শিরোনাম কি কখনো সংবাদের গুরুত্বকে ছাপিয়ে যায়? উত্তর হলো, কখনো কখনো যায়।
শিরোনামকে বলা হয় সংবাদের বিজ্ঞাপন। শিরোনাম দেখেই পাঠক খবরের ভেতরে প্রবেশ করেন। শিরোনামের নিজস্ব গুণাগুণ তাই থাকতেই হবে। আর পাঠকের চোখ তো সব শিরোনামে আটকায়ও না। কখনো কখনো শিরোনাম তার নিজ গুণে সংবাদের গুরুত্বকে ছাপিয়ে যাবে, সেটিই স্বাভাবিক।
‘উনিশের হাত ধরে বিশে বিশ্বজয়’—২০২০ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত শিরোনাম সম্ভবত এটিই। সেদিন ঘটনাটাই এমন অভূতপূর্ব ছিল যে সেই খবর আসলে এ রকম একটি শিরোনামই দাবি করছিল।
এ বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে নতুন ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল। পরাক্রমশালী ভারতকে হারিয়ে যুব বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ! সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে উৎসবের ঢেউ আছড়ে পড়ল এ দেশেও। ক্রিকেটের সুবাদে বিজয়ে সুবাসিত রাত আগেও এসেছে বাংলাদেশের মানুষের জীবনে। কিন্তু বিশ্বজয়ের রাত তো আর আসেনি! আবার কবে আসবে, সেটিও অনিশ্চিত। এমন গৌরবময় রাতে তাই উদ্যাপনে কমতি থাকা উচিত নয়।
প্রথম আলোর পাতায় সেটির কমতি ছিলও না সেদিন। প্রথম পাতায় ট্রফি নিয়ে বিশ্বজয়ী যুবাদের উল্লাসের চার কলাম ছবি। ওপরে কাগজের এ মাথা থেকে ও মাথা ব্যানার শিরোনাম ‘উনিশের হাত ধরে বিশে বিশ্বজয়’। সাংবাদিকতার মৌলিক ব্যাকরণ প্রতিবেদনের শুরুতে ‘ফাইভ ডব্লিউ, ওয়ান এইচ’–এর কথা বলে। অনলাইন সাংবাদিকতার যুগে ছাপা সংস্করণে সেই শর্ত সব সময় মানা না গেলেও সেদিনের ওই এক শিরোনামেই যেন লিখে দেওয়া হলো সব প্রশ্নের উত্তর। বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ যুবাদের ২০২০ সালে বিশ্বজয়ের পুরো গল্পই জায়গা হয়ে গেল পাঁচ শব্দের শিরোনামে।
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটু একটু করেই প্রথম আলো এগিয়ে যায় লক্ষ্যপূরণের দিকে। সেখানে কারও কথার ছলে বলা কথাও টুকে রাখেন আমাদেরই কেউ।
খবরের শিরোনাম দেওয়া পত্রিকা অফিসের প্রতিদিনকার কাজ। কিন্তু এমন হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া শিরোনাম তো আর প্রতিদিন হয় না। গল্প আছে এর পেছনেও। সেদিন যখন খেলা চলছিল, পচেফস্ট্রুমের ঈশান কোণে দেখা যাচ্ছিল বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা; প্রথম আলোর বার্তাকক্ষে তখন এলেন ফিচার সম্পাদক সুমি আপা (সুমনা শারমীন)। টেলিভিশনে খেলা দেখতে দেখতে তিনি বলছিলেন, ‘আজ বাংলাদেশ জিতলে ব্যানার হেডিং হওয়া উচিত। আমি হলে হেডলাইন দিতাম “উনিশের হাত ধরে বিশে বিশ্বকাপ।”’
সুমি আপা কথার ছলেই বলেছিলেন কথাটা। কিন্তু তাঁর সেই কথার ছলে বলা শিরোনাম আটকে যায় প্রধান বার্তা সম্পাদক লাজ্জাত ভাইয়ের (লাজ্জাত এনাব মহছি) মস্তিষ্কে। তিনি সুমি আপার কাছে আবার শিরোনামটা শুনে নেন, টুকে রাখেন একটা কাগজে।
