জাতি হিসেবে আমাদের যে পরিচয় তৈরি হয়েছে, তার পেছনে আছে বহু মানুষের অবদান। স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে কিছু মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় রচিত হয়েছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির অবয়ব। তাঁদের সৃষ্টি, চিন্তা ও কর্মে সহজ হয়েছে আমাদের জীবন; রূপ পেয়েছে আমাদের স্বপ্ন, ভাষা পেয়েছে আমাদের কল্পনা।
সুন্দর শোভন পরিপাটি সংসার। স্বামী পূর্ব বাংলার অন্যতম উদ্যোগী প্রকৌশলী, সেতু নির্মাণে দক্ষ একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। জ্যেষ্ঠ পুত্র কলেজ শেষ করে ভর্তি হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে, দেশে কিংবা দেশের বাইরে। কনিষ্ঠটি বিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়াতে অধীর। এলিফ্যান্ট রোডের ভেতরমুখী এক সড়কের প্রান্তে ছোট্ট ছিমছাম নিজস্ব আবাস ‘কণিকা’। সরকারি আবাসের যখন নাম রাখা হচ্ছে ‘কাহকেশান’, ‘গুলফেশান’—সেই সময়ে এই বাংলা নাম পরিবারের রুচি ও সংস্কৃতিমনের পরিচয় বহন করে। বস্তুত গৃহকর্ত্রী জাহানারা ইমাম ঢাকার সংস্কৃতিমণ্ডলীতে নানাভাবে সক্রিয়, মঞ্চে কিংবা বেতারে, শহরের এলিট গোষ্ঠীর মধ্যে বাঙালিত্বের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি।
একাত্তরে রক্তাক্ত, বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত হয়েছিল দেশজুড়ে অসংখ্য পরিবার, জাহানারা ইমামও তার বাইরে ছিলেন না। যুদ্ধ কেড়ে নিল তাঁর স্বামীকে, অনতিতরুণ মুক্তিযোদ্ধা রুমীকে। ছেলেকে যুদ্ধের পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি নিজে, গাড়ি চালিয়ে। গ্রেপ্তার হয়ে ঢাকার পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটিতে চরম নির্যাতন ভোগ করেছিলেন গেরিলাযোদ্ধা দলের সদস্য রুমী, তাঁর লাশটিও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। শত্রুসেনাদের অত্যাচারে, অপমানে, বিপর্যস্ত স্বামী ঘরে ফিরে এলেও প্রাণশক্তি আর অবশিষ্ট ছিল না, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন বিজয়ের প্রাক্-মুহূর্তে।
স্বাধীন দেশে আরও হাজারো দুর্ভাগা নারীর মতো জাহানারা ইমামেরও পথচলা শুরু হয় নতুন করে, সংসারের হাল ধরে সন্তানের ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথ ও পাথেয়র ব্যবস্থাকল্পে। শূন্য ঘরে হাহাকার করে ফেরে শোক, তারপরও তাঁকে উঠে দাঁড়াতে হয়, সেই ঘুরে দাঁড়ানোর ফসল হিসেবে আমরা পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগাথা একাত্তরের দিনগুলি, আটপৌরে ভঙ্গিতে লেখা একাত্তরের উত্তাল সময়ের অন্তরঙ্গ দিনলিপি, যা হৃদয় আকুল করা যুদ্ধদিনের ছবি এঁকে দেয় পাঠকের চিত্তে, বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্মের সদস্যদের মনে, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। তত দিনে বঙ্গবন্ধু হত্যার মাধ্যমে আবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে গণমাধ্যমে পাঠ্যপুস্তকে সরকারি অনুষ্ঠানে চলছে ইতিহাসের অস্বীকৃতি, বিকৃতি ও বিস্মরণ।
বিরূপ ও বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করে মুক্তিযুদ্ধের বেদনা ও গৌরবের বাস্তবতা আবারও দৃশ্যমান করে তোলা, নতুন প্রজন্মের সামনে উপলব্ধির নতুন পথ খুলে দিতে অনেক মানুষ অনেকভাবে কাজ করেছেন, আর সেখানে আমরা বিশেষভাবে পাই জাহানারা ইমাম ও তাঁর স্মৃতিগ্রন্থ একাত্তরের দিনগুলিকে। কলম হাতে নিয়ে আপনজনের জীবনদান ও জাতির অগ্নিপথ পরিক্রমণের বয়ান রচনা সহজ ছিল না। ব্যক্তিগত অনুভূতি যেমন সংহত রাখতে হবে, তেমনি ইতিহাসের ঘটনাধারা উপস্থাপনে হতে হবে বস্তুনিষ্ঠ। সার্থকভাবে তিনি করেছিলেন এই কাজ, যার প্রতিফলন মিলেছিল পাঠক প্রতিক্রিয়ায়, যখন গাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল এই রচনা। ১৯৮৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশের পর আজও অব্যাহত রয়েছে এই বইয়ের পাঠকপ্রিয়তা, এক প্রজন্মের সদস্য-সদস্যাদের মুক্তিযুদ্ধে দীক্ষিত ও শিক্ষিত করেছে জাহানারা ইমামের গ্রন্থ। অনেক নবীন-নবীনা বই পড়ে খুঁজে বের করেছেন ‘কণিকা’ আবাস, তাঁকে চাক্ষুষ করে জানিয়েছিলেন শ্রদ্ধা, যা তাঁকেও নতুনভাবে জুগিয়েছিল প্রাণশক্তি।
এই একটি বই–ই জাহানারা ইমামকে অবিস্মরণীয় করে তোলার জন্য ছিল যথেষ্ট। তবে তিনি এখানে থেমে থাকেননি, নানা ধরনের সাহিত্য রচনায় ব্রতী থেকেছেন, আর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে শরিক হয়েছেন সোৎসাহে। তবে ইতিহাসের দায়মোচনে আরও বড় দায়িত্ব তাঁর জন্য বুঝি অপেক্ষমাণ ছিল।
‘জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ সেই পুরনো শকুন’, তরুণ কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এই পঙ্ক্তিতে স্বদেশের যে বাস্তবতা মূর্ত হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় পলাতক যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের দেশে ফেরা ও সরকারের প্রশ্রয়ে সক্রিয় হওয়া সম্ভব হয়। জামায়াতে ইসলামী গণহত্যাকারী ঘাতক গোলাম আযমকে দলীয় প্রধান হিসেবে ঘোষণা করলে বেদনাহত হয় দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ; তাঁদের সবার অন্তরের তাগিদ প্রকাশ করে ১৯৯২ সালের গোড়ায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ঐক্যের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গঠিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’। এই কমিটি গঠন করে যুদ্ধাপরাধের বিচারের গণ-আদালত। এই আন্দোলনের সভাপতি ও কান্ডারি হিসেবে জাহানারা ইমাম শুরু করেন জীবনপণ এক নতুন সংগ্রাম। গণহত্যাকারীদের বিচারের যে দাবি পরিত্যক্ত পদদলিত ও অস্বীকৃত হয়েছিল, এই আন্দোলনের মাধ্যমে তা আবার জনচিত্তে ফিরে আসে, যা স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাসে সামাজিক শক্তির দ্বারা অর্জিত এক বিশাল বাঁকবদলরূপে চিহ্নিত করা যায়। আন্দোলনে নতুন প্রজন্মের সদস্য-সদস্যাদের বিপুল অংশগ্রহণের প্রত্যক্ষ প্রেরণা ছিলেন জাহানারা ইমাম, সেই সঙ্গে নবীনদের ‘আইকন’ হয়ে ওঠে শহীদ সাইফ ইমাম রুমী।
গণ-আদালতের কর্মধারায় আইনি বিধিবদ্ধতা অনুসরণ করে অভিযোগপত্র তৈরি এবং সমাজের বিশিষ্টজনের সমন্বয়ে গঠিত আদালতে প্রকাশ্যে রায় ঘোষণা গণহত্যার জন্য দায়ী অপরাধীদের চিহ্নিত করে দেয় সবার কাছে। সমাজে উন্মোচিত হয় তাদের অপরাধ, তারা সদম্ভে রাষ্ট্রপরিসরে বিচরণ করলেও মানুষের কাছ থেকে কলঙ্করেখা আর কখনোই লুকাতে পারেনি। আন্দোলনের সূচনাকালে জাহানারা ইমামের মুখগহ্বরে ক্যানসার ধরা পড়ে, মরণব্যাধির বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত লড়াই এবং জাতির জন্য সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই চলতে থাকে যুগপৎ, যেমন একাত্তরে তাঁর নিজের ও আপনজনের সংগ্রাম এবং জাতির মুক্তির লড়াই হয়ে পড়েছিল একাকার।
