করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সরকারি সাধারণ ছুটিতে পুরোপুরি হোম অফিস বা বাসায় বসে কাজ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু প্রথম আলোর বিভিন্ন বিভাগের করোনাকালীন সম্মুখযোদ্ধা সংবাদকর্মীদের ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হয়েছে। কাজ করতে গিয়ে সংবাদকর্মীদের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন। কর্মীদের সুস্থতায় অফিস তৎপর হয়েছে। একই সঙ্গে প্রথম আলোর বিজ্ঞাপন ও সেলস, সার্কুলেশন, হিসাব, প্রশাসন, মানবসম্পদসহ প্রতিটি বিভাগের কর্মীরা এ সময়ে নিজেদের তৎপরতা দেখিয়েছেন। কেননা, পাঠক তো অপেক্ষা করে আছেন।
করোনাকালের সার্কুলেশন
অরূপ কুমার ঘোষ
করোনার প্রাদুর্ভাবে সারা দেশের হকার ও এজেন্টদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে এক দিনের সিদ্ধান্তে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াবের সহযোগিতায় সারা দেশের প্রায় ১২ হাজার হকার ও ৫৬০ জন এজেন্টকে গ্লাভস, মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ঢাকার কোনো দোকানে (পাইকারি ও খুচরা) এত পরিমাণে গ্লাভস ও মাস্ক মজুত ছিল না। ২৪ মার্চ ঢাকা সার্কুলেশন টিমের কর্মীরা বিভিন্ন এলাকা ঘুরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মাস্ক ও গ্লাভস সংগ্রহ করেন এবং ২৫ মার্চ সারা দেশে হকার ও এজেন্টদের কাছে বিতরণ করেন।
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রোধে সরকার ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে, পরে কিছু কিছু এলাকা লকডাউন করা হয়। সারা দেশে গণপরিবহন চলাচল না থাকায় পত্রিকা পরিবহন করতে সমস্যা হচ্ছিল। সার্কুলেশন বিভাগের কর্মীরা উপস্থিত থেকে সিএনজি, অটো, ভ্যান ইত্যাদির মাধ্যমে বিকল্প উপায়ে নিয়মিত প্রথম আলো সরবরাহ নিশ্চিত করেন।
প্রথম আলো েদশের ৩,১৭৪ জন হকারকে প্রশাসনের সহায়তা ও িনজ তহবিল থেকে চাল, ডাল, নগদ টাকাসহ িবভিন্নভােব সহায়তা করেন।
সার্কুলেশনের কর্মীরা হকারদের সঙ্গে মাঠে নেমে পড়েন। এর মধ্যে ৫ জন সার্কুলেশন কর্মী করোনায় আক্রান্ত হন এবং ঢাকার সহকারী ব্যবস্থাপক রাসেল রানা গুরুতর অসুস্থ হন। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। লকডাউনে জুম-মিটিংয়ের মাধ্যমে সার্কুলেশন বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
● অরূপ কুমার ঘোষ উপমহাব্যবস্থাপক, সার্কুলেশন সেলস
সরদার মুহম্মদ সাইফ-উন-নিজামী
করোনার জরুরি পরিস্থিতিতে বিজ্ঞাপনদাতাদের অফিস কার্যক্রম হোম অফিসনির্ভর বা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রথম আলোর িবজ্ঞাপন আয়ে প্রভাব পড়ে। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বিজ্ঞাপন কমে যায়। অভ্যন্তরীণ এবং বিজ্ঞাপনদাতা উভয়ের ব্যবসায়িক অগ্রগতি, স্বাস্থ্যসুরক্ষা এবং ঝামেলাহীন বিজ্ঞাপন প্রকাশের বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দিয়ে বিজ্ঞাপন সেলস বিভাগ বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেয়।
বিভাগীয় সব কর্মী বিজ্ঞাপনদাতা এজেন্সি এবং ব্যক্তিপর্যায়ে মুঠোফোন ও অন্যান্য ডিজিটাল যোগাযোগের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কার্যক্রম যথাসাধ্য চালিয়ে যান। পত্রিকায় করোনাসংক্রান্ত বিভিন্ন রিপোর্ট ব্র্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের আয় বাড়ানোর চেষ্টা করা, শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপন সশরীরে/এজেন্টের মাধ্যমে নয়, সরাসরি প্রথম আলোর একটি নম্বরে ডিজিটাল পদ্ধতিতে লেনদেনের জন্য গ্রাহক সুবিধা চালু করা হয়। বিজ্ঞাপন মূল্যতালিকায় দেওয়া হয় বিশেষ ছাড়। সামাজিক সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয় বিনা মূল্যে। সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিজ্ঞাপনসংক্রান্ত সামগ্রিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। গ্রাহকদের অফিসের লোকবলের স্বল্পতার বিষয়টি ভেবে বিজ্ঞাপন ডিজাইন তৈরিতে করা হয় সর্বোচ্চ সহযোগিতা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ডিজাইন বিনা মূল্যে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে তৈরি করে দেওয়া হয়। জরুরি পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের নিম্নমুখী ব্যবসায়িক পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্রেডিট বিজ্ঞাপন সুবিধা বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়।
আশার কথা, নতুন স্বাভাবিক সময়ে এখন বিজ্ঞাপনে গতি ফিরে আসেছে।
● সরদার মুহম্মদ সাইফ-উন-নিজামী উপমহাব্যবস্থাপক, বিজ্ঞাপন সেলস
শতভাগ হোম অফিসে যাওয়ার আগে যাঁদের ছাড়া কোনোভাবেই পত্রিকা বের করা সম্ভব ছিল না, তাঁদের সব ধরনের স্বাস্থ্যসুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
উৎপল কুমার চক্রবর্তী
রাত ১১টা। সম্পাদকের ফোন।
টিপুর (টিপু সুলতান) শারীরিক অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন। হাসপাতালে ফোন দিয়ে দিচ্ছি, শিশিরের (শিশির মোড়ল) সঙ্গে কথা বলে যা লাগে ব্যবস্থা করো।
জি স্যার।
টিপু ভাই একা মানুষ, তাঁরা দুই বন্ধু একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। দুপুরে জেনেছি, দুজনেই করোনায় আক্রান্ত। শিশিরদার সঙ্গে কথা হলো। জানলাম শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে, ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হলো, আমাদের একজন পিপিই পরে চলে গেলেন টিপু ভাইয়ের বাসায়। রাত সাড়ে ১২টায় হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা হলো।
এ পর্যন্ত প্রথম আলোর ৫৮ জন সহকর্মী কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়েছেন এবং সবাই সুস্থ হয়েছেন। কয়েকজন কর্মী পরিবারসহ কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হন। অফিসের পক্ষ থেকে তাঁদেরও সহযোগিতা করা হয়। পাশাপাশি বাসা থেকে সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতিদিনের কাজ করতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হয়েছে।
করোনাকালে এভাবেই আমরা সবাই, সবার পাশে থেকেছি।
চলতি বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছিল। জানা ছিল না ঠিক কী করতে হবে, নিজেদের সাধারণ জ্ঞানকে পুঁজি করেই কিছু বিষয় নির্ধারণ করি। কর্মীদের স্বাস্থ্যসুরক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে পরদিন থেকেই অফিসে সতর্কতামূলক বেশ কিছু ব্যবস্থা চালু করা হয়। অতিথি আগমন নিয়ন্ত্রণ, কর্মীদের শারীরিক তাপ পরিমাপ করে অফিসে ঢোকা, সবার জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা, সবার জন্য উন্নত মানের মাস্কের ব্যবস্থা, নিয়মিত বাইরে যেতে হয় এমন কর্মীর জন্য জীবাণুপ্রতিরোধী গাউন, আই প্রটেক্টর, গ্লাভস ইত্যাদির ব্যবস্থা, যেখানে সবার স্পর্শ লাগার ঝুঁকি আছে, এমন সব স্থান প্রতি ঘণ্টায় একবার করে জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করা, পার্কিং স্থান এবং গাড়িতে জীবাণুনাশক স্প্রে করা, ক্যানটিনে প্রবেশ বন্ধ করে দিয়ে সবার ডেস্কে খাবার পৌঁছানো, কর্মীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরামর্শের ব্যবস্থা, গণপরিবহন পরিহার করে কর্মীদের আসা-যাওয়ার জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করাসহ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
● উৎপল কুমার চক্রবর্তী হেড অব অ্যাডমিন
মোহাম্মদ মাহবুব কায়সার
২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি শুরু হলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রথম আলোতেও সীমিতভাবে হোম অফিস কার্যক্রম চালু হয়। করোনা পরিস্থিতি আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। প্রতিদিনের পত্রিকাটা যাতে বের করা সম্ভব হয় সে জন্য সহকর্মীরা ভাগ হয়ে গেলেন দুটি গ্রুপে। তখনই হঠাৎ আক্রান্ত হলেন একজন সহকর্মী। তাৎক্ষণিকভাবে জরুরি এক ভিডিও কনফারেন্সে সম্পাদক মতিউর রহমান শতভাগ হোম অফিসের নির্দেশনা দিলেন। পরদিন সকালে পাঠক হাতে পেলেন পত্রিকা। তবে এই পত্রিকার বিশেষত্ব হলো এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে হোম অফিসের মাধ্যমে প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা। এভাবেই চলে কয়েক মাস।
শতভাগ হোম অফিসে যাওয়ার আগে যাঁদের ছাড়া কোনোভাবেই পত্রিকা বের করা সম্ভব ছিল না, তাঁদের সব ধরনের স্বাস্থ্যসুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। লেখালেখি, সংবাদ সংগ্রহের কাজ সাংবাদিক সহকর্মীরা করেছেন নিজ নিজ অবস্থান থেকে, স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিয়ে। প্রয়োজন অনুসারে তাঁদের পাঠানো হয়েছিল সুরক্ষাসরঞ্জাম। ছিল সার্বক্ষণিক চিকিৎসসেবা। সহকর্মীদের বড় অংশ হোম অফিসে এবং বাকিদের দেওয়া হয়েছিল বিশেষ ছুটি। কিছু সহকর্মীকে অফিসে আসতে হতো বলে মানবসম্পদ বিভাগের দু-একজন কর্মীকেও প্রায়ই অফিস আসতে হতো।
প্রায় চার মাস ধরে হোম অফিস চলাকালীন মানবসম্পদ বিভাগ থেকে কর্মীদের মানসিক অবস্থা জানতে করা হয় একটি বিশেষ জরিপ। করোনা পরিস্থিতির আগে কর্মী ব্যবস্থাপনা, কর্মী ধরে রাখা এসবই ছিল মানবসম্পদ বিভাগের মূল কাজ। তবে করোনার শূন্যতা আমাদের শিখিয়েছে মানবসম্পদের জন্য সবচেয়ে জরুরি সহকর্মীদের পাশে থাকা।
● মোহাম্মদ মাহবুব কায়সার উপব্যবস্থাপক, মানবসম্পদ বিভাগ
পলাশ রঞ্জন ভৌমিক
প্রথম আলোর হিসাব বিভাগে মোট কর্মীর সংখ্যা ৩৬। বিরতিহীনভাবে প্রথম আলোর কার্যক্রম চালু রাখার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সব সময় অর্থের সরবরাহ ঠিক রাখা। অফিসের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রশাসন বিভাগের কাছে, বিজ্ঞাপনের ফ্রন্ট ডেস্কে কিছু নগদ অর্থ রেখে দেওয়া হয়। ফলে দৈনন্দিন প্রয়োজনের পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে কর্মীদের জন্য করোনা প্রতিরোধের বিভিন্ন সামগ্রী যখন যেটা প্রয়োজন তা সহজে পাওয়া গেছে। করোনায় আক্রান্ত কর্মীদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা করতে গিয়ে চেকের স্বাক্ষরের জন্য লালমাটিয়ায় সম্পাদক মহোদয়ের বাসা, হিসাব বিভাগের ঊর্ধ্বতনদের বাসা, গুলশান হেড অফিসে অনেক দৌড়ঝাঁপ করতে হয়।
নতুন ভ্যাট আইনের কারণে প্রতি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে ভ্যাট রিটার্ন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় ও সরকারের পক্ষ থেকে তা স্থগিত করার কোনো নির্দেশনা না থাকায় ট্রান্সকম গ্রুপ থেকে জরুরি ভিত্তিতে ভ্যাট রিটার্ন জমা দিতে বলা হয় এবং যথাসময়েই ভ্যাট রিটার্ন জমা দেওয়া হয়। রিটার্নের কাজ করার জন্য একজন কর্মীকে টঙ্গী থেকে এসে কয়েক দিন টানা অফিস করতে হয়, আরেকজনকে তখনকার রেড জোন মোহাম্মদপুরের লকডাউন ভেঙে অফিস করতে হয়। অফিস থেকে যাতায়াতে সিএনজির ব্যবস্থা করা হয়।
হিসাব বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ও উপমহাব্যবস্থাপক কর্মীদের সঙ্গে বসে কে কবে অফিস করবেন তার একটি তালিকা করে দেন। অফিস ও হোম অফিস দুটোই চলেছে এভাবে। অফিস থেকে ল্যাপটপের ব্যবস্থা করা হয়। কাজ করতে গিয়ে বারবার ইন্টারনেটের ধীরগতি যাতে কাজে ব্যাঘাত না ঘটায়, তাই দ্রুতগতির ইন্টারনেট–সংযোগ নেওয়া হয়। অন্যান্য বিভাগের মতো পুরোপুরি হোম অফিস করা হিসাব বিভাগের পক্ষে সম্ভব ছিল না। অফিসে আসার পাশাপাশি প্রায় প্রতিদিনই অনলাইনে জুম মিটিং করে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ সময় এই বিভাগের ৩ জন কর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আক্রান্ত হওয়ার পরও কোনো কাজ থেমে থাকেনি। প্রথম আলো ডিজিটালের যাবতীয় হিসাব দেখেন এমন একজন করোনায় আক্রান্ত অবস্থায়ও বাসা থেকে সার্বক্ষণিক কাজ চালিয়ে গেছেন। এলসি, ভ্যাট, ট্যাক্স, বিল-ভাউচার, ভেন্ডর পেমেন্ট, কাস্টমারদের বিল প্রদান, কালেকশন, প্রতি মাসে কর্মীদের বেতন–ভাতা সময়মতো দেওয়াসহ মাসিক আয়-ব্যয়সংক্রান্ত তথ্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সঠিক ও নির্ভুলভাবে যথাসময়ে হিসাব বিভাগ থেকে দেওয়া হয়।
●পলাশ রঞ্জন ভৌমিক উপমহাব্যবস্থাপক, হিসাব