কর্মীর লেখা

অসহায়ত্বের সেই ৬০ ঘণ্টা

প্রথম আলোর ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মীদের কাছে লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাঁরা লিখেছেন প্রথম আলোকে নিয়েই। কর্মীদের নির্বাচিত কিছু লেখা নিয়েই এ আয়োজন।

‘সুনামগঞ্জে দাঁড়ানোর মাটি নেই’। ২০০৪ সালের মধ্য জুলাইয়ে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় এ রকম একটা শিরোনাম ছিল। ১৮ বছর পর ভয়ার্ত এক অন্ধকার রাতে ভাবছিলাম, পরদিন এই একই শিরোনামে প্রথম আলোতে আমাকে নিউজ পাঠাতে হবে কি না। কিন্তু পরিস্থিতি যা হলো, সেটি ছিল আরও ভয়াবহ। সুনামগঞ্জের মানুষ শত বছরেও এমন বন্যা দেখেনি। প্রথম আলোতে আছি ১৭ বছর। কিন্তু এমন অসহায়ত্বের শিকার হইনি কখনো। ২০২২ সালের মধ্য জুনের এই বন্যায় যেমনটা হয়েছিলাম। ‘বিচ্ছিন্ন’ থাকা যে কতটা যন্ত্রণার, সেটা তখন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই, বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল-ইন্টারনেট বন্ধ। চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ঘরবন্দী সময় গেছে। এখনো সেই ‘৬০ ঘণ্টা’ আমাকে ভাবায়, জাগায়।

১৬ জুন, ২০২২। বেলা করে শহরে বেরিয়েছি। রাতে বৃষ্টি হয়েছে। কাজীর পয়েন্টে পানি জমেছে। এটাতে মনে ধরেনি। কিন্তু উকিলপাড়ায় সড়কে পানি দেখে ভাবি, বন্যা তাহলে হয়েই গেল। আগের দিন পানি বাড়ছে, এমন রিপোর্ট দিয়েছি। থানার উত্তরের সড়কে হালকা পানি দেখলাম। ময়লা পানি। সুরমা নদীর তীর উপচে এল, নাকি বৃষ্টির বুঝতে পারিনি। অফিসে ঢুকে বন্যা পরিস্থিতি বোঝার জন্য নানা জায়গায় ফোন করি। এর মধ্যেই ভারী বৃষ্টি শুরু হয়। যেন আকাশ ভেঙে পড়ছে। অনলাইনের জন্য একাধিক রিপোর্ট পাঠালাম। বিকেলে কাগজের জন্য একটি রিপোর্ট দিয়ে যখন পৌর বিপণির দোতলা থেকে নামি, তখন সন্ধ্যা হয় হয়। প্রবল বর্ষণ, বজ্রপাত থামছেই না। পৌর বিপণিতে ২০০৪ সালে সামান্য পানি উঠেছিল। এখন তার চেয়ে বেশি। বিদ্যুৎ চলে গেছে। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখি, সর্বনাশ! মোবাইলে চার্জ নেই। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রিকশা মিলছে না। মানুষ ছুটছে বাড়িঘরে। আমি মূল সড়কে তাকিয়ে দেখি, পানি শহরের ‘নাভিমূল’ আলফাত স্কয়ার ছুঁয়েছে।

বৃষ্টির জন্য মোটরসাইকেল আনিনি। কীভাবে ফিরব। অটোরিকশা, রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আটটা বেজে যায়। মানুষ যে যেভাবে পারছে, বাড়ি ফিরছে। একপর্যায়ে একটি ভাঙা ছাতা নিয়েই বাড়ির পথ ধরি। রাস্তায় কোথাও হাঁটু, আবার কোথাও কোমরসমান পানি। মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে শুরু করেছে। সড়কে সুরমা নদীর প্রবল স্রোত। স্রোত ঠেলে হেঁটে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ১০টা। বাড়ির সামনের সড়কে পানি চলে এসেছে। ঘরবন্দী আমি। একটি মোবাইল বন্ধ। অন্যটিতে সামান্য চার্জ আছে। আমি তুহিন ভাইকে (বিশাল বাংলার বিভাগীয় সম্পাদক) মেসেজ পাঠাই। বন্যার বিষয় জানিয়ে বলি, পরিস্থিতি ভালো না। রাস্তাঘাট সব তলিয়ে গেছে। তবুও কাল অফিসে যাওয়ার চেষ্টা করব। ফেসবুকে অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে জানিয়ে সুনামগঞ্জকে প্রার্থনায় রাখার একটা পোস্ট দিই। সকালে যাতে কথা বলতে পারি—এ জন্য মোবাইল বন্ধ করে রাখি।

