প্রফেসর রাজ্জাকের অলিখিত উইল

প্রথম আলোর বয়স মাত্র ২৫ বছর, কিন্তু এর অর্জন অনন্য। প্রথম আলো তার স্বপ্নের পথে এগােতে এগোতে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে অভূতপূর্ব কিছু মাইলফলক স্থাপন করেছে। সাহসী সাংবাদিকতা, উদ্ভাবনী পরিকল্পনা, দেশ ও বিদেশের অগ্রগণ্য মানুষের সম্পৃক্ততা ছিল এর শক্তি। প্রথম আলোর ২৫ বছরের নির্বাচিত ও সংক্ষেপিত বিষয়বস্তু থেকে পাওয়া যাবে এর স্বতন্ত্র পথরেখার নিশানা।

জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক

দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের প্রতি রাজ্জাক স্যারের বরাবর একটা লোভ ছিল। তিনি আমাদের কাছে গল্প করেছেন বিলেতে পুরোনো বইয়ের দোকানে গিয়ে সারা দিন কীভাবে বিভোর হয়ে কাটিয়ে দিতেন। প্রায় প্রতিদিনই পুরোনো বইয়ের দোকানে যাওয়া তাঁর একটা মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। বিলেতে যাঁরা পুরোনো বই বেচতেন, তাঁরা হালকা-পাতলা একহারা চেহারার মানুষটিকে চিনে নিয়েছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ লক্ষ করেছিলেন, লোকটি সকালবেলা আসেন এবং সারা দিন বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে সন্ধ্যাবেলা ফেরত যান। বই বিক্রেতাদের একসময় খেয়াল হলো ভদ্রলোক কিছু না খেয়েদেয়ে শুধু বইপত্রের স্তূপের মধ্যেই ডুবে থাকেন। প্রতিদিন একই ঘটনা ঘটতে দেখে এক বিক্রেতার মনে করুণা হলো। তিনি রাজ্জাক স্যারকে একদিন সসংকোচে লাঞ্চ খেতে ডাকলেন। তার পর থেকে সেটাই নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল। পুরোনো বইয়ের দোকানে গেলেই তিনি লাঞ্চ খেয়ে আসতেন।

রাজ্জাক স্যার দ্বিতীয়বার বিলেত গেলেন এক থেকে দেড় যুগ পর। পরিচিত পুরোনো বইয়ের দোকানটিতে গিয়ে স্যার একটু হোঁচট খেলেন। কাউন্টারে বসা লোকটি পুরোনো সেই লোক নয়। রাজ্জাক স্যার কাউন্টারে উপবিষ্ট লোকটির কাছে জানতে চাইলেন আচ্ছা, এটা মিস্টার অমুকের দোকান না? লোকটি বলল, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন। উনি আমার বাবা। মারা গেছেন ১২ বছর। আমাদের কাছে তিনি আপনার চেহারার বর্ণনা দিয়ে বলে গেছেন আপনি এলেই লাঞ্চ খাওয়ানোর নিমন্ত্রণ করতে।

দুষ্প্রাপ্য পুরোনো বইয়ের প্রতি স্যারের যে আকর্ষণ ছিল, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে তার একটা প্রমাণ পাওয়া যায়। স্যারের সংগ্রহে অনেক দুষ্প্রাপ্য পুস্তক জমা হয়েছিল। তিনি শিরোনাম উল্লেখ করে বলতেন, এই বইগুলোর ফার্স্ট এডিশন আমার কালেকশনে আছে। বেবাক দুনিয়ার লাইব্রেরিগুলোতে ঘুরলেও আপনি এর ফার্স্ট এডিশন কোথাও পাইবেন না।

