শূন্য ভবনের সন্ধানে

২০১৯ সালে নির্মাণ শেষ হওয়ার পর দুই বছর ধরে অব্যবহৃত পড়ে আছে দৃষ্টিনন্দন ডাক ভবনটি। সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে
প্রথম আলো

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল এক দশক আগে। তখন তিনি সিনিয়র সহকারী সচিব (এখন তিনি যুগ্ম সচিব)। ২০২১ সালের শুরুর দিকের ঘটনা। একদিন তাঁর রুমে গেলাম। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা শেষে বললেন, ‘নিউজের একটা ক্লু দিতে পারি। বের করার দায়িত্ব আপনার।’ সানন্দে রাজি হলাম।

এতটুকুই কেবল বললেন যে আগারগাঁওয়ে ডাক বিভাগের জন্য নির্মিত একটি সুন্দর ভবন অনেক দিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। চালু হওয়া নিয়ে কোনো একটা ঝামেলা চলছে। ওই ভবনটি নিয়ে একটি মিটিংয়ে আলোচনার সময় তিনি এমনটাই শুনেছেন। 

এরপর শুরু হলো অনুসন্ধান। ভবনটি পড়ে থাকা নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে খবর নিলাম। কিন্তু কারও কাছ থেকে সহযোগিতা পেলাম না। আরেক দিন  আগারগাঁওয়ে ভবনের ভেতরে ঢুকতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মীদের কড়া নজরদারির কারণে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হলো। এরপর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের এক কর্মকর্তার সহযোগিতা নিয়ে ছুটির দিন গেলাম গুলিস্তানে ডাক বিভাগের সদর দপ্তরে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডাক বিভাগের ওই কর্মকর্তা সব খুলে বললেন। আরও জানালেন, ডাক ভবনের পেছনে আরেকটি ভবন খালি পড়ে আছে। ডাক ভবনে গিয়ে সত্যি সত্যি দেখা গেল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য নির্মিত ১৩তলা ভবন দীর্ঘদিন ধরে খালি পড়ে আছে। দুটি ভবন নিয়ে সব তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করে ২০২১ সালের ৩ এপ্রিল প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ‘অপচয়ের উদাহরণ দুই ভবন’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি  প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন প্রকাশের প্রায় দুই মাস পর গত বছরের ২৭ মে ডাক ভবনটির উদ্বোধন করা হয়।

প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার দিনই এক অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন পেলাম। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে কর্মরত আছেন জানিয়ে তিনি জানালেন, আরেকজনের কাছ থেকে নম্বর সংগ্রহ করে ফোন দিয়েছেন। তারপর জানালেন, মিরপুর ১০ নম্বরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের জন্য নির্মিত পাঁচতলা একটি হাসপাতাল দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে। সেখানকার এক সোর্সের নম্বর দিয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললেন তিনি।  

ওই সোর্সের সঙ্গে কথা বলে একদিন কৌশলে ঢুকে পড়লাম সেই পাঁচতলা ভবনে। হাসপাতালের ভেতরে পড়ে থাকা যন্ত্রপাতির ছবি ও ভিডিও করে নিলাম। এরপর বিভিন্ন দপ্তরে খোঁজখবর নিয়ে গত বছরের ৭ জুলাই ‘২৪ কোটি টাকার হাসপাতাল হয়ে গেছে অফিস’ শিরোনামের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

 এর কিছুদিন পর এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। যিনি এখন অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) আছেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি মিরপুর ১৪ নম্বরে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের জন্য তৈরি করা একটি ভবন একইভাবে পড়ে থাকার কথা জানিয়ে এক সোর্সের সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দেন।

একদিন চলে গেলাম মিরপুর ১৪ নম্বরে। সরেজমিন পরিদর্শন শেষে বিভিন্ন দপ্তরে খবর নিয়ে গত বছরের ১৪ আগস্ট ‘দুই প্রতিষ্ঠানের টানাপোড়েনে বন্দী প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।

দীর্ঘদিনের পরিচিত এক কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে গেলাম এ বছর এপ্রিলে। কথপোকথনের একপর্যায়ে প্রতিটি উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বানানো তিনতলা ভবন অব্যবহৃত পড়ে থাকার কথা জানালেন তিনি। তার কথার সূত্র ধরে একদিন চলে গেলাম ঢাকার পাশে মুন্সিগঞ্জ জেলায়। একদিনে চারটি উপজেলা ঘুরে ওই কর্মকর্তার কথার সত্যতা পাওয়া গেল। দেশের অন্য জেলায় খবর নিয়ে একই তথ্য জানা গেল। সব পক্ষের বক্তব্য নিয়ে গত ৫ জুন ‘৪০৬টি উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন পড়ে আছে’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। 

এভাবেই দীর্ঘদিনের পরিচিত এক কর্মকর্তার সহযোগিতায় পুরান ঢাকার জনসন রোডে অবস্থিত ঢাকা জেলা পরিষদের অব্যবহৃত পড়ে থাকা ভবনটি নিয়ে প্রতিবেদন করা হয়। ‘বিপুল ব্যয়ের ভবনটি খালি পড়ে আছে; নথি গায়েব’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি গত ১২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়। আরেক সোর্স থেকে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে গত ৩ অক্টোবর ছাপা হয় ‘ঝকঝকে ভবনের ভেতরে শূন্যতা’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন। রাজধানীর বেইলি রোডে ১৯৪ কোটি টাকা ব্যয়ে পাবর্ত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স ভবনটিও চার বছর ধরে খালি পড়ে আছে। গত ১৩ অক্টোবর প্রকাশিত হয় আরেকটি প্রতিবেদন ‘বিপুল ব্যয়ের ভবন কাজে লাগে না’ শিরোনামে। যেখানে আরও কয়েকটি পড়ে থাকা খালি ভবনের চিত্র তুলে ধরা হয়। জনগণের করের টাকায় নির্মিত এমন অনেক পড়ে থাকা খালি ভবনের খবর প্রতিনিয়তই প্রতিবেদকের কাছে আসছে। ভবন নিয়ে টানা প্রতিবেদন প্রকাশের পর সহকর্মীদের কাছ থেকে ‘ভবন বিটের’ যাত্রা শুরু করার দাবিও উঠেছে।

আরিফুর রহমান: জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, প্রথম আলো