রাত বাড়ে, সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। একসময় উঠানে চলে আসে। দিবাগত রাত ১২টায় এলাকার আত্মীয় কয়েকটি পরিবার নৌকা নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আসেন। সবাই দুশ্চিন্তায়। রাত ভয়ংকর হচ্ছে। চারটার দিকে ঘরে পানি প্রবেশ করে। ঘরের নারী-শিশুরা দুই তলায় আশ্রয় নেন। রাস্তায় আসার পথে কোমরসমান পানি ভেঙে, বৃষ্টি-বজ্রপাত মাথায় নিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে চলা সেই নারী-শিশুদের কথা ভাবতে ভাবতে ভোর হয়।

১৭ জুন ২০২২। ভোরে নেই ভোরের আলো। আছে অন্ধকার। তখনো তুমুল বৃষ্টি, মুহুর্মুহু বজ্রপাত। যেন ঘরের ওপরে, বারান্দায় পড়ছে। জানালার থরথর করে কাঁপছে। সুনামগঞ্জ বিশ্বের সবচেয়ে বজ্রপাতপ্রবণ জেলার যে তকমা পেয়েছে, সেটি নিয়ে আর কোনো সন্দেহ রইল না। যে মোবাইলে কিছু চার্জ ছিল, সেটি হাতে নিয়ে দেখি নেট নাই। অস্থির লাগছে। কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। ঘরে পানি, উঠানে কোমরসমান পানি, রাস্তায় সাঁতার। এর মধ্যেই তুহিন ভাইয়ের একটি খুদে বার্তা, ‘কী খবর, আপনারে তো পাইতাছি না’। আমি সব জানিয়ে ফিরতি বার্তা দিই। কিন্তু তিনি সেটা পেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না। সুনামগঞ্জের আসল অবস্থা কী, মানুষ কেমন আছে। এই খবর আমার লেখার কথা। অথচ আমি নিজেই কিছু জানি না। আমি বিচ্ছিন্ন। একা। ঘরবন্দী।

সিলেটের সহকর্মী সুমনকুমার দাশকে একটা বার্তা দিই। বলি, নিউজ সিলেট থেকে করতে হবে।’ আমি বারবার মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখি। ফিরতি বার্তার অপেক্ষায় থাকি। একসময় বার্তা আসে-‘অফিস পরিস্থিতি জানে। সাবধানে থাইকেন।’ তখন সকাল নয়টা হবে। এরপর এই মোবাইলও বন্ধ হয়ে যায়। আমি এখন পুরোপুরি অকর্মা। ঘরভর্তি মানুষ। আমি একা এক কোনায় বসে আছি। বউ সান্ত্বনা দেয় ‘তোমার অবস্থা তো অফিস জানে, তাহলে এত টেনশন করছ কেন।’ আমার কষ্ট তাকে বোঝাতে পারছি না। চিৎকার করে কাঁদছে ইচ্ছা করছে। আমি সুনামগঞ্জের খবর জানি না। শহরে কী ঘটছে জানতে পারছি না। কাউকে জানাতে পারছি না। এ রকম অস্থিরতায়, হতাশায় দিন যায়। আবার রাত আসে। গত রাত ছিলাম মোমবাতির আলোয়। আজ মোমবাতি কম। আলোও কম। ঘুম আসে না। কখন ভোর হবে এই চিন্তায়।

বন্যার পানিতে খামার থেকে মাছ ভেসে গেছে। ব্যাপক ক্ষতির মুখে খামারের মালিকেরা। ৬ জুলাই সুনামগঞ্জ সদরের বুড়িস্থল এলাকা থেকে তোলা

১৮ জুন ২০২২। ঘরে এত এত মানুষ। খাবার পানি নেই। বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে খাওয়া হচ্ছে। আকাশের কান্না থামছে না। পানি বাড়ছে। তবে কিছুটা ধীরে। যেন আগের দুই দিনের গোস্‌সা কিছুটা কমেছে। আজও কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। খাটের ওপর গা এলিয়ে আছি। আমার কোনো কাজ নেই। তবে চিন্তা আছে। কান্না পাচ্ছে। শহরের কতশত মুখ চোখে ভাসে। কে কোথায়, কীভাবে আছে। কারও কোনো ক্ষতি হয়নি তো। আচ্ছা ইন্টারনেট সেবা কেন বন্ধ হলো। অন্য কোনো বিকল্প উপায়ে কি যোগাযোগ করা যায় না। বিকেলে বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। আমার একটা নৌকা চাই। আমি বের হবই। অবশেষে আমার এক ছোট ভাই পাড়ায় খোঁজ করে প্রায় সাঁতরে গিয়ে একটি নৌকা জোগাড় করে নিয়ে এসেছে। আমি বের হলাম। যেদিকে যাই, শুধু পানি আর পানি। মানুষের বাড়িগুলো সুনসান। একতলা বাড়ির কোনোটিতেই মানুষ থাকার অবস্থা নেই। নৌকায় করে মানুষজন এখানে-ওখানে যাচ্ছে। একে অপরের খোঁজ নিচ্ছে। আমি লজ্জা পাচ্ছি। এই দুই দিন আমি ঘরে ছিলাম। আহা, মানুষের কত কষ্ট। বৃষ্টি কমায় মানুষজন দুই দিন পর বাড়ির ছাদে উঠেছে। নারী-শিশুরা বাড়ি ছাদ থেকে যত দূর চাখ যায় পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। আমি সোজা গেলাম সহকর্মী এ আর জুয়েলের বাসায়। বাসায় নৌকা ভিড়িয়ে ডাকাডাকি শুরু করি। কিন্তু তার খোঁজ নেই। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর খোঁজ মিলল পাশের বাসার তিনতলায়। বন্যার্ত হিসেবে সেখানে ‘আশ্রয়’ নিয়েছে। সে জানাল, সবার অবস্থা এক। কেউই কাজ করতে পারেনি। সুনামগঞ্জ দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন। অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। মানুষ এমনভাবে কুশল জানতে চায় যেন কতকাল পর দেখা। আহা জীবন। নৌকার মাঝির বাড়ি ফেরার তারা। তাই আর শহরের ভেতর দিয়ে যাওয়া হলো না। আমার ইচ্ছা করছে আমি সাঁতরে পুরো শহর ঘুরে আসি। মানুষদের দুঃখ–দুর্দশা দেখে আসি। সেটি হয় না। আবার ঘরে ফিরি। রাত হয়। আলোহীন, ঘুটঘুটে কালো এই রাত বড় লম্বা।

