মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ
মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ

ব্যাংকে সুশাসনে কিছু প্রস্তাব

বাংলাদেশের বিগত শাসনামলের একাধিক সমস্যা ও সাম্প্রতিক বিপ্লব সব খাতে পুনর্জাগরণের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট করে তুলেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক খাতে নজর দেওয়া দরকার, বিশেষত যখন অর্থনীতির সব কার্যক্রম এর সঙ্গে সম্পর্কিত।

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এখন একটি পরিচালনাগত সংকটের মুখোমুখি। কোনো ব্যাংকের দেউলিয়া হয়ে যাওয়া বিরল হলেও সম্প্রতি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী অদক্ষতার ফলে তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সরকার ব্যর্থ ব্যাংকগুলোকে করদাতাদের অর্থ দিয়ে পুনর্মূল্যায়ন করে তাদের বাজারের চাপ থেকে রক্ষা করেছে। প্রতিযোগিতার চাপের অভাব ব্যাংকগুলোর জন্য পরিচালনার কাঠামো উন্নত করার প্রণোদনা কমিয়ে দেয়; ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণে উৎসাহিত করে। তদুপরি সরকারের সমর্থনের নিশ্চয়তা থাকায় জমাকারীদের ব্যাংকগুলোর থেকে ভালো পরিচালনা দাবি করার উদ্দীপনা কমে যায়।

ব্যাংক খাতের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা হলো খেলাপি ঋণের মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণ। ব্যাংক খাতে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ও স্বচ্ছতার অভাব প্রকট। চলতি প্রথা প্রভাবশালী ব্যক্তি ও শক্তিশালী কোম্পানিগুলোকে নজরদারি ও জবাবদিহি ছাড়া বড় ঋণ পাওয়ার সুযোগ দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও ব্যাপক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সঙ্গে এই উচ্চ খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের আর্থিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে একটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছে এবং বিস্তারিত সংস্কার রোডম্যাপ প্রকাশের অঙ্গীকার করেছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইউনিটের ক্ষমতাকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করাও অত্যন্ত বাঞ্ছনীয়। বিশেষ করে যেসব জায়গায় বড় আকারের দুর্নীতি ও অর্থের অনৈতিক লেনদেন হয়েছে, সেসব জায়গায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন সংস্থার কাজের সমন্বয়ের প্রয়োজন।

ব্যাংক খাতের অন্যতম সমস্যা হলো ক্ষমতা ও স্বাধীনতা প্রয়োগে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চ্যালেঞ্জ। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক বাধায় পর্যুদস্ত। এর নীতি ও কার্যক্রমে স্বায়ত্তশাসন পদে পদে বাধাগ্রস্ত। বাস্তবে এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ছায়াতলে থেকেই কাজ করে। আইনগত ম্যান্ডেটের বাইরে সরকারের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপও বাংলাদেশের ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার ভূমিকাকে সীমিত করেছে। ১৯৯১ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইন বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দিলেও অর্থ মন্ত্রণালয় তাদের নিজস্ব ব্যাংকিং বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই স্বাধীনতা খর্ব করেছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক এবং কিছু আইনগত ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকে, যেখানে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিদেশি ব্যাংক ও অ-বাংলাদেশ ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এই দ্বৈত ব্যবস্থা সরকারনিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোর জন্য অসমন্বিত এবং প্রায়ই দুর্বল নীতিব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে, যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্কতা ও ব্যবস্থাপনা মান প্রয়োগে গুরুতর বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। সরকারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক অনুমোদনপ্রক্রিয়া পাশ কাটানোর প্রবণতা যথেষ্ট বিস্তৃত। প্রায়ই তা অর্থনৈতিক নীতি, সরকারের কাছে ঋণদান এবং অদক্ষ ব্যাংকগুলোর বিশেষ তত্ত্বাবধান বা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ মোকাবিলা করার মতো গভর্ন্যান্সের মতো বিষয় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর করপোরেট গভর্ন্যান্স অপর্যাপ্ত। এই ব্যাংকগুলো প্রায়ই একটি ক্ষুদ্র প্রভাবশালী শেয়ারহোল্ডারদের নিয়ন্ত্রিত সংস্থা হিসেবে কাজ করে। অভ্যন্তরীণ ঋণদান এবং রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত সংযোগে পরিচালিত ক্রস-লেন্ডিং এই ব্যাংকগুলোর সমস্যা বাড়িয়ে তোলে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিদেশি মুদ্রাবাজারকে স্থিতিশীল করতে অন্তর্বর্তী সরকার ক্রলিং পেগের সীমা ১ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সমন্বয় মুদ্রাবিনিময় হারগুলোর অতিরিক্ত অস্থিরতা কমানোর দিকে লক্ষ রাখে, যা ব্যবসা ও বিনিয়োগকারীদের আরও কার্যকরভাবে পরিকল্পনা করতে সাহায্য করবে এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা সমর্থন করবে। উন্নয়নশীল ও উদীয়মান দেশগুলোর মধ্যে মার্কিন ডলার বা ইউরোর সঙ্গে মুদ্রা স্থির করার প্রথা প্রচলিত রয়েছে। তবে এই পদ্ধতি সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে সংকট তৈরি করতে পারে। ১৯৯৭ সালে পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকটের মতো ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা মুদ্রা পেগ করার ঝুঁকি প্রমাণ করে। তাই বাংলাদেশের আদর্শ ব্যবস্থা হবে ভাসমান বিনিময় হারের লক্ষ্য রেখে এই ব্যবস্থা একটি অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ হিসেবে রাখা।