এ ধরনের পুরোনো দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থসমূহ রাজ্জাক স্যার পাঁজরের হাড়ের মতো রক্ষা করতেন। অনেকগুলোরই পাতা বিবর্ণ হয়ে এসেছিল। যত দিন স্যার সক্ষম ছিলেন, নিজের হাতে বইগুলো যত্ন করতেন। মুছতেন, রোদে দিতেন এবং পাউডার ছড়াতেন। এত সতর্কতা সত্ত্বেও কিছু কিছু বইয়ের মধ্যে কীটেরা হামলা করেছিল। এই দৃশ্য দেখে স্যার ভীষণ ব্যথিত বোধ করতেন।

যত দিন স্যার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছিলেন, পুরোনো গ্রন্থের প্রতি স্যারের অত্যধিক প্রীতিকে তাঁর সময় কাটানোর একটা ফন্দি বলে মনে করতাম। তারপর যতই দিন যেতে লাগল, স্যারের পুরোনো দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থপ্রীতিকে আমি সিরিয়াসলি নিতে আরম্ভ করি। স্যার যখন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছেড়ে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র লিটুর সঙ্গে থাকতে গেলেন, একটি বিশেষ জিনিস দেখে আমার মনোভাব একেবারে পাল্টে গেল। চারপাশে ছড়ানো বইয়ের র​্যাক, অধিকাংশ বইয়ের শরীর থেকে অতীতকালের গন্ধ বেরিয়ে আসছে। মাঝখানে একটি চেয়ারে স্যার বসে আছেন। পড়া, আধপড়া, সিকিপড়া বইপত্র ইতস্তত ছড়ানো। স্যার ঝুঁকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসের সাহায্যে আস্তে আস্তে বই পড়ছেন। একটু ক্লান্ত হলে অ্যাটেনডেন্ট ছেলেটিকে বলছেন, ‘এই, এক পেয়ালা চা দে।’ তারপর আঙুল দিয়ে হুঁকোর কলকেটা দেখিয়ে দিতেন। চা আর তামাক খাওয়ার পর সেই একই কাজ। আবার পুরোনো গ্রন্থে কামড় বসানো।

এই বইপত্র পরিবেষ্টিত অবস্থায় দেখতে দেখতে স্যারকে স্বয়ং প্রাচীন যুগ ও জগতের একটি অংশ বলে আমার মনে হতে লাগল। আমার মধ্যে এই অনুভূতি জন্মানোর পর স্যার এবং তাঁর সংগ্রহশালার দিকে আমি নতুন চোখে তাকাতে আরম্ভ করলাম। আমি নানা বইপুস্তক সম্পর্কে খবর নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। গুলশানে যখন যেতাম, আমার হাতে সময় বেশি থাকত না। দীর্ঘ সময় থেকে স্যারের মেজাজ বুঝে একটা বই সম্পর্কে প্রশ্ন করলেও তিনি দশ-বিশটা বইয়ের সংবাদ বলতেন। কোন বই কীভাবে সংগ্রহ করেছেন, সেই ইতিবৃত্ত জানাতেও ভুল করতেন না।

আরও কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগল। স্যারের অবর্তমানে এই বইগুলোর হেফাজত কে করবে? আমার দুশ্চিন্তাটা স্যারের একান্ত স্নেহভাজন ছাত্র এবং অকৃত্রিম বন্ধু সাবেক মন্ত্রী আজিজুল হক সাহেবকে একদিন জানালাম। তিনি বললেন, এইডা তো আমারও চিন্তা। স্যারের অনুকরণে কি না জানি না, হক সাহেব মাঝে মাঝে ডায়ালগে বাংলা বলেন। আমাকে বললেন, ‘তুমি স্যাররে জিগাও তিনি কী করতে চান। এই সব বইপত্র তো আর করবে নেওন যাইতো না। কিছু একটা ব্যবস্থা তো করতে অইবো।’ আমি বললাম, একটা জায়গা পাওয়া গেলে বইগুলো ক্যাটালগ করে সাজিয়ে–গুছিয়ে এক জায়গায় রাখলে ভালো হয়। কিন্তু জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। হক সাহেব বললেন, ‘মিয়া, তোমার জায়গার চিন্তা করন লাগতো না। স্যাররে জিগাও, তিনি বইপত্রের কী ব্যবস্থা করবেন। আমি তো আমার বাড়ির একটা অংশ খালি কইরা রাখছি।’ 

