প্রথম আলোর বয়স মাত্র ২৫ বছর, কিন্তু এর অর্জন অনন্য। প্রথম আলো তার স্বপ্নের পথে এগোতে এগোতে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে অভূতপূর্ব কিছু মাইলফলক স্থাপন করেছে। সাহসী সাংবাদিকতা, উদ্ভাবনী পরিকল্পনা, দেশ ও বিদেশের অগ্রগণ্য মানুষের সম্পৃক্ততা ছিল এর শক্তি। প্রথম আলোর ২৫ বছরের নির্বাচিত ও সংক্ষেপিত বিষয়বস্তু থেকে পাওয়া যাবে এর স্বতন্ত্র পথরেখার নিশানা।
শতাব্দী শেষের একীভূত বিশ্বে বাংলাদেশের জাতীয় শাসনব্যবস্থার প্রধান কাজ হবে আঞ্চলিক নীতিসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত তৈরি করা। এ রকম এক বিশ্বায়িত পৃথিবীতে বসবাসের জন্য মানব উন্নয়নে বিনিয়োগ, আইন প্রয়োগ এবং সর্বোপরি স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে জনগণকে উপযোগী করে গড়ে তোলার ব্যাপারে যথেষ্ট কর্তৃত্ব দেওয়া হবে জাতীয় সরকারকে। এ রকম এক বিশ্বে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতাও অনেক গুণে বাড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেবে। উপজেলা থেকে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানসমূহকে স্থানীয় পর্যায়ে আইন প্রণয়ন, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আইন প্রয়োগের ক্ষমতা দিতে হবে। সেই সঙ্গে এরা যাতে তাদের কর্তৃত্ব ঠিকমতো প্রয়োগ করতে পারে, সে জন্য এদের নিজস্ব রাজস্ব আয়ের উৎস দিতে হবে। জাতীয় ও স্থানীয় কর ও শুল্কের পাশাপাশি বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বাজেট থেকে এসব স্থানীয় প্রশাসনে তহবিল আসবে।
তথ্যপ্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে লেনদেনের ক্ষমতা একেবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত উৎপাদনের বিকেন্দ্রীকরণকে ত্বরান্বিত করবে। যেমন তৈরি পোশাক আর শুধু ঢাকায় তৈরি করা হবে না, গোটা বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে এ কাজ চলবে। গ্রামভিত্তিক তৈরি পোশাক উৎপাদন এককগুলো ঢাকা ও চট্টগ্রামের মাধ্যমে যুক্ত থাকবে নিউইয়র্কে বিশ্ববাজারের সঙ্গে।
স্থানীয় পর্যায়ে প্রশাসনিক দায়িত্ব নির্বাহেও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। এর মাধ্যমে জাতীয় সরকার স্থানীয় সরকারের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করবে। এ ছাড়া জাতীয় সরকার এর মাধ্যমেই যুক্ত থাকবে অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। প্রাযুক্তিক সহায়তা ও সাইডেন্সের জন্য স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এমনকি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গেও সংযুক্ত থাকবে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে।
এ রকম এক পৃথিবীতে মানবসম্পদই হবে বাংলাদেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। ২০ কোটি বাংলাদেশি হবে সম্পূর্ণ শিক্ষিত। কমপক্ষে স্কুলের চৌহদ্দি পেরোবে সবাই। এদের সবার থাকবে তথ্যপ্রযুক্তির দক্ষতা। বিশ্বের সেরা চিকিৎসা-সুবিধার প্রাপ্যতা থাকবে তাদের। এরা পূর্ণমাত্রায় কর্মে নিযুক্ত থাকবে। সম্পূর্ণ সামাজিক নিরাপত্তাও দেওয়া হবে তাদের।
এমন এক পৃথিবীতে দারিদ্র্য হবে অতীতে ফেলে আসা এক অসুখের নাম, নারী-পুরুষ সাম্য হবে সম্পূর্ণ, পুরুষ আধিপত্য হবে সুদূরের স্মৃতি। এ রকম এক পৃথিবীতে পেশিশক্তির বদলে জ্ঞানই হবে কর্মক্ষেত্র এবং সক্ষমতা নির্ধারণের চাবিকাঠি। এ কারণে পুরুষেরা নারীদের সবচেয়ে ভালো কর্মক্ষেত্র কিংবা নেতৃত্বের পদ থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ পাবে না। ফলে রাজনৈতিক পদ, প্রশাসন, ব্যবসা ও পেশাগত জীবনে মেয়েদের পূর্ণ প্রবেশাধিকার থাকবে। তাদের কর্মক্ষেত্রে লৈঙ্গিক একাধিপত্য তৈরি হবে। এ রকম এক বিশ্বে সম্পদের মালিকানার গণতন্ত্রায়ণ ঘটবে। ফলে সম্পদের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘনীভবন সম্ভব হবে না। উৎপাদনমুখী সম্পদ, ঋণ ও করপোরেট সম্পদে অধিকার থাকবে প্রতিটি সাধারণ ঘরের।
এ রকম এক বিশ্বে আমাদের রাজনৈতিক শাসনের প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি গণতন্ত্রায়িত হবে। আমাদের জাতীয় ও স্থানীয় আইনসভার কমপক্ষে অর্ধেক সদস্য হবেন নারী। কোটার ভিত্তিতে নয়, তাঁরা নির্বাচিত হবেন শুধু যোগ্যতার ভিত্তিতে। এমন এক পৃথিবীতে জ্ঞান হবে সর্বজনীন। যে শ্রেণিগুলো এত দিন বঞ্চিত ছিল, যেমন ক্ষুদ্র কৃষক ও শ্রমিক, তারাও রাজনৈতিক ক্ষমতার নাগাল পাবে। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে অভিজাত শ্রেণির আধিপত্যের অবসান ঘটবে। এমন পরিস্থিতিতে বর্তমানকালের অভিজাতরা নিজেদের অপাঙ্ক্তেয় বোধ করতে পারে, কেননা সাবেক দারিদ্র্যপীড়িত শ্রেণিগুলোর সংখ্যার জোরের কারণে রাজনৈতিক ক্ষমতারও পুনর্বিন্যাস ঘটবে।
ভবিষ্যতের সে সমাজে লিঙ্গ ও শ্রেণিভেদ থাকবে না। বাংলাদেশের জাতীয় আইনসভা শ্রেণি ও লিঙ্গের বিবেচনায় ভারসাম্যপূর্ণ হবে। যাঁরা নির্বাচিত হবেন, তাঁরা সম্পদ বা পেশির জোরে নয়, বরং দক্ষতা ও সামাজিক অঙ্গীকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন। নির্বাচনের প্রত্যেক প্রার্থীর থাকবে বিনা মূল্যে তথ্যপ্রযুক্তিসেবার সব সুযোগ। এর মাধ্যমে এই প্রার্থী প্রতিটি ভোটারের সঙ্গে পৃথকভাবে যোগাযোগ করতে পারবেন। পারবেন তার প্রশ্নের জবাব দিতে। এ প্রক্রিয়া নির্বাচনী ব্যয় নাটকীয়ভাবে কমিয়ে আনবে। ফলে নির্বাচনে যে কারও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
এমন এক পরিপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে নিযুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সমাজে, যেখানে মেয়েরা প্রশাসনে আইন প্রয়োগ ও রাজনীতিতে সমান প্রতিনিধিত্ব পাবেন, সেখানে মাস্তানশ্রেণি গজিয়ে ওঠার বা মাস্তানসংস্কৃতি টিকে থাকার কোনো সুযোগ থাকবে না। এ আইনসভা হবে জ্ঞানভিত্তিক। এখানে আইনপ্রণেতাদের তাঁদের অবকাশকাল নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় কাটাতে বাধ্য করা হবে। বিপরীতে তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধাপ্রাপ্ত ভোটারও তার প্রতিনিধির সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে সংযুক্ত থাকবে। সে সুবাদে তাঁরা তাঁদের প্রতিনিধি প্রত্যাহারের অধিকারও চর্চা করার সুযোগ পাবেন। এভাবে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার যদি মতামত প্রদান করে, তাহলে প্রতিনিধিকে বিদায় নিতে হবে। ফলে প্রত্যেক জনপ্রতিনিধি তাঁর নির্বাচকদের কাছে সর্বদা জবাবদিহি থাকবেন। ভবিষ্যতের এই সমাজে রাজনীতিচর্চার খরচ বহুগুণে কমে যাবে। নির্বাচক ও নির্বাচিতের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ সৃষ্টি হওয়ায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় থাকা বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রয়োজন ক্ষীণ হয়ে আসবে। ফলে আগমন ঘটবে ক্ষুদ্র ও ইস্যুভিত্তিক দলের। বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর আধিপত্যবাদকে খর্ব করতে আইনসভায় এসব ক্ষুদ্র দলের উত্থান ঘটবে। এসব ক্ষুদ্র দলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে আবার গোটা অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা একই রকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের। বিশেষ বিশেষ ইস্যু ও আঞ্চলিক সমস্যার ব্যাপারে এসব ক্ষুদ্র দলের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হবে।
রাজনীতিবিদদের জবাবদিহি সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতে জবাবদিহি শাসনেরও জন্ম দেবে। নির্বাচিতদের পাশাপাশি নির্বাচকদের কাছেও সব সরকারি রেকর্ড তুলে ধরা হবে। সরকারি সব দলিল–দস্তাবেজ, ফাইল কম্পিউটারে ছেড়ে দেওয়া হবে। তাতে প্রবেশাধিকার থাকবে প্রত্যেক নাগরিকের। এর ফলে সব প্রশাসনিক কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।
ভবিষ্যতের বিশ্বায়িত পৃথিবীতে জ্ঞানের অস্ত্রে সজ্জিত দক্ষ বাংলাদেশি নাগরিকেরা হবে বিশ্বের সবচেয়ে ভ্রাম্যমাণ সমাজ। বিশাল জনসংখ্যাই হবে আমাদের সম্পদ। একদিকে অভিবাসন, অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব—দুইয়ে মিলে বিশ্বায়িত পৃথিবীর সঙ্গে বাংলাদেশের সেতু রচনা করবে। ফলে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় আমাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। এ শতকের সমাপ্তিকালের এই পৃথিবীতে উচ্চশিক্ষিত, দারিদ্র্যমুক্ত, সমতাবাদী, লিঙ্গসাম্যবিশিষ্ট, সামাজিকভাবে একীভূত, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, যত্নশীল, মুক্ত এবং বহির্মুখী এক সমাজ হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটবে, যেখানে শাসন হবে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক। এ দেশের গণতন্ত্র হবে বিশ্বের কাছে এক মডেল। আমাদের একমাত্র করণীয় হবে সে পৃথিবীতে আমাদের নিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত নেতাদের খুঁজে বের করা।
১১ নভেম্বর ২০০১ (সংক্ষেপিত)