১৯ জুন ২০২২। আজকের সকালটা একটু ফরসা। বৃষ্টি নেই আবার রোদও নেই। দুই দিনের অঘুমা থাকায় ঘুম ভেঙেছে দেরিতে। দুপুরের পর প্রতিবেশী এক ভাগিনা আসে। সে বিদ্যুৎ মিস্ত্রির কাজ করে। সে নাকি সৌরবিদ্যুতের প্যানেলে ইনোভেটর দিয়ে মোবাইলে চার্জ দিতে পারবে। আমার অবস্থা দেখে সে এটি কোথায় থেকে জোগাড় করে নিয়ে এসেছে। ঘণ্টাখানেক পর আমি মোবাইল নিয়ে তিনতলার ছাদে উঠি। চেষ্টা করি, কিন্তু কারও সঙ্গেই সংযোগ হয় না। ছাদে দাঁড়িয়ে চারপাশটা দেখি। সময় যায়। হঠাৎ হোয়াটসঅ্যাপে একটা বার্তা ঢুকে। তুহিন ভাই লিখেছেন, ‘খলিল কোথায় আছেন, কেমন আছেন? সুযোগ হলে জানাবেন।’ আমি চমকে উঠি, তাহলে নেটে কাজ করছে।

আমি তুহিন ভাইকে ফোন দিই, অফিসের নম্বরে ফোন করি। ফোন যায় না। মনের দুঃখে হোয়াটসঅ্যাপ লিখতে বসি। গতকাল সড়কে বের হয়ে যা যা দেখলাম। বাড়ির পাশে যা দেখছি, তা-ই। এরপর আমাদের অফিশিয়াল গ্রুপে সেন্ট করি। গেল না মনে হয়। আমি বসে আছি কারও কোনো সাড়া পাই কি-না। হঠাৎ ইনবক্সে ঢাকা অফিস থেকে হাসনাত ভাইয়ের বার্তা, ‘স্টোরি পেয়েছি। ফোন করার দরকার নাই। মেসেঞ্জারেই কথা বলব।’ তিনি এভাবেই কথা বলছেন। আমার কী আনন্দ। প্রায় ৬০ ঘণ্টা বিচ্ছিন্ন ছিলাম। যা–ই পারি, লিখছি। সেন্ট করছি। বড় ভালো লাগছে। আমি তিনতলার ছাদ থেকে নামি না। সিলেট থেকে উজ্জ্বল মেহেদীর ফোন। ধরেই ‘ভালো আছি’ বলার সঙ্গে সঙ্গে সংযোগ কেটে যায়। লন্ডন থেকে এক ছোট ভাইয়ের মেসেজে দেখে চোখে জল আসে, সে লিখেছে ‘বড় ভাই, তিন দিন ধরে আব্বা-আম্মার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না। উনারা বাসায় একা। দয়া করে একটু খবর নিয়ে জানান।’ আমি লিখে দিই ‘চিন্তা করো না, চাচা-চাচি ভালো আছেন’। সে লেখে ‘আলহামদুলিল্লাহ’। আমি ছাদেই আছি। আমার ছোট ভাই সিলেট থেকে ফোন দিয়েছে। তিন দিন বাড়ির কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। ফোন ধরতেই গলা কেঁপে ওঠে আমার। কথা খুব একটা বলতে পারছি না, গাল বেয়ে অশ্রু ঝরছে...।
খলিল রহমান
নিজস্ব প্রতিবেদক, সুনামগঞ্জ
প্রথম আলো