মূল্যস্ফীতির চাপ ছিল জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষের জড়িত হয়ে পড়ার বড় কারণ। ২৪ অক্টোবর ২০২৪
মূল্যস্ফীতির চাপ ছিল জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষের জড়িত হয়ে পড়ার বড় কারণ। ২৪ অক্টোবর ২০২৪

নীতির ঘাটতি ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বর্তমানে এক গভীর সংকটে রূপ নিয়েছে। এই সংকটের শুরু প্রায় আড়াই বছর আগে হলেও বিগত সরকার সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়েছে। নীতি-ব্যবস্থার ত্রুটি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার অসংগতি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। মূল্যস্ফীতি কেবল নিম্নবিত্ত নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণিকেও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। খাদ্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্য সাধারণ মানুষের জীবনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে, যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, যেমন চাল, ডাল, তেল ইত্যাদির দাম এতটাই বেড়েছে যে মানুষ তাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না, ফলে বাজারের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।

জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে এমন একটা আশার সঞ্চার হয়েছিল যে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় কমে আসবে এবং দৈনন্দিন খরচগুলো সহজতর হবে। তারা আশা করেছিল, নতুন সরকার তাদের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি নজর দেবে এবং অর্থনৈতিক চাপ থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। সেই প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয়নি; বরং দেখা যাচ্ছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছে, যা তাদের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলছে। এ ক্ষেত্রে সরকার বা নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল, শুরুতে তেমন কোনো সুসংগঠিত পদক্ষেপ দেখা যায়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে হয়তো কিছুটা হলেও মূল্যবৃদ্ধির চাপ কমাতে পারে, কিন্তু এখনো তার পূর্ণাঙ্গ প্রভাব দেখা যায়নি।

মূল্যস্ফীতির কারণ

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির পেছনে বেশ কিছু মূল কারণ চিহ্নিত করা যায়। বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতার ফলে আমদানি ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও তা প্রভাব ফেলেছে। বিগত সরকারের ব্যয়বহুল প্রকল্প এবং বাজেটঘাটতি মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ঋণনির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়ন অর্থনীতির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে একটি বড় বাধা হয়ে উঠেছে। প্রাথমিকভাবে মূল্যস্ফীতির জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা হয়েছিল। যদিও এর কিছু প্রভাব শুরুতে অনুভূত হয়েছে, তবে দীর্ঘ মেয়াদে একে মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া সঠিক হয়নি। এর পাশাপাশি জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে সামনে এসেছে কারণ, জ্বালানি প্রায় সব সেক্টরের উৎপাদন ও পরিবহন খরচের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি সরাসরি পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করেছে।

সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, এই সংকট মোকাবিলায় বিগত সরকার সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। অর্থনীতিতে সুদের হার নির্ধারণের যে কৃত্রিম অনমনীয় নীতি (৬-৯%) দীর্ঘদিন ধরে বজায় রাখা হয়েছিল, তা বাজারের বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। যখন মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী ছিল, তখন অর্থ সরবরাহ কমাতে সুদের হার বাড়ানো প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সেই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি। সুদের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত যথাসময়ে না নেওয়ায় অর্থের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে সুদের হার কিছুটা নমনীয় করার কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত ছিল না। অথচ ভারত, ইন্দোনেশিয়া, এমনকি শ্রীলঙ্কাও সময়মতো সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলার চেষ্টা করেছে, যা বাংলাদেশে নেওয়া পদক্ষেপের তুলনায় বেশি কার্যকর ছিল।

সেলিম রায়হান

এ ছাড়া সরকার এই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করে, যা বাজারে অর্থের সরবরাহ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। এর পাশাপাশি ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে সরকার একটি নিয়ন্ত্রিত নীতি গ্রহণ করেছিল। তবে বাজারের প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের পরও এই নীতি টাকার অবমূল্যায়নকে বিলম্বিত করেছে। পরে যখন অবমূল্যায়ন শুরু হয়, এটি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ঘটে এবং একসময়ে টাকার ২৫-৩০ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়। এর ফলে আমদানি করা পণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও ত্বরান্বিত করে। এই বিলম্বিত ও হঠাৎ অবমূল্যায়ন মূল্যস্ফীতির চাপকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়।

বিগত সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাজস্বনীতি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেনি। আমদানি পণ্যের ওপর উচ্চ কর আরোপ করে রাখায় দেশে অনেক পণ্যের দাম আরও বেড়ে যায়। বিশেষ করে, যখন বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বাড়ে এবং একই সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটে, তখন কর কমানো বা কর রেহাই দেওয়ার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যেত। কিন্তু বিগত সরকার করনীতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়, ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বৃদ্ধি পায়। সাম্প্রতিক সময়ে এই ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ দেখা গেলেও তা পর্যাপ্ত নয়।

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো অভ্যন্তরীণ বাজারে কিছু ব্যবসায়ীর অসাধু কার্যক্রম। বাজারের অনিয়মিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যের দাম ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে ভোক্তারা অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধে বাধ্য হয়। বাজার ব্যবস্থাপনা ও কার্যকর নজরদারির অভাবও এই সংকটকে আরও তীব্র করে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ার ফলে বাজারে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, যা মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে তোলে।

শ্রীলঙ্কার থেকে যা কিছু শেখার

সম্প্রতি বড় অর্থনৈতিক সংকটে পড়লেও শ্রীলঙ্কা এখন কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। এর পেছনে প্রধান কারণগুলোর একটি হলো তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনভাবে কাজ করার সক্ষমতা। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার ও মুদ্রার বিনিময় হার সঠিকভাবে সমন্বয় করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। তারা অর্থনৈতিক নীতিমালার ক্ষেত্রে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ কমেছে এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের দিকে এগিয়েছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন। এখানে বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারেনি এবং সুদের হার ও মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি দীর্ঘস্থায়ী রূপ ধারণ করে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সীমিত স্বাধীনতা অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পথে বড় বাধা।

প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ

মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি:

প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা: বাজারে চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় পণ্য দ্রুত আমদানি করা এবং এর সরবরাহ নিশ্চিত করা।

মুদ্রানীতির সমন্বয়: অর্থ সরবরাহ কমাতে সুদের হার বাড়ানোর মাধ্যমে মুদ্রানীতিতে প্রয়োজনীয় সমন্বয় আনা।

কঠোর ব্যয়সংযম নীতি: সরকারের উচিত অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে, সরকারি প্রকল্পগুলোর কার্যকারিতা বাড়িয়ে অর্থনীতি পরিচালনায় কঠোর ব্যয়সংযম নীতি প্রয়োগ করা।

আমদানির ওপর কর হ্রাস: আমদানি করা পণ্যের ওপর কর কমানো বা কর রেহাই দেওয়া, যাতে ঘরোয়া বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা: পণ্যের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়ানোর প্রবণতা রোধে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

চাহিদা ও সরবরাহের সঠিক পরিসংখ্যান: বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের সঠিক পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে সেই অনুযায়ী আমদানি ও সরবরাহের পদক্ষেপ নেওয়া।

সমন্বিত প্রচেষ্টা: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য একক নীতির ওপর নির্ভর না করে বিভিন্ন পদক্ষেপের সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

মূল্যস্ফীতি একটি জটিল অর্থনৈতিক সমস্যা। এটি কোনো একক নীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনার একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া প্রয়োজন। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সমন্বিতভাবে কাজ করে, তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। অন্যথায় দেশের সাধারণ মানুষকে আরও দীর্ঘ সময় এই সংকটের মধ্যে দিন কাটাতে হবে।

* সেলিম রায়হান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক; সানেমের নির্বাহী পরিচালক