করোনার শুরুর দিকে মৃত্যুর একেকটি সংবাদে বুক হিম হয়ে আসছিল, দীর্ঘ হচ্ছিল মৃত্যুর মিছিল। গত ১৮ মার্চ দেশে করোনায় প্রথম মৃত্যু, ১৬ জুন পর্যন্ত সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২৬২। ১৭ জুন প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ১২০ জনের ছবি, নাম ও পেশা প্রকাশ করা হয়। শুধু ওই দিনই নয়, পরপর চার দিন প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে চলে সেই শোকাবহ আয়োজন। সংবাদপত্রের ইতিহাসে এটি ছিল ব্যতিক্রমী ও সাহসী উদ্যোগ।
প্রথম আলোর পাঠক এভাবে প্রতিদিন প্রথম পাতাজুড়ে মৃত মানুষের ছবি দেখে কী প্রতিক্রিয়া জানাবেন, তা নিয়ে আমাদের ভাবনার অন্ত ছিল না। কিন্তু টানা চার দিন ছাপার পর এ নিয়ে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনা করে আমাদের মূল্যায়ন ছিল, পাঠক ভালোভাবেই বিষয়টি নিয়েছেন। অনেকের মত ছিল, ঘটনার গুরুত্ব ও ভয়াবহতা বিবেচনায় প্রথম আলো পাঠকদের নতুন কিছু দিতে পেরেছে।
করোনাকালে ছোট কাজটি করতে গিয়ে বড় ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলাম। প্রথমে মনে হয়েছিল, মৃত ব্যক্তিদের নাম, পেশা ও ঠিকানা পাওয়া কঠিন কিছু নয়। কিন্তু কাজে নামার পর মনে হলো, খুব কঠিন। কারণ, করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা তখন পর্যন্ত প্রকাশ করা হতো না। সরকারিভাবেও তখন নাম প্রকাশ করা নিষিদ্ধ ছিল। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করলে স্বজনেরা বিব্রত হতেন। করোনায় আক্রান্ত মাকে রেখে ছেলের পালিয়ে যাওয়া, স্বামীকে স্ত্রী বা স্ত্রীকে স্বামীর ফেলে যাওয়া এবং বাস-ট্রাক থেকে করোনায় আক্রান্ত সন্দেহভাজন যাত্রীকে নামিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাগুলো নিয়ে তখন সমালোচনার ঝড় বইছিল।
করোনায় আক্রান্ত হলে বা করোনায় মারা গেলেও এখন নাম-পরিচয় প্রকাশে বাধা নেই। কিন্তু মে-জুনে ছবি দূরে থাক, নামও প্রকাশ করা যেত না। তখন কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম প্রকাশ হয়েছে, যা এড়িয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যমের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
নিউইয়র্ক টাইমস প্রথম পাতায় ১০ হাজার মার্কিন নাগরিকের নাম প্রকাশ করে, যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ওই পত্রিকার শিরোনাম ছিল, ‘আমেরিকায় মৃতের সংখ্যা এক লাখের কাছে। এ এক বেহিসাবি ক্ষতি।’ নিউইয়র্ক টাইমস–এর ন্যাশনাল এডিটর মার্ক ল্যাসি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা এমন একটা কিছু করতে চেয়েছিলাম, যা ১০০ বছর পরও মানুষের মনে দাগ কাটবে। যা দেখে তখনো মানুষ বুঝতে পারবে এই সময়ে কতটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছিলাম।’
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে সব নাম ডুবে যাচ্ছিল পরিসংখ্যানের তালিকায়। এই মৃত্যু কেবল যে সংখ্যা নয়, প্রতিটি মৃত্যুর সঙ্গে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, সেটি তুলে ধরাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। ওই সময় মাহমুদ মনোয়ার নামের একজন চিকিৎসক ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘একজনের মৃত্যু, একটি ট্র্যাজেডি। যখন মৃত্যুসংখ্যা লাখ ছাড়ায়, তখন তা শুধুই পরিসংখ্যান।’ ১২ জুন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে মারা যান সহকারী অধ্যাপক ডা. মাহমুদ মনোয়ার।
