একটি ছোট্ট ভূমিকা দিয়ে শুরু করি। বছর তিনেক আগে মি টু আন্দোলনে যখন বিশ্ব উত্তাল, সে সময় বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের নিউজের এক সাংবাদিক ও উপস্থাপকের জীবনের একটি গল্প বেশ সাড়া ফেলেছিল। শায়মা খালিল নামের ওই নারীর বেড়ে ওঠা ছিল মিসরে। ১১ বছর বয়সে রাস্তায় কতগুলো কিশোর বখাটের উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছিলেন তিনি। দগদগে ঘায়ের মতো এই স্মৃতি সব সময় বয়ে বেড়ান তিনি। সে সময় তিনি লেখেন, কাজের কারণে আর মিসরে থাকেন না, তবে যখনই সেখানে যান, রাস্তায় বের হতে ভয় পান। এমনকি নিজের এত বড় পরিচয় থাকা সত্ত্বেও একা একা বের হওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না তিনি।
একটা জিনিস খুব বিশ্বাস করি, প্রত্যেক নারীর অন্তরেই একটা গোপন কুঠরি আছে, যেখানে লুকিয়ে রাখা হয় তার প্রতি ঘটা প্রতিটি নিগ্রহের ঘটনা। বেশির ভাগ নারী কখনো কিন্তু সেই কথা প্রকাশ্যে আনে না। চিরায়ত একটি ভয় নিয়ে সেই কুঠরিকে লালন করে। সে একলা চলতে শঙ্কা লালন করে, সে প্রতিবাদ করতে ভয় পায়। গোপন ওই কুঠরি সব সময়ই মনের সাহসকে তালাবদ্ধ করে রাখে। তবে একসময় আমি আমার নিজের তালাটা ভাঙতে পেরেছি। আমাকে সাহস জুগিয়েছে আমার কর্মক্ষেত্র। শায়মা খালিল বিবিসির সাংবাদিক হয়ে যে ভয় কাটাতে পারেননি, আমি প্রথম আলোর কর্মী—এই সাহসে সেই ভয় দূর করার চেষ্টা করি।
আসলে একটি নারীবান্ধব পরিবেশই নারী কর্মীর মনে সাহস জোগাতে পারে। শঙ্কা দূর করতে পারে। কর্মক্ষেত্র কতটা নারীবান্ধব, তা কতজন নারী কর্মী কাজ করছেন, তা দিয়ে বিচার করা যায় না। কারণ, অনেক প্রতিষ্ঠানেরই আগ্রহ নারী কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি করার দিকে থাকে। অথচ কর্মক্ষেত্রটি নারীবান্ধব করার বিষয়ে অতটা তৎপরতা লক্ষ করা যায় না। আসলে নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ কী, সে সংজ্ঞাই জানে না অনেকে। কর্মক্ষেত্রে নারীবান্ধব পরিবেশের অর্থ হলো কর্মক্ষেত্রের এমন বিধান স্থাপন করা, যাতে নারী কর্মী কাজ এবং পারিবারিক দায়িত্ব সমান্তরালভাবে পালন করতে সক্ষম হন। বাংলাদেশের বেশির ভাগ কর্মক্ষেত্রে এই বিধানের অনেক নড়চড়ই লক্ষ করা যায়। যেমন অনেক সময় দেখা যায়, কাজ না থাকলেও আটকে রাখা হচ্ছে, ঘরে ফেরার ক্ষেত্রে নিরাপদ কোনো ব্যবস্থা দেওয়া হচ্ছে না, মাতৃত্বকালীন ছুটিতে গেলে ছাঁটাই করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে ছোট-বড় নানা ধরনের হয়রানি, এমনকি যৌন হয়রানির মতো ঘটনাও ঘটে। এসব কারণে প্রায়ই কাজ ছাড়তে বাধ্য হন নারী। কর্মক্ষেত্রে নারী যৌন হয়রানি, শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, মজুরিবৈষম্য, পদবৈষম্য ও নিরাপত্তাহীনতার মতো বৈষম্যের শিকার হন।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমজগতে প্রথম আলো এমন একটি কর্মক্ষেত্র তৈরি করেছে, যেখানে নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়। পাশাপাশি লিখিত নারী নীতিমালাও রয়েছে। প্রথমে আসি নারীবান্ধব কর্মপরিবেশের বিষয়ে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নারী ও পুরুষের সমতা তৈরি করতে হলে নারীর কাজের ক্ষেত্রে বাড়তি একটু যত্নের প্রয়োজন পড়েই। আমাদের দেশে একজন নারীকে পারিবারিক নানা ভূমিকা পালন করতেই হয়। সন্তানের সুরক্ষা নিশ্চিত করেই তবে কাজ করতে পারেন তিনি। সেই সঙ্গে নিরাপদ যাতায়াতব্যবস্থা, কর্মপরিবেশে স্বাচ্ছন্দ্য—সবকিছুই নারীর কাজের ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা রাখে।
প্রথম আলোতে প্রত্যেক নারী কর্মীর পারিবারিক অবস্থার খোঁজ রাখা হয়। এখানে অনেক নারী কর্মীকেই তাঁদের প্রয়োজনমতো সময়ে কাজের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নারীদের নিয়ে আলাদাভাবে বসা হয়। তাঁদের সুবিধা-অসুবিধার কথা শোনা হয়, তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। রাতে নারী কর্মীর নিরাপদে বাড়ি ফেরা নিশ্চিত করা হয়। ছোট ছোট বিষয়েও সূক্ষ্ম নজর দেওয়া হয়। নিয়মিত সন্তানদের খোঁজখবর নেওয়া হয়। এ ছাড়া কর্মক্ষেত্রে নারী যাতে কোনো হয়রানির শিকার না হন, সে জন্য ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি রয়েছে। সেই সঙ্গে এখানে কোনো নারীকে ভাষাগত লিঙ্গসন্ত্রাসের শিকার হতে হয় না।
মাতৃত্বকালীন সময়েও নারী কর্মীর সুবিধা-অসুবিধার ক্ষেত্রে পুরোপুরি নজর রাখে প্রথম আলো। এ সময় কর্মক্ষেত্রে বাড়তি একটু সুবিধা, একটু যত্ন নারীর মানসিক শক্তি অনেক বাড়িয়ে দেয়। প্রথম আলোতে ছয় মাসের বৈতনিক মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া তো হয়ই। সেই সঙ্গে কোনো অন্তঃসত্ত্বা নারী কর্মীর শারীরিক সমস্যা থাকলে তাঁকে পরিবহনসুবিধা দেওয়া হয়। প্রয়োজনমতো ছুটিও দেওয়া হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, এ সবকিছু তাঁর পদোন্নতিতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না। প্রথম আলোর একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত হচ্ছে, এখানে নারী বা পুরুষ আলাদা বিবেচনায় কোনো মজুরিকাঠামো নেই। এ ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য চোখে পড়ে না।
এ ছাড়া নারীদের জন্য বিশেষ দিবসের আয়োজনে প্রথম আলোর পুরুষ সহকর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখার মতো। নারী দিবসে প্রত্যেক নারী কর্মী সম্পাদকের হাত থেকে ফুল ও উপহার গ্রহণ করেন। একটি কর্মক্ষেত্র কতটা নারীবান্ধব, কতটা পুরুষবান্ধব, সেটি অনেকাংশেই ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ওপর নির্ভর করে। আমার একটি সমস্যাকে কতটা অনুভব করছেন পাশের সহকর্মী, তিনি নারী হোন আর পুরুষই হোন—এটি কাজের পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
এবার আসি নীতিমালার কথায়। প্রথম আলোর প্রতিটি লেখায়, প্রতিটি কনটেন্টে নারীর প্রতি সম্মান ও সমর্থন বজায় রাখা হয়। এ জন্য লিখিত নীতিমালা তৈরি হয়েছে। সময়–সময় সংশোধন করে আরও পরিমার্জিত হয় সে নীতিমালা।
লেখা, ছবি বা কার্টুনে নারীর প্রতি লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, ছাঁচে ঢালা ধারণা, সংস্কার, নেতিবাচক ইঙ্গিত বা বার্তা প্রকাশে সর্বোচ্চ সচেতন থাকে প্রথম আলো। কোনো লেখায় বা বিষয়ে অহেতুক ‘নারী’ শব্দ টেনে না আনা, নারীবিদ্বেষী বক্তব্য বা নারীকে হেয় করে কোনো শিরোনাম দিয়ে পাঠক টানার চেষ্টা প্রথম আলোর নীতি নয়। ধর্ষণ, অ্যাসিড হামলা, যৌতুক বা অন্যান্য নারী নির্যাতনের সংবাদের ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার নারীর নাম তো নয়ই, এমনকি তাঁর পারিবারিক কোনো পরিচয়ও দেওয়া হয় না। বিশেষ ক্ষেত্রে নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হলে পরিবারের অনুমতি সাপেক্ষেই তা করা হয়।
প্রথম আলো ‘মহিলা’, ‘ধর্ষিতা’ শব্দ এড়িয়ে চলে। পতিতাপল্লি বলে না, কাউকে অপরাধী চিহ্নিত করে ঢালাওভাবে মন্তব্য দেয় না। এমনকি কোনো নারী অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত হলে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ওপর জোর দিয়ে তাঁর নাম-পরিচয়সহ প্রকাশ করা হয়। ঢালাও দোষারোপ, কলঙ্ক আরোপজাতীয় ইঙ্গিত দেওয়া হয় না। আরও উল্লেখযোগ্য হলো, নীতিমালার প্রতিটি বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময় কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়।
হ্যাঁ, এ কথা হয়তো ঠিক, যেকোনো ক্ষেত্রেই শতভাগ অর্জন মোটেও সহজ নয়। প্রথম আলোর নারীনীতি পালনের ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই ভুলত্রুটি হয়। অসতর্কতায় লজ্জিত হই নিজেরাও। তবে এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক করার পরিবেশ আমাদের আছে। আর সেটাই হয়তো শক্তি।
●শাকিলা হক প্রথম আলোর সহসম্পাদক