লুবাবা মাহজাবিন

বাংলাদেশ বর্তমানে বাড়তে থাকা মুদ্রাস্ফীতি এবং কমতে থাকা বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের সঙ্গে সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা টাকাকে ডলারের বিপরীতে দুর্বল করেছে এবং আন্তর্জাতিক রেমিট্যান্স ও রপ্তানিপ্রবাহে লক্ষণীয় হ্রাস দেখা গেছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগষ্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বরে ১৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এই হ্রাস ডলারের সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ব্যবধান বাড়িয়ে দিয়েছে, যা ডলারের দাম বাড়ানোর চাপ তৈরি করছে। আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের জন্য সরকারি বিনিময় হারগুলো পরিবর্তিত হয়েছে। অপর দিকে রেমিটাররা প্রণোদনা হার পেলেও একাধিক হারের সঙ্গে অসংগতি বিদ্যমান।

এই সমস্যাগুলো মোকাবিলার জন্য সঠিক ও টার্গেট–সংবলিত মুদ্রানীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের মুদ্রানীতি মুদ্রাস্ফীতিকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। তবে সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো, যেমন পলিসি হার শূণ্য দশমিক ৭৫ শতাংশ পয়েন্ট বৃদ্ধি করে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার ফলে ঋণ গ্রহণের ব্যয় বাড়ে এবং সেভিং বাড়াতে উৎসাহিত করে, যা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য রাখে। পদক্ষেপটি অগ্রগতি নির্দেশ করলেও মুদ্রাস্ফীতির পুরো চাপ মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট না–ও হতে পারে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক ৬–৯ সুদের নীতি থেকে ট্রেজারি বিলের গড়ের সঙ্গে সংযুক্ত পরিবর্তনশীল সুদের নীতিতে স্থানান্তর হওয়ার সিদ্ধান্ত তারল্য কমানো ও সঞ্চয় উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে নেওয়া। তবে এই নীতি পরিবর্তন একাই মুদ্রাস্ফীতি প্রতিরোধের জন্য যথেষ্ট না–ও হতে পারে। কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোকে সমর্থন করা অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যবসাগুলোর ওপর এই সিদ্ধান্তের অসমান প্রভাব কমানোর জন্য অতিরিক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রয়োজন হতে পারে।

ব্যাংক খাতের সংস্কারের লক্ষ্যে গভর্ন্যান্স সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে হবে এবং ব্যাংক কোম্পানি আইনের (বিসিএ) পরিবর্তনগুলো রাজনীতির বদলে অর্থনীতির ভিত্তিতে করতে হবে। ঋণ অনুমোদন, পরিচালক নির্বাচন, খেলাপিদের জরিমানা ও নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পর্কিত আইনের ত্রুটিগুলো সংশোধন করা প্রয়োজন। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন অপকর্ম মোকাবিলা এবং উন্নত তত্ত্বাবধান ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর নীতিমালা তৈরি করতে হবে।

মুদ্রানীতির পাশাপাশি বিনিময় হার এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উন্নত করতে আরও অগ্রসরমাণ মুদ্রাব্যবস্থা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বৈচিত্র্য বাড়ানো প্রয়োজন। সামাজিক প্রণোদনার মাধ্যমে বৈধ রেমিট্যান্স চ্যানেলগুলো উন্নত করার চেষ্টা এবং অর্থ পাচার–সম্পর্কিত সমস্যাগুলো সমাধান করার প্রয়াস প্রয়োজন। স্থির সুদের হার নীতির পরিবর্তে পরিবর্তনশীল হার পদ্ধতির দিকে অগ্রসর হওয়া একটি ইতিবাচক উন্নয়ন। তবে মুদ্রাস্ফীতি কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলোর যথাযথ সহায়তা নিশ্চিত করতে আরও পদক্ষেপের প্রয়োজন।

অভিগম্যতার দিক থেকে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে সাফল্য দৃশ্যমান হলেও প্রকৃতপক্ষে অর্থনৈতিক বিভাজন ও লিঙ্গবৈষম্য এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে বাংলাদেশে সুবিন্যস্ত সামাজিক সুরক্ষা খাত না থাকায় অধিকাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ আর্থিক খাতের বাইরে অবস্থান করে। আর্থিক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বৈরী অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করার সক্ষমতা দেয়। তাই সর্বস্তরে এর বিস্তারের লক্ষ্যে আশু হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

ব্যাংক খাতের সংস্কারের সফল বাস্তবায়ন, বিশেষত কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ও অদক্ষতা মোকাবিলা করা এবং প্রস্তাবিত ব্যাংক কমিশনের নেতৃত্বে ব্যাংক খাতের কার্যকর ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশকে একটি স্থিতিশীল ও সক্ষম ব্যাংকিং খাতের দিকে এগিয়ে নিতে পারে।

* লুবাবা মাহজাবিন: সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব ইকনোমিক মডেলিং–এর (সানেম) গবেষণা সহকারী