১৯৯৬ সালের ২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান, দেশবাসীর উদ্দেশে বার্তায় আন্দোলনের দায়িত্ব দিয়ে যান নতুন প্রজন্মের হাতে। প্রয়াণের পরও জাহানারা ইমাম হয়ে আছেন প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্ববহ, যার প্রতিফলন প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নানাভাবে স্পন্দিত হয়েছে। একাত্তরের দিনগুলি গ্রন্থের পাঠ আজও অব্যাহত রয়েছে, ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় ৫০তম মুদ্রণ, এখনো প্রতিবছর বের হচ্ছে একাধিক মুদ্রণ। এই বই পাঠকের সঙ্গে তৈরি করে একান্ত ব্যক্তিগত সংযোগ, নবীনেরা জানছেন মুক্তিযুদ্ধ জাহানারা ইমামের চোখে, যা ছাপ রেখে যার তাদের চিত্তে। ঘাতক-দালালদের বিচারের যে অনন্য আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন জাহানারা ইমাম, তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব তিনি দেখে যাননি বটে, তবে আন্দোলন সার্থকতা পেল ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় সংসদে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইনের আলোকে ট্রাইবুন্যাল গঠন দ্বারা, যে আদালত পুরোধা ঘাতক-দালালদের বিচার একে একে সম্পন্ন করেছে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে চিহ্নিত এক যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে যে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হয়, তা ছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলার ইতিহাসের বাঁকবদলের আরেক প্রতিচ্ছবি। শাহবাগ চত্বরে সেই বিশাল সমাবেশে তরুণেরা জাহানারা ইমামের প্রতিকৃতি টাঙিয়ে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদ থেকে নিচের সড়ক অবধি, যেন আকাশ ও মাটি একাকার করে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন তরুণের সমাবেশে, তাঁর আশীর্বাণী ঝরে পড়ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রত্যয়ী বাংলাদেশের আজকের ও অনাগত দিনের তরুণ-তরুণীদের ওপর।
১৯৯২ সালের জানুয়ারি থেকে ঘাতক-দালালদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি হয়ে পাল্টে গিয়েছিল জাহানারা ইমামের জীবন, তিনিও পাল্টে দিয়েছিলেন সমাজের ক্ষমতাবিন্যাস জনশক্তির উদ্বোধন দ্বারা। এই দায়িত্ব সম্পাদনে সবচেয়ে উপযুক্ত মানুষ ছিলেন তিনি, ইতিহাস যাঁকে নির্মাণ করেছিল। কোন মানসিক টানাপোড়েন ছাপিয়ে তিনি ঝাঁপ দিলেন নতুন লড়াইয়ে, সেই পরিচয় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমার কাছে লেখা এক পত্রে, সেখান থেকে কিয়দংশ উদ্ধৃত করে তাঁকে জানাই শ্রদ্ধার্ঘ্য।
১৯৯১ সালের ৪ ডিসেম্বর লেখা পত্রে তিনি জানান, ‘গতকাল দুপুরে আমার মুখের ভেতর অপারেশন করা হয়েছে। অপারেশনের পর কাটা অংশটা বায়োপসি করতে পাঠানো হয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষা। মুখটা ফুলে রয়েছে, কাটার পর স্টিচ পড়েছে ৫টা। লিকুইড খাচ্ছি, সেই সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক এবং ব্যথা কমানোর ওষুধ। ভীষণ শীত এখানে এখন, বরফ পড়ছে। আহ্! ঢাকায় এখন কী সুন্দর আবহাওয়া! এখানে বরফের সঙ্গে মেঘলা, ঢাকায় উজ্জ্বল নীল আকাশ, চারদিক ভাসানো উজ্জ্বল রোদ, তোমরা সব একটা পাতলা সোয়েটার কিংবা চাদর গায়ে ফেলে আসন্ন বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান তৈরিতে মশগুল।’
‘ভেবে দেখ আমার মনে কী কষ্ট! কেন আমি বঞ্চিত হলাম? আমার জীবনে তো আনন্দের উপকরণ খুব বেশি কিছু নেই। মন খুব খারাপ, খুব খারাপ।’
চিঠি লেখার পরপর এই মানুষটিই ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে দেশে ফিরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের আন্দোলনের হাল ধরে জাতিকে নিয়ে গেলেন আরেক উচ্চতায়, মুক্তিযুদ্ধের দায়বদ্ধতায়। তিনি খুঁজে পেলেন নতুন জীবন, জাতিকে দিলেন নতুন প্রাণ।
মফিদুল হক: ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর; প্রাবন্ধিক