প্রথম আলো সিদ্ধান্ত নেয়, ছবিসহ মৃত ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করবে। যতজনের ছবি পাওয়া যায়, ছাপা হবে। এই সিদ্ধান্ত জানালেন সম্পাদক মতিউর রহমান। সেই অনুযায়ী কাজ শুরু করি। কিন্তু ছবি তো আর পাওয়া যায় না। যুক্ত হন উপবার্তা সম্পাদক তুহিন সাইফুল্লাহ। তিনি সারা দেশে প্রতিনিধিদের এ সম্পর্কে তথ্য ও ছবি দিতে বললেন। কিন্তু ওই সময়ে বাইরে বের হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, বাসাবাড়িতে যাওয়া নিষেধ। তারপরও চেষ্টা চলতে থাকে, নাম পেলেই হবে না, ছবি পেতে হবে। আবার ছবি পেলেও পরিবারের অনুমতি লাগবে আর ক্রস চেক তো করতেই হবে। এ কাজে সহায়তা করেছেন অফিসের অসংখ্য সহকর্মী। নির্ভুল নাম ও ছবি ছাপার সেই যুদ্ধের পরও তিন-চারটি ভুল হয়, যা পরে সংশোধন করতে হয়েছিল।
করোনায় আক্রান্ত হলে বা করোনায় মারা গেলেও এখন নাম-পরিচয় প্রকাশে বাধা নেই। কিন্তু মে-জুনে ছবি দূরে থাক, নামও প্রকাশ করা যেত না।
সম্পাদক মতি ভাই প্রায় প্রতিদিনই তাগিদ দিতেন। সকালে উঠেই তাঁর ফোন, কী হলো, কতটুকু এগোল জানতে চাইতেন।
প্রথম দিন প্রতীকীভাবে ১২০ জনের নাম, পেশা ও ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল। এটি ছাপা হওয়ার পর চিকিৎসকদের প্রতিক্রিয়ায় সয়লাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। আমাদের পরিকল্পনা ছিল প্রথম দিন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ছবি ছাপব। এরপর পর্যায়ক্রমে চিকিৎসক, পুলিশ, ব্যবসায়ী, খেলোয়াড়, সাংবাদিকসহ অন্য পেশার প্রয়াতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। ভুল বা সঠিক যা-ই হোক, আমরা আগাম ঘোষণা দিইনি। কিন্তু প্রথম সংখ্যা ছাপা হওয়ার পর চিকিৎসকদের একটি অংশ ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখায়। ঘুম ভাঙে কয়েকজন চিকিৎসকের ফোনে; সহকর্মী শিশির মোড়ল, শেখ সাবিহা আলমসহ অনেকেই চিকিৎসকদের প্রতিক্রিয়া পান।
এই পরিস্থিতিতে পরামর্শ নিই বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব অধ্যাপক মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরীর। কারণ, তাঁর সহযোগিতা ছাড়া চিকিৎসকদের তালিকা তৈরি করা সম্ভব ছিল না। তাঁর পরামর্শ ছিল, যে যা বলার বলুক। কাল যখন চিকিৎসকদের তালিকা ছাপা হবে, তখন আর প্রতিক্রিয়া থাকবে না।
১৮ জুন ‘স্যালুট, বীর স্বাস্থ্য সুহৃদদের’ শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ছবি ছাপা হয়। এরপর প্রতিক্রিয়া অনেকটাই ম্লান হয়।
তৃতীয় দিন পুলিশ, আনসার ও সাংবাদিকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং চতুর্থ দিন ব্যাংক, সংস্কৃতি ও ক্রীড়াসংশ্লিষ্টদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা হয়।
বিশেষ ধরনের এ কাজে অনুসন্ধানের কোনো বিষয় ছিল না। কিন্তু পরিস্থিতিটা ছিল খুবই প্রতিকূল। বার্তাকক্ষে তখন আমরা মাত্র ৮-১০ জন কাজ করি, যেখানে করোনার আগে শতাধিক সাংবাদিক কাজ করতাম। বাকিরা বাসা থেকে কাজ করতেন। তখন নিজের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা, আতঙ্ক পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন ও সহকর্মীদের নিয়ে। এরই মধ্যে করোনায় মারা যাওয়া মানুষের ছবি ও তথ্য নিয়ে সপ্তাহ তিনেক কাজ করেছি।
সম্ভবত নবম বা দশম শ্রেণিতে পড়েছিলাম ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পটি। এর লেখক প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার, ঔপন্যাসিক ও গল্পকার জহির রায়হান। তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রথম প্রথম কাউকে মরতে দেখলে ব্যথা পেতাম। কেমন যেন একটু দুর্বল হয়ে পড়তাম। কখনো চোখের কোণে এক ফোঁটা অশ্রু হয়তো জন্ম নিত। এখন অনেকটা সহজ হয়ে গেছি। কী জানি, হয়তো অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে, তা–ই। মৃত্যুর খবর আসে। মরা মানুষ দেখি। মৃতদেহ কবরে নামাই। পরক্ষণে ভুলে যাই।’
গল্পের এই বর্ণনায় চোখের সামনে ভেসে ওঠে করোনাকালে মৃত্যুর ঘটনা। নিজের অনুভূতি ও উদ্ভূত পরিস্থিতির মিল খুঁজে পাই।
●শরিফুজ্জামান সাংবাদিক