রাতে যখন আকবর আলীদের বিশ্বজয়ের সাফল্যে গোটা দেশ আনন্দে ভাসছে, লাজ্জাত ভাইয়ের ফোন গেল সুমি আপার কাছে। সুমি আপা তখন গাড়িতে, বাসার কাছাকাছি। লাজ্জাত ভাই বললেন, ‘আপনার দেওয়া শিরোনামটাই আমরা রাখছি।’ এরপর তিনি কথা বলেন ক্রীড়া বিভাগের সঙ্গে। এমন দুর্দান্ত একটা শিরোনাম নিয়ে দ্বিতীয় কথা বলার কোনো কারণ ছিল না। তবে আমাদের মনে হলো, ‘বিশ্বকাপ’–এর জায়গায় ‘বিশ্বজয়’ হলে শিরোনামের বক্তব্যটা আরও স্পষ্ট হয়। লাজ্জাত ভাই একমত, তা–ও তিনি সেটা আবার ফোনে জানালেন সুমি আপাকে। সুমি আপাও একমত। ব্যস, এভাবেই দাঁড়িয়ে গেল পাঠকের মনে জায়গা করে নেওয়া এক শিরোনাম—‘উনিশের হাত ধরে বিশে বিশ্বজয়’।
পরদিন সেই শিরোনাম যেন বিশ্বজয়ের চেয়েও বড় খবর! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হতে সময় লাগল না সুমি আপার শিরোনাম। যাঁরা পত্রিকা হাতে নিয়েছেন, শিরোনামের ছন্দে-গল্পে শিহরিত হলেন। যাঁরা অনলাইনে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দেখেছেন, তাঁরাও সমানে লাইক-শেয়ার দিতে থাকলেন তাতে।
প্রথম দলে ছিলেন স্বয়ং প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিস ভাই (আনিসুল হক)। শিরোনাম কে দিয়েছেন না জেনেই তিনি ঘোষণা দিয়ে দেন, এই শিরোনাম যিনি দিয়েছেন, তাঁকে অর্থ পুরস্কার দেবেন। ফোনে সেটা জানালেন সুমি আপাকে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন সুমি আপা। আনিস ভাইয়ের কাছে সঙ্গে সঙ্গে দাবি করে বসলেন, ‘তাহলে দিয়ে দিন টাকাটা আমাকে...।’ আনিস ভাই প্রতিশ্রুত টাকা দিলেন। সেই টাকায় মিষ্টি খাওয়া হলো প্রথম আলোতে। মিষ্টির আবার দুই রকম স্বাদ। মন ছুঁয়ে যাওয়া এক শিরোনামের তো বটেই, বিশ্বজয়েরও।
সুমি আপা খেলার মানুষ নন। খেলা নিয়ে এমন দুর্দান্ত একটা শিরোনাম তাঁর মাথায় আসার পেছনেও নিশ্চয়ই কোনো গল্প আছে। প্রায় ৯ মাস পর তাঁর কাছে জানতে চাইলাম সে রহস্য। সুমি আপা হেসে বলেন, ‘কিছুই না রে ভাই। আমি শুধু প্রথার বাইরে কিছু করার কথা চিন্তা করেছিলাম। ১৯ আর ২০ নিয়ে খেলতে চেয়েছিলাম।’ মাথায় শিরোনামের খেলা খেলতে খেলতেই সুমি আপা সেদিন ভেবেছিলেন, আমরা আমাদের প্রথম বিশ্বকাপ জিতলাম ছোটদের হাত ধরে। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ জয় বড় ব্যাপার তো বটেই। কিন্তু প্রথম সেই বিশ্বকাপ যাঁদের হাত ধরে এল, শিরোনামে তাঁদের কথাটাই জোর দিয়ে বলতে হবে। সে জন্যই ‘উনিশের হাত ধরে...।’ ১৯–এর পরই আসে ২০, আর এটা তো ২০২০ সাল! ছন্দ মেলাতে সুবিধা হয়ে গেল। তাই ‘উনিশের হাত ধরে বিশে...।’ এরপর যুবাদের সেই গৌরবময় সাফল্য ‘বিশ্বজয়’-এর কথা, হয়ে গেল ‘উনিশের হাত ধরে বিশে বিশ্বজয়’–এর মালা গাঁথা।
শিরোনামের গল্প তো শুনলেন। কিন্তু গল্পের পেছনেও তো গল্প থাকে! সেই গল্প প্রথম আলোর গল্প। বাংলাদেশের যুবারা যেমন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিশ্বকাপ জিতেছেন, ১৯...২০ করে যেমন শিরোনামে হয়ে গেল বিশ্বজয়; প্রথম আলোর গল্পটিও তেমন।
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটু একটু করেই প্রথম আলো এগিয়ে যায় লক্ষ্যপূরণের দিকে। সেখানে কারও কথার ছলে বলা কথাও টুকে রাখেন আমাদেরই কেউ। একজনের কাজ সহজ করে দিতে এগিয়ে আসেন আরেকজন। চিন্তার, কাজের স্বাধীনতা এখানে সর্বত্র। এটাই প্রথম আলোর সৌন্দর্য।
●তারেক মাহমুদপ্রথম আলোর ক্রীড়া বিভাগের প্রধান