আকতার গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আপনার বাবা কে এম আকতারুজ্জামান। আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের পরিধি আরও বড় হয়েছে। আরও বিভিন্ন উদ্যোগ আপনি নিয়েছেন।
একটা প্রজন্মের পর যখন আরেকটা নতুন প্রজন্ম আসে, সেই প্রজন্মের নিজের কিছু ইচ্ছে থাকে, স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্নগুলো সে পূরণ করতে চায়। আমার বাবা এই প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন ১৯৭৬ সালে, ব্যবসা শুরু করেছেন তারও আগে। সেখান থেকে বাবা অনেক কষ্ট করেছেন, অনেক কিছু শিখেছেন, অর্জন করেছেন, সফল হয়েছেন। আমার বাবা দেশে পড়ালেখা করেছেন, আমি পড়েছি কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ফোয়েনিক্সে। বিদেশে থাকার কারণে হয়তো আমার ভাবনায় কিছুটা ভিন্নতা ছিল। আমি আমার ভাবনার প্রতিফলন প্রতিষ্ঠানে দেখতে চেয়েছি।
দায়িত্ব নেওয়ার পর শুরুতে আপনি কোন পরিবর্তনটা আনতে চেয়েছিলেন?
বিদেশ থেকে আসার পর আমার মনে হলো, আমাদের শিল্পকারখানা, বিশেষ করে আসবাবশিল্প অনেক বেশি ম্যানুয়েল (হস্তচালিত), অটোমেটেড (স্বয়ংক্রিয়) না। খুব বেশি যন্ত্র আমরা ব্যবহার করি না। কাঠ কাটার কাজটা যন্ত্রের মাধ্যমে হচ্ছে, কিন্তু একটা কাঠের সঙ্গে আরেকটা জুড়ে দেওয়া হচ্ছে হাতে। বিভিন্ন কারখানা ঘুরে, অনলাইন রিসার্চ করে আমি বোঝার চেষ্টা করলাম, আদৌ যন্ত্রনির্ভর হওয়ার প্রয়োজন আছে কি না। কারণ, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের এখানে শ্রমের মূল্য খুব কম। নানা রকম বিশ্লেষণ করে বুঝলাম, সবকিছু স্বয়ংক্রিয় করার দরকার নেই। যদি মানুষ আর যন্ত্রের কাজের একটা সামঞ্জস্য করতে পারি, তাহলেই আমরা সেরা ফল পাব। যন্ত্রের মাধ্যমে কাজটা নিখুঁত হয়। আবার মানুষও দরকার, কারণ দেশের প্রতি আপনার একটা দায়িত্ব আছে। ব্যবসার মাধ্যমে আপনি কর্মসংস্থান তৈরি করছেন। সবকিছু মাথায় রেখেই আমি পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করেছি।
ব্যবসায়ী হওয়ার ইচ্ছে কি ছোটবেলা থেকেই ছিল?
ইচ্ছে ছিল পাইলট হব। ছোটবেলায় সবারই বোধ হয় এই ইচ্ছা থাকে। কিন্তু ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। তিনি যে চাপিয়ে দিয়েছেন তা কিন্তু একেবারেই না। এমনভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন, বুঝতেও পারিনি কখন তাঁর স্বপ্নটা আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। ক্লাস থ্রি-ফোর থেকেই বলতে শুরু করেছিলাম, ‘আমি ব্যবসায়ী হব।’
ছোটবেলার এমন কোনো শিক্ষার কথা বলবেন, যেটা পরবর্তী সময়ে আপনার ওপর প্রভাব ফেলেছে? কোনো ঘটনা বা গল্প...
বাবাকে দেখেছি সব সময় তিনি আত্মীয়স্বজনকে সাহায্য–সহযোগিতা করার চেষ্টা করতেন—কাজ দিয়ে হোক, আর্থিকভাবে হোক। বাবা বলতেন, সবাই তো সব সময় ভালো অবস্থানে থাকবে না। যে যখন ভালো থাকবে, তার উচিত বাকিদের দেখে রাখা। নিজে ভালো করে, অন্যের জন্যও ভালো কিছু করার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। বাবার কাছ থেকে এটা আমি শিখেছি। আমি মনে করি, ছেলেবেলা হচ্ছে মানুষের ভিত। আপনি যদি ভিত শক্ত করে দিতে পারেন, তাহলে সেই ভিতের ওপর যত তলা ইচ্ছা তত তলা ভবন বানাতে পারবেন। সেই চেষ্টা আমার মা-বাবা করেছেন।
আপনি শিল্পকারখানায় যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানোর কথা বলছিলেন। এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। এখন যারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, ধারণা করা হচ্ছে আজ থেকে ১০-২০ বছর পর তাদের রোবটের সঙ্গে চাকরির প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। এ ব্যাপারটাকে কীভাবে দেখেন?
আমার মনে হয় না এত দ্রুত হবে। যেসব কাজ সহজ, সেগুলো যন্ত্রের মাধ্যমে হতে পারে। কিন্তু জটিল কাজের ক্ষেত্রে মানুষের প্রয়োজন। সব কাজই যদি রোবট দিয়ে করাতে চান, খরচ অনেক বেশি হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, আমি মনে করি যে পরিবর্তনটা আসবে, তা হলো কাজ পেতে হলে মানুষকে আরও বেশি দক্ষ হতে হবে। যে মানুষ কারখানায় যন্ত্রের সঙ্গে কাজ করবে, তারও হয়তো একটা ডিপ্লোমা করে আসতে হবে। যেন সে যন্ত্র চালনা, রক্ষণাবেক্ষণ, সবই করতে পারে। এখন যেমন ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েও অনেকে কাজ পাচ্ছে, সেটা আর হবে না।
আমরা দেখি, ব্যবসার ধরন বদলে যাচ্ছে। বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠান, যেমন ফেসবুক বা অ্যামাজন, তাদের দৃশ্যমান কোনো পণ্য নেই। তারা স্রেফ একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছে, যেটা সারা বিশ্বের মানুষ ব্যবহার করছে। আপনার কী মনে হয়, আমাদের তরুণেরা যদি এগিয়ে থাকতে চান, তাহলে তাঁদের কোন খাতে কাজ করা উচিত?
আমি বলব, তোমার যা করতে ভালো লাগে, তুমি তা-ই কোরো। তোমার আগ্রহই তোমাকে পথ দেখাবে। একটা বিষয়ে আপনার যদি তুমুল আগ্রহ থাকে, উদ্যম থাকে এবং আগ্রহের বিষয়টা থেকেই যদি আপনি আয়ের পথ তৈরি করতে পারেন, তাহলে ক্যারিয়ার নিয়ে আপনাকে কখনো ভাবতে হবে না। যত পরিবর্তন আসুক, নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসুক, লেগে থাকলে আপনি একটা না একটা পথ পেয়ে যাবেন। ধরুন, একজন মানুষ ভালো ডিজাইন করতে পারে। সে বাড়ির ডিজাইন করল। তারপর একসময় ইন্টেরিয়র ডিজাইন করতে শুরু করল, আসবাবের ডিজাইন করল। এতে তার আয় হবে, আবার আনন্দও হবে। ২০ বছর পর কী হবে, সেটা তো আপনি জানেন না। আপনার আগ্রহ আর সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিকল্পনা করুন।
যখন বিদেশে পড়ালেখা করেছেন, সে দেশেই থেকে যেতে ইচ্ছা হয়নি?
হ্যাঁ, হয়েছে। কানাডার ভ্যানকুভার খুব সুন্দর শহর। কিন্তু বাবা যখন ফোন করে বলতেন, ‘কবে আসছ?’ বুঝতাম, আমার আসলে ফিরে আসতেই হবে। আমি কিন্তু খুব ছোটবেলা থেকেই বাবার ব্যবসা একটু একটু করে দেখেছি। বাবাই আমাকে কাজ দিতেন। আবার সে জন্য পারিশ্রমিকও দিতেন। ধরুন, এক দিন স্কুল ছুটির পর সব কটি শোরুম ঘুরে গেলাম, সে জন্য বাবা হয়তো আমার মোবাইলের বিল দিয়ে দিলেন। এক দিন হয়তো ইন্টারভিউ চলছে। যতক্ষণ ইন্টারভিউ চলত, বাবা পুরোটা সময় আমাকে পাশে বসিয়ে রাখলেন। তখন বুঝতাম না, এখন বুঝি। এটাই আসলে ট্রেনিং। আমার ছেলেমেয়ের সঙ্গে আমিও একই কাজ করব।
আপনি যখন লোক নিয়োগ দেন, তখন চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে কোন বিষয়টা খোঁজেন?
নতুনদের মধ্যে প্রথমত খুঁজি তার শেখার আগ্রহ আছে কি না। সে প্রকৌশল পড়েছে, না ব্যবসা ব্যবস্থাপনা পড়েছে, তাতে কিছু যায়–আসে না। পড়ালেখার ভিতটা থাকলে কাজ বুঝতে সহজ হয়, কিন্তু শেখার আগ্রহ থাকতেই হবে। আমরা ইন্টারভিউতে অনেকক্ষণ কথা বলি। বুঝতে চেষ্টা করি, চাকরিটা করতে সে কতখানি আগ্রহী। পড়ালেখা শেষ হয়েছে, একটা চাকরি খুঁজতে হয় বলে আমি চাকরি করতে এসেছি, নাকি আসলেই আমার আগ্রহ আছে—এটাই গুরুত্বপূর্ণ।
এখনকার তরুণদের মনমানসিকতার কোন জায়গাতে আপনি ঘাটতি দেখতে পান? এমন কোনো জায়গা, যেখানে আরও উন্নতি করার জায়গা আছে...
আমি দেখি, অনেকের কাছেই আগ্রহের চেয়ে বড় বিষয় হয়ে গেছে ‘টাকা’। শুধু আয়ের চিন্তা করলে আসলে টাকা আসবে না। ধরুন, আপনারা ৫ জন বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হলেন। একজন কোনো একটা কিছু করে খুব ভালো করে ফেলল। বাকি চারজনের মনে হলো, ওর পথটাই বোধ হয় ভালো। বাকিরাও তাকে অনুসরণ করা শুরু করল। নিজের আগ্রহের জায়গাটা কী, সেটা আর খুঁজল না। এখানে একটা বড় চ্যালেঞ্জ আছে। নিজের আগ্রহকে অগ্রাধিকার দেওয়া শিখতে হবে।