করোনা! করোনা বাংলাদেশে আসবে না, করোনা গরমকালে হয় না—এ ধরনের কথাবার্তা চলতে চলতে মার্চের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। বাংলাদেশের অন্য সব মানুষের মতো প্রথম আলোর কর্মীদের বড় অংশ করোনা নিয়ে কিছু আতঙ্ক ও সংশয়ের মধ্যে ছিল। আমি নিজেও আতঙ্কিত ছিলাম।
যেহেতু আমি প্রথম আলোতে প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসক হিসেবে নিয়োজিত, আমাকে রোগীদের সংস্পর্শে আসতে হয়। তাই প্রথম আলো আমার যাবতীয় ব্যক্তিগত নিরাপত্তাসামগ্রী নিশ্চিত করে। সর্বোপরি অফিসে প্রবেশের আগে সবার শরীরের তাপমাত্রা মাপা, হাত জীবাণুমুক্ত করা, কাপড় জীবাণুমুক্ত করা, লিফটে একসঙ্গে পাঁচজনের বেশি ওঠানামা না করা, অফিসে থাকাকালে মাস্ক ব্যবহার করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করার পাশাপাশি একটি সময় কর্মীদের বাসায় অনলাইনে কাজ করার ব্যবস্থা করা।
শুরুর দিনগুলোতে আমার কাছে আসা রোগীদের প্রায়ই প্রশ্ন থাকত, কী করলে করোনা হবে না, কী খাওয়া যাবে, কী খাওয়া যাবে না। শরীরের তাপমাত্রা একটু বেশি হয়ে যেতেই কেউ কেউ অনেক চিন্তিত হয়ে পড়তেন। তখন সবার মধ্যেই গরম পানি ও লেবু খাওয়ার একটা প্রতিযোগিতা লক্ষ করলাম। এরই মধ্যে এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এক কর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। এ খবর শোনার পর অফিসের অনেকেই আরও বেশি আতঙ্কিত হন।
শুরুর দিনগুলোতে আমার কাছে আসা রোগীদের প্রশ্ন িছল, কী করলে করোনা হবে না, কী খাওয়া যাবে, কী খাওয়া যাবে না। শরীরের তাপমাত্রা একটু বেশি হলেই কেউ কেউ চিন্তিত হয়ে পড়তেন।
শুরু হয় ‘হোম অফিস’। তখন থেকেই টেলিমেডিসিন চিকিৎসাসেবা চালু করা হয়। এরই মধ্যে পবিত্র রমজান মাস চলে এল। বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকল। তেমনি আমার মুঠোফোনেও প্রতিদিন নতুন নতুন ফোন আসতে থাকল। পরীক্ষায় পজিটিভ—এ কথা শোনামাত্র কেউ কেউ মানসিকভাবে ভেঙে পড়তেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা মোকাবিলায় টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট—এ কথা বলে আসছিল। আমাদের দেশে পর্যাপ্তসংখ্যক টেস্ট করা সম্ভব হয়নি। তাই যখনই কেউ আমাকে করোনার উপসর্গ নিয়ে কল দিতেন, আমি প্রথমে ওই ব্যক্তির আইসোলেশন নিশ্চিত করতাম। সময়ের সঙ্গে যেমন রোগী বাড়ছিল, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল করোনা হাসপাতালগুলোতে শয্যার সংকট।
প্রথম আলোর এক কর্মীর শরীরের অক্সিজেনের পরিমাণ কমতে থাকায় হাসপাতালে ভর্তি করাতে বলি। কিন্তু কোনো হাসপাতালেই ভর্তি করা যাচ্ছিল না। এ অবস্থায় রোগীর স্বজনেরা অনেক চেষ্টা করে ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করেন। যাঁরা এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন, তাঁরাই বুঝতে পারেন কতটা অসহায় ছিলেন তখন। এ রকম আরও নানা রকমের অসহায়ত্বের ঘটনা আছে। একেকজন আক্রান্ত রোগী যেন এক একটি অসহায়ত্বের ইতিহাস। আমি আমার জায়গা থেকে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করেছি।
যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই কথা বলি এবং উপসর্গ অনুযায়ী চিকিত্সাসেবা দিই। যদিও এখনো করোনাভাইরাসের জন্য সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাব্যবস্থা চালু হয়নি। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে, প্রথম আলোর কর্মীরা যাঁরাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে সুস্থতার হার শতভাগ। এটি সম্ভব হয়েছে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষের পরিবারের মতো খোঁজখবর ও সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। জীবন এখন ‘নতুন স্বাভাবিক’ হয়ে পড়েছে, কিন্তু করোনাভাইরাস আমাদের মধ্যেই রয়ে গেছে। দেশে এখনো প্রতিদিন ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, মাস্ক ব্যবহার করি। অপ্রয়োজনে বাইরে না যাই। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করি।
●মো. মহিবুল্লাহপ্রথম আলোর প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসক