মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল সম্পদে অপ্রতুল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসেবে। কিন্তু নিন্দুকদের আশঙ্কা অসত্য প্রমাণ করে একের পর এক বাধা পেরিয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। এই এগিয়ে যাওয়ার পথ রচিত হয়েছিল কিছু অভূতপূর্ব ঘটনা, অভিনব ভাবনা, ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনা ও উদ্যোগে। আমরা ফিরে দেখছি বাংলাদেশের উজ্জ্বল সেসব মুহূর্ত।
বাংলাদেশের কৃষি খাতের সাফল্যের পেছনের নায়ক কে? এর উত্তর দেওয়ার সময় সামষ্টিক চেষ্টা ও ঐতিহাসিক ঘটনাচক্রের প্রভাব অস্বীকার করার প্রবণতা আছে। বাংলাদেশের মতো এত ছোট একটি দেশে এত বিপুল মানুষের প্রধান খাদ্যের বড় অংশ দেশের ভেতরে উৎপাদিত হচ্ছে, এটা অনেক বড় ঘটনা। কিন্তু এই অর্জনের পেছনে এককভাবে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা আবিষ্কারকের নাম উল্লেখ করতে চাই না।
অবশ্যই আমাদের কৃষকদের অবদান এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞানীদের চেষ্টা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় ভূমিকা আছে। কিন্তু তাঁদের ওই ভূমিকা নেওয়ার পেছনে আমাদের এই অঞ্চলে ঘটে যাওয়া তিনটি দুঃসহ স্মৃতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে (পঞ্চাশের মন্বন্তর) বাংলা অঞ্চলসহ ভারতবর্ষের প্রায় ৪০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনা এই পুরো অঞ্চলের মানুষকে বড় ধরনের ধাক্কা দেয়। খাদ্যের কারণে এত বিপুল মানুষের মৃত্যুর দুঃসহ স্মৃতি তাদেরকে সবুজ বিপ্লবের দিকে টেনে নেয়। সবার আগে মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে হবে, এ জন্য যেকোনো মূল্যে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। ষাটের দশকে উন্নত বীজ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারের মাধ্যমে নেওয়া ওই উদ্যোগ তখন ভারতের অনেক অঞ্চলে সফল হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সবুজ বিপ্লবের ছোঁয়া লাগে। আমরা ঐতিহ্যগত কৃষি থেকে আধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষির সঙ্গে পরিচিত হই। আমাদের কৃষিতে উৎপাদনের ইতিবাচক পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে শুরু করে। ১৯৬৫ সালে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) বাংলাদেশে আধুনিক জাতের ধান চাষ শুরু করে। বাংলাদেশের স্থানীয় জাতের চেয়ে বেশি ফলন হওয়ায় তা জনপ্রিয় হতে শুরু করে।
এরপর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কৃষিতে জোর দেয়। একের পর এক কৃষিবিষয়ক গবেষণা–প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। আধুনিক কৃষি গবেষণার নিত্যনতুন দুয়ার খুলতে থাকে। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের কৃষি ঘুরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ আমাদের এই জনপদে হানা দেয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডাল–ভাত নিশ্চিত করার বিষয়টির গুরুত্ব বাড়তে থাকে। বিশ্বজুড়ে কৃষি গবেষণার যেসব অগ্রগতি সে সময় হয়েছিল, তা বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদেরও প্রভাবিত করে। উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের ধান ও ফসলের চাষ বাড়তে থাকে।
আশি ও নব্বইয়ের দশক ছিল বাংলাদেশের কৃষির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। আমাদের আজকের কৃষির যেসব অর্জন আমরা উদ্যাপন করছি, তা মূলত দেশে কৃষিযন্ত্র এবং উপকরণকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে। এর আগপর্যন্ত বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের হাতে দেশের সেচপাম্প, সার, কীটনাশক ও বীজের নিয়ন্ত্রণ ছিল। এই সরকারি সংস্থাটি এসব কৃষি উপকরণ উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাত করত। তাদের নির্ধারিত ডিলার এবং প্রতিনিধিদের ছাড়া এসব উপকরণ পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আশির দশকে তা বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে বাজারে আনার সুযোগ দেওয়া হয়। প্রথম চীনের তৈরি লো লিফট পাম্প ও শ্যালো মেশিন বাংলাদেশের বাজারে সহজলভ্য হয়ে ওঠে। কৃষকেরা ওসব যন্ত্র দিয়ে পানি তোলা, ভ্যান চালানো, নৌকা চালানো থেকে শুরু করে জমি চাষাবাদে ব্যবহার করতে শুরু করেন। নব্বইয়ের দশকে কৃষকেরা ট্রাক্টরের মতো যন্ত্রের ব্যবহার বাড়িয়ে দেন।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে কৃষকের গৃহস্থ আয় বাড়তে থাকে। ওই আয় দিয়ে কৃষক পরিবারের সদস্যরা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে প্রবাসী হতে থাকে। প্রবাসী আয় বাড়ে, যা কৃষক পরিবারগুলোকে কৃষিতে বিনিয়োগে সহায়তা করে। কৃষক পরিবারগুলোর আরেকটি নিম্নবিত্ত অংশ শহরে তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক হিসেবে কাজে যোগ দিতে শুরু করে। তারাও তাদের আয়ের বড় অংশ গ্রামে পরিবারে পাঠায়। অর্থাৎ ওই প্রবাসী ও তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকের আয় শেষ পর্যন্ত কৃষিতেই বেশি বিনিয়োগ হয়। কৃষকেরা তাঁদের হাতে আসা নগদ অর্থ দিয়ে বীজ, সার, কৃষিযন্ত্র কেনার সামর্থ্য অর্জন করেন। ফলে বিজ্ঞানীদের আনা নতুন প্রযুক্তি ও সেবা কৃষকেরা গ্রহণ করার আর্থিক সক্ষমতা অর্জন করেন। এই সক্ষমতার জোরেই দেশে শীতকালে ফসল উৎপাদন অর্থাৎ বোরো ধান ও সবজি চাষে বিনিয়োগ বেড়ে যায়।
আশির দশকের আগপর্যন্ত বাংলাদেশের কৃষি ছিল মূলত বর্ষাকালের বৃষ্টিনির্ভর। প্রকৃতির দান কাজে লাগিয়ে কৃষক দেশি জাতের ফসল চাষ করতেন। কৃষি উপকরণের বাজার উদারীকরণ আর দুটি দুর্ভিক্ষের ছায়া বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে। তারা তাদের সর্বস্ব সামর্থ্য খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজে লাগিয়েছে।
ওই সময় পুকুরে মাছ চাষের হারও বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের বিজ্ঞানী এবং সম্প্রসারণ কর্মীদেরও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। তাঁরা কৃষককে আগ্রহী করেছেন, নতুন নতুন প্রযুক্তি কৃষকের দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছেন। সরকারে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কৃষকের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নীতিসহায়তা দিয়েছেন। ফলে নব্বইয়ের দশকে এসে আমাদের কৃষি উৎপাদন স্বাধীনতা–পরবর্তী সময় থেকে দ্বিগুণের বেশি বাড়ে। চাল, সবজি ও মাছ উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতার কাছাকাছি পৌঁছে যাই।
একই সময়ে বাংলাদেশে পোলট্রিশিল্পের বড় ধরনের উল্লম্ফন হয়। মুরগির বাচ্চা ও ডিম উৎপাদনে দেশি উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসেন। বেশ কয়েকটি বড় উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। মাছ ও মুরগির ফিডমিল বা খাবার উৎপাদন কারখানা গড়ে ওঠে। ফলে একদিকে এসব কৃষিজাতীয় পণ্যের চাহিদা বাড়ে, সাধারণ মানুষের তা কেনার সামর্থ্য তৈরি হয়। আর প্রচুর তরুণ উদ্যোক্তা ছোট ছোট মুরগির খামার গড়ে তোলে। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ায় তারা খামারগুলোতে প্রযুক্তির ব্যবহার করতে শেখে।