আহমদ ছফা

লিটুর বাড়ি থেকে গুলশানের হেলু চাচার বাড়িতে যখন থাকতে এলেন, তাঁর কাজকর্ম দেখে মনে হলো, তিনি বইপত্রগুলোর একটা ব্যবস্থা করার জন্য গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করছেন। একজন নারী সহকারী নিয়োগ করে বইগুলোর শ্রেণিবিন্যাস করছেন এবং ক্যাটালগ তৈরি করছেন। মনে হলো, স্যারকে তাঁর পদ্ধতিতে এগোতে দেওয়া উচিত। তাঁর কোনো চিন্তাভাবনা থাকলে একসময় তিনি আমাদের তা জানাবেন। একদিন আমি বললাম, ‘ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, ড. আহমেদ কামাল, জনাব আজিজুল হক—ওনাদের সবার সঙ্গে কথা বলেছি। এই বইগুলোর উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সবাই খুব উৎকণ্ঠিত। মানুষের হায়াত-মউতের কথা তো বলা যায় না। আপনি রাজি থাকলে আমরা একটা কমিটি করি। তিনি বললেন, ‘আজিজুল হক হানড্রেড পারসেন্ট ডিপেন্ডেবল। তবে আপনেরা লগে মনসুর মুসারে রাখবেন। জানেন তো, হে আমার ফার্স্ট কাজিনের মাইয়্যারে বিয়া করছে। এক্কেরে সাদা দিলের মানুষ। ভিতরে কিছু নাই।’ সেদিন এ পর্যন্ত কথাবার্তা হলো।

এ বছরের জুন মাসের মাঝামাঝি আমাকে দেশের বাইরে যেতে হয়েছিল। বাইরে যাওয়ার দিন সকালে আমি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাই। দুই মাস কঠিন রোগে ভুগে আমার মধ্যে মৃত্যুচিন্তা জন্ম নিয়েছিল। অসুস্থ অবস্থায় মনে হয়েছিল, আমি কিংবা স্যার, যে কেউ মারা যেতে পারি। কিন্তু স্যারের বইগুলোর তো কোনো বন্দোবস্ত করা হলো না। মুখ্যত, সে কারণেই স্যারের ওখানে গেলাম। আমার কিছু টাকারও প্রয়োজন ছিল। স্যারের কাছে টাকার কথা বলার পর বইয়ের কী হবে, সে ব্যাপারে প্রশ্ন করলাম। স্যার প্রথমে ‘না’ করলেন না। আমি বললাম, স্যার, আমি তো মারাও যেতে পারি। কিন্তু বইগুলো কী করবেন, সেটা জানতে পারলে একটু শান্তি পাই। স্যার বললেন, ‘আমি স্থির করছি, দু-তিন পৃষ্ঠার একটা বয়ান লেখুম। আমার বইগুলো যে জায়গাতেই রাখা হউক না কেন, বেঙ্গলের লগে রিলেটেড যেকোনো সাবজেক্টের ওপর গবেষণার জন্য যেন বইগুলো ব্যবহার করা হয়, হেই রকম একটা অছিয়তনামা রাইখ্যা যাওনের চেষ্টা করুম।’ আমি বললাম, ‘স্যার, বেঙ্গল তো একটা ভেগ টার্ম। আপনে স্পেসিফিক করে বলেন।’ তিনি বললেন, ‘বেঙ্গলের ইকোনমি, পলিটিকস, লিটারেচার, হিস্ট্রি, অ্যানথ্রোপলজি, মিউজিক—সব বিষয় ইনক্লুড কইরাই আমি কথাডা কইছি।’

জানি না, শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে স্যার কিছু লিখিত রেখে গেছেন কি না।

৩ ডিসেম্বর ১৯৯৯ (সংক্ষেপিত)