অর্থনীতি

মূল্যস্ফীতি থেকে স্বস্তি কীভাবে

সেলিম রায়হান
সেলিম রায়হান

অর্থনীতির ওপর কোভিড মহামারির প্রভাব আমরা যখন ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছি, তখন বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে স্থানীয় বাজারে দ্রব্যমূল্যের অস্থিতিশীলতা সাধারণ মানুষের জীবনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। বিশ্বব্যাংক ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছে। বাংলাদেশে খাদ্য মজুত বিবেচনা করলে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা হয়তোবা নেই, কিন্তু খাদ্যপণ্যের মূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং তার বিপরীতে সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ার ফলে প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহে সাধারণ মানুষের সক্ষমতার ওপর বড় চাপের সৃষ্টি হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে।

গত ১১ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি এখন সবচেয়ে বেশি। মূল্যস্ফীতি মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দেয়। কমে যায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে শুধু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নয়, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও অনেক চাপে আছেন। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন ও সীমিত আয়ের জনগোষ্ঠী এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের দুর্দশা বেড়েই চলেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিপরীতে আয় অথবা মজুরি সেভাবে বৃদ্ধি না পাওয়ায় অধিকাংশ মানুষই অনিশ্চিত পরিস্থিতির সম্মুখীন। অনেক মানুষ তাঁদের দৈনন্দিন খরচ মেটাতে সঞ্চয় বা ঋণের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছেন, যার সুযোগ অনেকের জন্যই আবার সীমিত।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন ও সীমিত আয়ের জনগোষ্ঠীর দুর্দশা বেড়েই চলেছে

সাধারণ মানুষ নিজেদের মতো করে মানিয়ে নিচ্ছেন। নানাভাবে নিজেদের খরচ কাটছাঁট করছেন। যিনি খাদ্য ছাড়া অন্যান্য পণ্যে বা সেবায় তেমন খরচ করেন না, তিনি খাদ্যের ক্ষেত্রে নানা কাটছাঁট করছেন, কম মূল্যের খাদ্য কিনছেন, কম পুষ্টিকর খাদ্য কিনছেন। যেহেতু প্রোটিনজাতীয় খাবারের দাম বেশি, সেগুলো খাওয়া কমিয়ে কার্বোহাইড্রেট বা ভাত বেশি খাচ্ছেন। খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারায় এই হঠাৎ পরিবর্তনের প্রভাব প্রজন্মান্তরে পড়তে পারে, এতে ভবিষ্যতে উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
দীর্ঘ মেয়াদে দেশে পুষ্টিহীন প্রজন্ম তৈরির
ঝুঁকি বাড়ে। 

অন্যদিকে যাঁরা মধ্যবিত্ত, তাঁরা হয়তো শিক্ষা, সেবা বা বিনোদনের পেছনে খরচ কমাচ্ছেন। এগুলোরও এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে প্রভাব পড়ে। করোনা মহামারির সময় আমরা এমন ঘটতে দেখেছি। আর বর্তমানে মূল্যস্ফীতির কারণে একই ধরনের ঘটনা ঘটছে। এতে করে সামগ্রিকভাবে আমাদের সমাজ ও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

মূল্যস্ফীতি প্রান্তিক মানুষের জন্য ‘নিষ্ঠুরতম কর’। আমাদের বিশ্লেষণ দেখায় যে সরকারিভাবে ঘোষিত মূল্যস্ফীতির চেয়ে দেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অনেক বেশি হারে মূল্যস্ফীতির সম্মুখীন হয়। এই সময় সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি ৯ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ, তার মানে, প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের জন্য মূল্যস্ফীতি আরও অনেক বেশি। খাদ্যপণ্যের পেছনেই প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের আয়ের একটা বড় অংশ ব্যয় হয়। এ পরিস্থিতিতে তাঁরা খুব কষ্টে আছেন। মূল্যস্ফীতির সরকারি হিসাবটিকে সঠিক হিসেবে ধরলেও তা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এখন বড় উদ্বেগের। সার্বিক বিবেচনায় মনে হয়, মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতির শিগগিরই উন্নতির সম্ভাবনা কম। 

বিবিএস পুরোনো ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হিসাব করছে, যা বর্তমান সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মূল্যস্ফীতির সঠিক হিসাব না করা হলে সরকার প্রকৃত বাস্তবতা আমলে নিতে ব্যর্থ হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ নিরসনে সঠিক সময়ে সঠিক উদ্যোগ নেওয়া কঠিন হয়ে যায়।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে কয়েকটি কারণ রয়েছে। এগুলো হলো বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যসহ অনেক পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দেশের বাজারে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতা, পরিবহন খরচ ও বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হারের ঊর্ধ্বগতি, অসাধু ব্যবসায়ী কর্তৃক সরবরাহ ঘাটতির সুযোগ নেওয়া ও অযাচিতভাবে দাম বাড়ানো এবং বাজারের দুর্বল তদারকি ব্যবস্থা। 

তাই বাজারে পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। বিকল্প আমদানির উৎস খোঁজার চেষ্টা করতে হবে। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ঠেকাতে বাজার মনিটরিং জোরদার করা প্রয়োজন। পাশাপাশি খাদ্যে ভর্তুকি বাড়ানো প্রয়োজন।

দরিদ্র মানুষের জন্য সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোর পরিসর বাড়ানো দরকার। যেমন এক কোটি পরিবারকে সহায়তা করার যে প্রকল্পের কথা বলা হচ্ছে, সেটা খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এক মাসে যে পরিমাণ সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে, সেটা প্রয়োজনের তুলনায় কম। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এই কর্মসূচির আওতাভুক্ত পরিবারের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বাস্তবায়ন খুবই চ্যালেঞ্জিং। আমরা দেখেছি, করোনা মহামারির সময় ৫০ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু তালিকাভুক্তির ভুল এবং অন্যান্য সমস্যার কারণে একটা বড় অংশকে সহযোগিতা করা যায়নি। কম বরাদ্দ, মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং সহায়তা পাওয়ার যোগ্যদের সবাই সহায়তা না পাওয়া হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষা খাতে প্রধান সমস্যাগুলো।

বিগত কয়েক মাসে চাল, গম, মাছ, মাংস, ডিম ও ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম দ্রুত বেড়েছে। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এটি মোকাবিলায় সরকারকে চাহিদা ও সরবরাহ উভয় দিকেই নজরদারি বাড়াতে হবে। সরকারকে
অবশ্যই সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। কোনো সন্দেহ নেই যে এটি একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ।

খাদ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের সরবরাহ অনেকখানি আমদানির ওপর নির্ভরশীল এবং প্রায়ই এই সব পণ্যের দাম সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এর সমাধানে সরকারকে ভাবতে হবে সাময়িকভাবে আমদানি শুল্ক আরও কমিয়ে আমদানি করা খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানোর কোনো সুযোগ আছে কি না। বিদ্যমান সরবরাহ ব্যবস্থাপনার কার্যকারিতা নিশ্চিত করা তাই জরুরি হয়ে পড়েছে। সরবরাহ ব্যবস্থাপনার অকার্যকারিতা ও অদক্ষতার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই আমদানি খরচ বেড়ে যায়।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)–এর নির্বাহী পরিচালক