কিন্তু সেই ২০০৭–২০০৮ সালের দিকে বিশ্বজুড়ে মন্দা এবং বাংলাদেশে পরপর দুটি বড় ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়ে। খাদ্যপণ্যের দাম আবারও দ্রুত বেড়ে যায়। বিপুল মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় পড়ে। এই সংকট থেকে উদ্ধার পেতে বাংলাদেশ বিশ্ববাজার থেকে চাল ও গমের মতো সহজলভ্য খাদ্য কিনতে হিমশিম খায়। অনেকে ওই পরিস্থিতির মধ্যে ১৯৪৩ ও ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ছায়া দেখতে পায়। কিন্তু না, আমরা ওই সময়ে এত বড় সংকটে পড়িনি। তবে আমাদের নীতিনির্ধারককে ওই সংকট নাড়া দেয়। তাঁরা দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়টিকে জোর দেন। কৃষিতে প্রণোদনা ও সহায়তা বাড়ে। দেশে নতুন নতুন কৃষি অবকাঠামো গড়ে ওঠে। এরপর প্রতিটি দুর্যোগে কৃষককে প্রণোদনা সহায়তা দেওয়া বেড়ে যায়। সার, বীজ ও জ্বালানি তেলের যাতে কোনো সংকট না হয়, তা সরকার থেকে নিশ্চিত করা হয়। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশে কৃষিবান্ধব একটি আবহ তৈরি হয়। যার ফল হিসেবে বাংলাদেশে ধান, সবজি ও মাছের পর ভুট্টা চাষে আমরা বড় সাফল্য পেতে শুরু করি। ওই সময় কৃষিতে বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ায় ফল উৎপাদন, যেমন আম, পেয়ারা ও তরমুজের মতো ফলের উৎপাদনে কৃষকেরা মনোযোগী হন। এসব পুষ্টিকর খাদ্যের উৎপাদনও দ্রুত বাড়ে।
ভারতের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ইতিহাস খুঁজতে গেলেও আমরা একই ধরনের ঘটনাপ্রবাহ দেখতে পাব। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ভারতে তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দেয়। ওই সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের ওই সময়ের মিত্র দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যসহায়তা পাননি। তাঁকে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে খাদ্যসহায়তার জন্য যেতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র তাদের ওই খাদ্যসহায়তা দেয় ঠিকই, কিন্তু তার সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক প্রভাব ভারতীয় রাজনীতিতে পড়ে। ভারত ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিত্রতা বাড়ায়। তাদের কৃষিতে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা বিশ্বনির্ভর সবুজ বিপ্লবের প্রভাব পড়ে। দেশটি খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে আধুনিক প্রযুক্তি, বিজ্ঞান এবং সহায়তা বাড়ায়। কৃষকদের নানা ধরনের সহায়তা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে প্রথমে খাদ্য উৎপাদনে ভারত স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। এরপর তারা ওই উৎপাদনে স্থিতিশীলতা অর্জন করে। বর্তমানে চাল রপ্তানিতে ভারত বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় দেশ। গম রপ্তানিতেও তারা বিশ্ববাজারে বড় স্থান করে নিয়েছে।
তাই বাংলাদেশের কৃষিতে আজকে যে সাফল্য, তার পেছনে খাদ্যসংকটের সুদূরপ্রসারী ছায়া সব সময় প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছে। সরকারের সময়োপযোগী নীতি, বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার ও গবেষকদের নীতি–সহায়তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু তা তখনই সম্ভব হয়েছে, যখন সাধারণ কৃষক তা গ্রহণ করার মতো আকাঙ্ক্ষা ও সামর্থ্য অর্জন করেছে। তবে আমাদের প্রধান খাদ্যগুলোর উৎপাদনে সাফল্য এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতার ধাপ থেকে আমাদের পরবর্তী ধাপে যেতে হবে। ভারত রপ্তানিবাজারে যে সামর্থ্যের পরিচয় দিয়েছে, তা বাংলাদেশের পক্ষেও একটা মাত্রায় সম্ভব। সেই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশের কৃষিতে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশের কৃষিজমির সর্বোচ্চ ব্যবহার হচ্ছে। দেশের বেশির ভাগ জমি ফসল চাষের আওতায় এসেছে। কিন্তু আমাদের মতো এত অল্প জমির দেশে আরও সমান্তরাল সম্প্রসারণ সম্ভব নয়। এখন আমাদের কৃষি উৎপাদনের ভার্টিক্যাল বা উল্লম্ব উৎপাদন বাড়াতে হবে। চীন, জাপান ও ভিয়েতনাম ওই পথে অনেক সাফল্য পেয়েছে। আমরাও আশা করি সেই পথে সাফল্য পাব।
[অনুলিখিত]
শহিদুর রশীদ: প্রধান (দক্ষিণ এশিয়া), ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি)