্ত্রাসীরা। ততক্ষণে সোহরাওয়ার্দী ও জোহা হলের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শাহ মখদুম, লতিফ ও আমির আলী হলের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে রাবি (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ হিল গালিবকে তাড়া করেন। এর ফলে সাড়ে ১৫ বছরের রাজত্ব ফেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতারা। নিজেদের পরিকল্পনা মাঠে সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে, বিরল সে মাহেন্দ্রক্ষণ স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার হলো।
এর মধ্যেই দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে সরকার। সাধারণ সম্পাদক গালিবের পালানোর ভিডিও সবার আগে ফেসবুকে আমিই পোস্ট করি, ১০ সেকেন্ডের সে ভিডিওতে আবার আমি নিজেও আংশিক আধেয়। এতে আন্দোলনকারী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাই আমি। মহানগর যুবলীগের বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী আমার বাসার সামনে এসে পরদিনই আমাকে রাজশাহী ছাড়ার হুমকি দেয়। আর রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পরোক্ষভাবে মানে আমার বন্ধুদের মাধ্যমে আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দিতে থাকলে একপর্যায়ে আমি রাজশাহী ছেড়ে পাশ্ববর্তী আরেকটি জেলায় চলে যাই। পরে সেখান থেকে অন্যত্র স্থানান্তরিত হই। গোয়েন্দাদের নজরদারি এড়াতে মুঠোফোনের সিম কার্ড রাজশাহীতেই খুলে ফেলি। কিন্তু কারফিউয়ের দিনগুলোয় আমাদের বড় ভাই রাশেদ রাজন কমিটিতে থাকতে আগ্রহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আরেকটা কমিটি দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তখন মোটামুটি সবাই সমন্বয়ক পরিষদে নাম দিতে অপারগতা প্রকাশ করতে থাকলে নেত্বত্বের দায়িত্ব একেবারে বাধ্য হয়ে আমাকেই নিতে হয়। আমরা ১৭ জন এ তালিকায় নিজের নাম লেখালাম।
কারফিউর পর কেন্দ্র থেকে প্রথম আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হলো। আন্দোলনের সফলতা নিয়ে শতভাগ অনিশ্চয়তা, কিন্তু প্রাণ হারানোর শতভাগ নিশ্চয়তা নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের কয়েক শ ছাত্র–জনতা এসে হাজির হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য এবং বেশ কয়েকজন দুঃসাহসী শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে কারফিউ ভেঙে ফেলে রাজশাহী। ‘শেম শেম ডিক্টেটর’ স্লোগানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে বিনোদপুর পর্যন্ত বিক্ষোভ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। সে কর্মসূচির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে জালিমের মসনদ কেঁপে ওঠে। কারফিউ ভাঙার দুঃসাহস সেদিন প্রথম দেখিয়েছেন রাবির শিক্ষার্থী ও রাজশাহীর বীর সন্তানেরা।
আন্দোলনে প্রথম যুক্ত হই ১৪ জুলাই রাতে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের গণহারে ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ আখ্যা দিলে রাতেই রাজপথে নেমে আসেন শিক্ষার্থীরা। পুরো আন্দোলন কিছু জিনিস একেবারে নিয়ম করে শিখিয়ে দিচ্ছিল। আন্দোলন মাঠে গড়ানোর আগে তা কয়েক ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এজেন্ডা থেকে ন্যারোটিভে পরিণত হচ্ছিল। ফলে আন্দোলনের নিউক্লিয়াস হয়ে ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। আমরা মূলধারার গণমাধ্যম থেকে পুরোপুরি অসহযোগিতা পেয়ে নিজ নিজ টাইমলাইন, গ্রুপ, পেজকেই গণমাধ্যমে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নিই। প্রতিটি সেকেন্ড আমাদের সতর্ক থাকতে হচ্ছিল, যেন জনমানুষের মনোবল ভেঙে না পড়ে, এজেন্ডা থেকে শত শত শহীদের রক্তের দাগ মুছে না যায়, গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা না যায়। এ জন্য আমরা নারী শিক্ষার্থীদের আলাদা করে একটা দল গড়ে তুলি, যার নাম দেওয়া হয় ‘প্রীতিলতা ব্রিগেড’। শত শত নারী শিক্ষার্থী সিদ্ধান্ত নিয়ে এজেন্ডা সেট করতে থাকেন। সে গ্রুপে সারা দেশ থেকে ছাত্রীরা যুক্ত হতে থাকেন। সেখানে জেন–জির ভিন্ন এক চেহারা দেখতে পাই। তাঁদের আকৃষ্ট করতে বিশেষায়িত মেসেজ ডিজাইন করা হতো, যাঁদের চাওয়া একটা বর্ণিল বাংলাদেশ।
আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার পর থেকে আমাদের চোখের ঘুম হারাম হয়ে গেল। দিনরাত স্ক্রিনে চোখ সবার। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে যাঁরা আন্দোলন থামাতে চেয়েছিলেন, তাঁদের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে গ্রামগঞ্জে সমন্বয় তৈরির মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তোলেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকদের সহায়তায় অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয় আমাদের। মুক্তির যুদ্ধে হাজারো মানুষ দলীয় পরিচয় ভুলে চলে আসেন এককাতারে। সবার চাওয়া সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ। হাজারো ছাত্র–জনতার হতাহতের বিনিময়ে ৫ আগস্ট তথা ‘৩৬ জুলাই’ মহাপরাক্রমশালী হাসিনা পালাতে বাধ্য হন। ‘৩৫ জুলাই’ সকাল থেকে চোখে ঘুম নেই, টান টান উত্তেজনা, আমি পরদিন লংমার্চে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। এই দিন দেখার জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা করেছে মানুষ। ঘোষণা দিলাম, বাংলাদেশের মানুষকে আমরা ইতিহাসের সাক্ষী বানাব। অনেক বছর আগে থেকেই আমার খুব ইচ্ছা, গণভবন থেকে হাসিনাকে বের করে আনার সাক্ষী নিজেই হব।
তবে ৫ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ওয়াই-ফাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে একেবারে স্ট্রোক করার পরিস্থিতিতে পড়ে যাই। ভাবছিলাম, আমরা এবারও হেরে যাব? আমি মোহাম্মদপুর থেকে গাবতলী হয়ে মিরপুর ১ দিয়ে গণভবনে যাচ্ছিলাম। ফোনে পুরো আন্দোলনের সবকিছু। কিন্তু পথে পথে পুলিশের তল্লাশি। রাস্তায় এক চায়ের দোকানে দেখলাম, সেনাপ্রধান বক্তব্য দিচ্ছেন, ‘হাসিনা পদত্যাগ করেছেন।’ আমি পাগলের মতো রাস্তায় নেমে দৌড়াচ্ছি। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, এটা কি আসলেই সম্ভব?
আমরা এটি সম্ভব করেছি। ৫৩ বছর ধরে বাংলাদেশের গণমানুষের সঙ্গে যে প্রতারণা হয়েছে, সেখান থেকে নতুনভাবে একটা এজমালি বাংলাদেশ গড়ার পথ অবশেষে খুঁজে পেয়েছি আমরা।
* জি কে এম মেশকাত চৌধুরী: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সমন্বয়ক