হঠাৎ করেই অফিস থেকে নতুন একটি মন্ত্রণালয়ে কাজ করার দায়িত্ব পেলাম। করোনাকালে মন্ত্রণালয়টি ছিল সবচেয়ে ব্যস্ত, সবচেয়ে আলোচিত আবার সবচেয়ে সমালোচিত। এর নাম স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
পররাষ্ট্র থেকে স্বরাষ্ট্র, মুক্তিযুদ্ধ থেকে আইন, অর্থনীতি থেকে স্থানীয় সরকারসহ প্রায় সব বিটে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকলেও এই বিটে আমি কখনোই কাজ করিনি। সম্পাদকের ফোন পেয়ে উৎসাহী হয়ে নেমে পড়লাম।
তখন করোনা নিয়ে ভীষণ আতঙ্ক ছিল। খুব দরকার ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হতেন না। মুখে ডাবল মাস্ক, মাথায় কভার আর মনে ভয় নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাওয়া শুরু করলাম সচিবালয়ে। দেখি, লোকসমাগম তেমন নেই, সব মন্ত্রীর দপ্তর ফাঁকা। ভাবলাম, সপ্তাহের শুরু, করোনাকাল। নিশ্চয়ই অন্য মন্ত্রণালয়ে লোকজন না থাকলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভরা থাকবে, কিন্তু সেখানে আরও ফাঁকা। স্বয়ং মন্ত্রীই অফিস করছেন না।
প্রথম দিন খুব হতাশা নিয়ে ফিরলাম। শীর্ষ ব্যক্তিদের তেমন কেউ-ই নেই মন্ত্রণালয়ে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক শেষ কবে কর্মস্থলে গিয়েছিলেন, তা চট করে বলতে পারলেন না মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এই শীর্ষ ব্যক্তি নিয়মিত তাঁর দপ্তরে যান না। এই মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের সচিব একজন করোনায় আক্রান্ত, অন্যজন স্ত্রীর করোনায় মৃত্যুর পর আইসোলেশনে রয়েছেন। মন্ত্রণালয় ঘুরে তেমন কোনো কর্মতৎপরতা দেখা যায়নি। তখন সেখানে গুটিকয় কর্মকর্তা-কর্মচারী, লিফটম্যান ছাড়া কাউকে চোখে পড়েনি। দেখা পাওয়া যায়নি মন্ত্রীর একান্ত সচিব কামরুল হাসান ও তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মাইদুল ইসলামকে। তাঁরা বিভিন্ন কারণে অনুপস্থিত ছিলেন।
করোনাকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর তৎপরতা দৃশ্যমান নয় কেন, জানতে নানাভাবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। তাঁর একান্ত সচিব, জনসংযোগ কর্মকর্তা, ব্যক্তিগত সহকারী—সবার সঙ্গে দফায় দফায় বেশ কয়েক দিন যোগাযোগ করা হলে, মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠানোর পরও তিনি কথা বলতে রাজি হননি। করোনা পরিস্থিতিতে যখন সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সক্রিয় এবং প্রতিদিনই কেউ না কেউ মারা যাচ্ছেন, তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নিষ্ক্রিয়তা নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়।
এমন পরিস্থিতিতে গত ২৫ জুন প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ছাপা হয় ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী অফিস করেন না’। আমার এই প্রতিবেদন সেদিন বেশ আলোচিত হয়। নানা মন্তব্যে ভরে যায় প্রথম আলোর অনলাইন ও ফেসবুক পাতা। আর প্রতিবেদনটি প্রকাশের দিনেই বেলা সাড়ে ১১টায় সচিবালয়ে হাজির হন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এরপর প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে মন্ত্রণালয়ে। নথিপত্র নিয়ে ছোটাছুটি শুরু হয়।
করোনাকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একের পর এক অনিয়ম ও কেলেঙ্কারি প্রকাশ হয়ে পড়ে। মাস্ক ও ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) কেনায় দুর্নীতি, কোভিড পরীক্ষার নামে জালিয়াতি, অনুমোদন বা লাইসেন্স ছাড়া হাসপাতাল পরিচালনা, যোগ্যতা না থাকলেও পাঁচটি হাসপাতালকে কোভিড পরীক্ষা ও চিকিৎসার অনুমতি দেওয়া এবং পরে তা বাতিল—একের পর এক এসব ঘটনায় স্বাস্থ্য খাত সমালোচনার চূড়ায় ওঠে। একপর্যায়ে রিজেন্ট হাসপাতাল এবং জিকেজির কেলেঙ্কারির ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শক্ত অবস্থান নেয়। গণমাধ্যমে এসব তথ্য প্রকাশ হওয়ার প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসে। লাইসেন্সবিহীন রিজেন্ট হাসপাতালের অপকর্ম প্রকাশ হওয়ার পর প্রশ্ন ওঠে, করোনা চিকিৎসার মতো স্পর্শকাতর দায়িত্ব এই প্রতিষ্ঠান কীভাবে পেল। এর দায় কার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দেয়। এতে বলা হয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করা হয়েছিল। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই ব্যাখ্যায় ক্ষুব্ধ হয় মন্ত্রণালয়। শেষমেশ এ ঘটনার রোষানলে পড়ে পদ ছাড়েন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
১৩ জুলাই ‘স্বাস্থ্যে কেলেঙ্কারির দায় কার’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর রিজেন্টের সঙ্গে চুক্তিতে মন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা, সচিবদের উপস্থিতি, এ ঘটনা বিদেশে বাংলাদেশের প্রশ্নবিদ্ধ একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া চিকিৎসক ও নার্সদের হোটেল বিল, লাইসেন্স নবায়নপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন, চিকিৎসকদের পদোন্নতি, গাড়ি ব্যবসায়ীকে স্বাস্থ্যের কাজ দেওয়াসহ নানা অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করি।
পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০ এপ্রিল থেকে প্রথম আলো হোম অফিস চালু করলেও নারী সহকর্মীদের মার্চের শেষ দিকেই বাসা থেকে কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। আমার কন্যা আলভিনা ইসলামের বয়স মাত্র আট বছর, ওর বাবা হৃদ্রোগী। তাই প্রথম থেকেই আমাদের ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে যেতে হয়েছে। করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে আমাকে একাই সংসার ও অফিসের কাজ সামলাতে হয়েছে। বাসায় বসে কাজের অভিজ্ঞতা আগে ছিল না, এর মধ্যে শিশুসন্তান থাকলে যা হয়। আমাদের ভবনের অনেকেই আক্রান্ত হওয়ার পর আমরা আরও ভয় পেতে থাকি। অবস্থা এমনই যে আমাদের মানসিক চিকিৎসকের সহযোগিতা নিতে হয়েছে। এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমাদের পরিচিত একজন স্বজন মারা গেলে আলভিনার বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। সম্পাদক মতি ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করার পর তিনি সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হন আমার শাশুড়ি এবং ভাশুর ও দেবরের পরিবার। এ পরিস্থিতিতে আমরা মানসিক চাপে পড়ে যাই। এখনো সেই চাপ চলছে। এরই মধ্যে কাজ করে যাচ্ছি। তবে কাজই কিছুটা মানসিক শান্তি দিয়েছে। অফিসের নিয়োগ দেওয়া দুজন চিকিৎসক এই সময়টায় আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন।
● রোজিনা ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক