ঢাকার বাইরে গিয়েছিলেন মালিহা তানজুম চৌধুরী। বাসায় ফিরে এসে ঘরের আর সব জিনিসপত্রের সঙ্গে স্যুটকেসটাও গুছিয়ে রাখছিলেন। এপ্রিল মাসের ২৯ তারিখের কথা। সন্ধ্যায় মা-বাবা ঘরে ফিরে মেয়েকে স্যুটকেস গোছাতে দেখে বললেন, ‘আরও বড় স্যুটকেস লাগবে তোমার।’ মালিহার প্রশ্ন, ‘কেন?’ মা-বাবা রহস্যে আরও খানিকটা জট পাকালেন, ‘তোমার ই-মেইল চেক করো।’
মালিহা ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারলেন, কিন্তু ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। যখন মেইল খুলে যুক্তরাজ্যের ‘ওয়েলকাম স্যাংগার ইনস্টিটিউট’ থেকে স্বাগত-বার্তাটি দেখলেন, তখন ঠিকই ‘চক্ষু ও কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন’ হলো। মালিহার ভাষায়, ‘প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি! তবে স্বপ্ন দেখেছিলাম এটা ঠিক।’
স্বপ্ন দেখার মতোই অর্জন। ১৩৫টি দেশের ৪৮০ শিক্ষার্থীর প্রতিযোগিতায় টিকে যাওয়া পুরস্কারপ্রাপ্তদের একজন মালিহা। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) এই শিক্ষার্থী পড়ছেন প্রাণরসায়ন (বায়োকেমিস্ট্রি) বিষয়ে। নবম সেমিস্টার শুরুর আগে, অর্থাৎ গত বছরের শেষ দিকে চোখে পড়ে ওয়েলকাম স্যাংগার ইনস্টিটিউটের প্রতিযোগিতার খবরটি। আগ্রহের বিষয় জিনপ্রযুক্তি (জেনেটিকস), কিন্তু শিক্ষক অর্ণব আলম ও পরিবারের উৎসাহে কোমর বেঁধে নামলেন, পড়াশোনা শুরু করলেন জিনোমিকস বিষয়ে। জিনোমিকস কেন? কারণ, ওয়েলকাম স্যাংগার ইনস্টিটিউট এই বিষয়ে আগ্রহীদেরই প্রতিযোগিতায় ডাকে। দুই মাসের মধ্যেই জিনোমিকসে মজে গেলেন মালিহা। প্রতিযোগিতার নিয়ম অনুযায়ী বসলেন পরীক্ষায়। উতরেও গেলেন ভালোভাবে। তারপর এল বিলেতের ডাক।
ওয়েলকাম স্যাংগার ইনস্টিটিউট–বৃত্তান্ত
এই অলাভজনক ব্রিটিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির গোড়াপত্তন ১৯৯২ সালে। আগে পরিচিত ছিল ‘দ্য স্যাংগার সেন্টার’ এবং পরে ‘ওয়েলকাম ট্রাস্ট স্যাংগার ইনস্টিটিউট’ নামে। জিনোমিকস এবং জেনেটিকস বিষয়ে গবেষণাই এই প্রতিষ্ঠানের কাজ। এর নামকরণ হয়েছে দুবার নোবেলজয়ী ব্রিটিশ বায়োকেমিস্ট ফ্রেডেরিক স্যাংগারের নামে। জিনোমিকস এবং জেনেটিকসের গবেষণাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির সুনাম দুনিয়াজোড়া।
২০০২ সাল থেকে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে ওয়েলকাম স্যাংগার ইনস্টিটিউট। বিজয়ীরা পুরস্কার হিসেবে পায় তিন মাসের ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ। প্রতিষ্ঠানটির ক্যাম্পাস ইংল্যান্ডের দক্ষিণ ক্যামব্রিজশায়ারের গ্রাম হিংক্সটনে। বিজয়ীরা সেখানেই থাকেন এবং গবেষণা করেন। যাতায়াত ও অন্যান্য সুবিধাও বহন করে প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিযোগিতায় যা হয়
পরীক্ষা নেওয়া হয় দুই ধাপে। প্রথমে একটি দরখাস্ত ফরম পূরণ করতে হয়। সঙ্গে লিখতে হয় জিনোমিকসে আগ্রহের বিস্তারিত কারণ এবং স্যাংগার ইনস্টিটিউটে কেন যেতে চাই—তার ব্যাখ্যা। শিক্ষায়তনের দুটি রেফারেন্সও দরকার হয় এই পর্বে।
‘জিনোমিকসে যে আপনি আগ্রহী, তা কীভাবে বোঝালেন?’ প্রশ্ন করি মালিহাকে। উত্তরে বলেন, ‘আমি জীববিজ্ঞান ভালোবাসি। জেনেটিকস-ভক্ত। গবেষণাগারও ভালোবাসি। কিন্তু এসবের প্রযুক্তি নিয়ে ভয় ছিল। সবকিছুর সঙ্গে এই ক্ষেত্রটিও ডিজিটালাইজড হচ্ছে। কিন্তু অর্ণব আলম স্যার বলতেন, “নতুন কিছু শেখো”। শেষমেশ স্যারের কাছ থেকে সাহস পেয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। এবং দ্রুতই আবিষ্কার করলাম, বিষয়টি দারুণ। জিনোমিকসে আমার আগ্রহের জায়গা প্রাণীর বিলুপ্তি ঠেকানো। আমি সেটার ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম। এ ছাড়া ভাইরাসের বিবর্তন নিয়ে গবেষণার কথাও উল্লেখ করেছিলাম। ভাইরাসের বিবর্তন জানলে অনেক রোগবালাই প্রতিরোধ সম্ভব। এভাবেই বুঝিয়েছি যে আমি জিনোমিকসে আগ্রহী।’
প্রথম ধাপে টিকে গেলে পরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপে নির্ধারিত বিষয়ে একটি রচনা লিখতে বলা হয় প্রতিযোগীদের। এর মধ্যে বলে নেওয়া যায়, দ্বিতীয় ধাপে এবার টিকেছিলেন ৩৪ শিক্ষার্থী। মালিহার সঙ্গে বাংলাদেশিদের মধ্যে ছিলেন আইইউবির আরও দুজন—জাবালে রহমত ও হুমায়রা আলম। এবারের রচনার বিষয় ছিল ক্লিনিক্যাল ট্রান্সলেশনের সম্ভাবনা ও বাধাবিপত্তি। বেশ খটমট বিষয়। ব্যাখ্যা করলেন মালিহা, ‘মানুষ জন্ম নেওয়ার আগেই যদি গবেষণা করে বংশগত রোগের ব্যাপারে জানা যায়, তাহলে প্রতিরোধও সম্ভব। তবে এর অনেক ঝুঁকিও আছে। বিশ্বে এখন এই প্রযুক্তি খুব আলোচিত। তো এই প্রযুক্তির সম্ভাবনা ও বাধাগুলো দূর করার উপায় নিয়ে লিখতে হয়েছিল আমাকে।’
চলছে প্রস্তুতি
স্যুটকেস তো মালিহা গোছাচ্ছেনই। আগামী সেপ্টেম্বরে যাবেন যুক্তরাজ্যে। তবে ভালোভাবে নিজেকে প্রস্তুত করছেন জিনোমিকস এবং জেনেটিকস গবেষণার জন্য। স্যাংগার ইনস্টিটিউটে গিয়ে বাঘা বাঘা গবেষকের সঙ্গে থাকবেন। দেখবেন তাঁরা কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন, কীভাবে করছেন, কেন করছেন আর তা করে হচ্ছেটা কী। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো সেভাবে গবেষণা শুরু করতে পারেননি মালিহা। তবে আইইউবির স্কুল অব লাইফ সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার কাছেই তিনি কৃতজ্ঞ। উৎসাহ পেয়েছেন সব সময়। আর একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মা রিফাত আরা রোজের কথা বললেন একাধিকবার, ‘মা আমার জন্য সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।’ বাবা প্রকৌশলী আহসান উদ্দীন চৌধুরী ও ছোট বোন নাজিফা তাসনিম চৌধুরীর কথাও বললেন। ছোটবেলায় নানি যে বাংলা বই ও গানের পোকা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, তা-ও জানালেন আনন্দের সঙ্গে। বই তাঁর বড় বন্ধু। গান গাইতে ভালোবাসেন, ছবি আঁকলেও শান্তি পান। বিশ্বের বড় বড় প্রতিযোগিতায় যাঁরা অংশ নিতে চান, তাঁদের জন্য কী বলবেন? মালিহা বললেন, ‘আমি খুব ভিতু মানুষ। কিন্তু মা সব সময় বলেন, “নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো। ” এটা ঠিক, যেটা জানি না, সেটা নিয়ে ভয় থাকবেই। কিন্তু সেই ভয়কে জয় করতে হলে দরকার ধৈর্য ও পরিশ্রম।’