এলিনার এগিয়ে চলা
>এলিনা সুলতানা ব্যাডমিন্টনে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। সম্প্রতি সামার ওপেন ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টের এককে পঞ্চমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হলেন। তিনি কখনো পুরোদস্তুর খেলোয়াড়, কখনো আবার মমতাময়ী মা; কখনো–বা কোচ। নবীন খেলোয়াড় তৈরি করতে গড়ে তুলেছেন ব্যাডমিন্টন একাডেমি। এত কিছু সামলে পড়াশোনাতেও আছেন এগিয়ে। এলিনা সুলতানার কথাই থাকছে এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে।
‘আম্মু, তুমি চ্যাম্পিয়ন হয়ে তবেই আসবে...।’
প্রতিদিন অনুশীলনের জন্য বাসা থেকে বের হওয়ার আগে পাঁচ বছরের মেয়ে আরশি খানের আবদার থাকে এমনই। চ্যাম্পিয়ন না হলে যেন ঘরে ঢোকার অধিকারটাই হারিয়ে ফেলবেন এলিনা সুলতানা! জাতীয় ব্যাডমিন্টনে এরই মধ্যে এককে দুবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত সামার ওপেন ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টে এককে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন। দ্বৈতে ছয়বার। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপেও দ্বৈতে চ্যাম্পিয়ন চারবার। দক্ষিণ এশিয়ান (এসএ) গেমসে দু–দুবার মেয়েদের বিভাগে দ্বৈতে ব্রোঞ্জ জিতেছে বাংলাদেশ। শাপলা আক্তারের সঙ্গে জুটি গড়ে ওই দলে ছিলেন এলিনা। এককভাবে ব্রোঞ্জ জিতেছেন ইন্দো-বাংলাদেশ গেমসে। ব্যাডমিন্টনের জাতীয় তালিকার শীর্ষে থাকা এলিনা সামার ওপেনেও দ্বিমুকুট জিতেছেন গত মাসে।
শোকেসভর্তি ট্রফি আর পদক। তারপরও একমাত্র মেয়ের কাছে প্রতিদিনই কথা দিয়ে আসতে হয় এলিনাকে, ‘আম্মু আমি তোমার জন্যই চ্যাম্পিয়ন হতে চাই।’ এ যেন একের ভেতর অনেক! এলিনা কখনো পুরোদস্তুর খেলোয়াড়, কখনো আবার মমতাময়ী মা। কখনো ঘরকন্না সামলানো ব্যস্ত নারী, কখনো–বা কোচ। গত মাসে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন ব্যাডমিন্টনের লেভেল ‘টু’ কোচেস প্রশিক্ষণ নিতে। পড়াশোনাতেও কম যান না এলিনা। ফিন্যান্স ও ব্যাংকিংয়ে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন প্রথম শ্রেণি পেয়ে। নেপালে গত বছর লেভেল ‘ওয়ান’ কোচেস প্রশিক্ষণের লিখিত পরীক্ষায় ৮ দেশের ৪৩ জনের মধ্যে হয়েছিলেন প্রথম।
ব্যস্ত জীবনে সংসার, সন্তান সামলে অনুশীলনে যাওয়া নিত্যদিনের কাজ এলিনার। এরপর আবার নিজের একটা ব্যাডমিন্টন একাডেমি গড়ে তুলেছেন। প্রতিদিনের অনুশীলনের সঙ্গে পড়াশোনাটাও চালিয়ে যাচ্ছেন। কয়েক দিন আগে ঢাকার পুরানা পল্টনের উডেন ফ্লোর জিমনেসিয়ামে বসে অনুশীলনের ফাঁকে এলিনা বললেন, ‘ছোটবেলা থেকেই চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসি। যেটা করব বলে প্রতিজ্ঞা করি, সেটা করেই ছাড়ি।’
খুলনার মেয়ে এলিনা স্কুলপর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় হ্যান্ডবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন খেলতেন শুরুতে। ক্রিকেটেও একবার ডেকেছিলেন স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই মাইগ্রেনের ব্যথায় ভুগতে থাকা এলিনা বাইরের খেলাধুলার চেয়ে ইনডোরকেই বেছে নিলেন।
খেলাটা তাঁর রক্তে
২০০৯ সালের কথা। এসএ গেমসের ক্যাম্পে আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েন এলিনা। চিকিৎসকেরা তো তাঁর জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন! কিন্তু অ্যাথলেট বলেই হয়তো আবারও জীবনের সঙ্গে লড়াই করে ফিরে আসেন। ঢাকায় এসএ গেমসে মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তানের শাটলারদের হারিয়ে মেয়েদের দ্বৈতে জেতেন ব্রোঞ্জ। সেদিনের সেই লড়াইয়ের কথা মনে উঠলে এখনো যেন গা শিউরে ওঠে এলিনার, ‘বিদেশি কোচ আমাকে খুব পছন্দ করতেন। অন্যরা একটা ইভেন্ট খেললেও আমাকে দিয়ে তিনটি (একক, দ্বৈত ও মিশ্র) খেলাতে চেয়েছিলেন। অনেক চাপ পড়ত অনুশীলনে। সেই কারণেই কিনা মেনিনজাইটিস (মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুরজ্জুর চারদিকের আবরণে প্রদাহজনিত রোগ) হয়ে গিয়েছিল আমার। এরপর সাইনাস আর মাইগ্রেনের ব্যথা তো ছিলই। ছেলেদের সঙ্গে অনুশীলন ম্যাচ খেলতাম। সন্ধ্যার পর গিয়েই গোসল করতাম। মাথায় এ জন্য প্রচণ্ড চাপ পড়ে। আমি আর খেলতেই পারছিলাম না।’
ওই সময় চিকিৎসকেরা এলিনার মেরুদণ্ড থেকে ইনজেকশন দিয়ে ফ্লুইড বের করে আনেন। সঙ্গে এক মাসের পূর্ণ বিশ্রামের নির্দেশ দেন। ব্যাডমিন্টন খেলতে পারবেন না বলে শুধুই কাঁদতেন। বাধ্য হয়েই ঢাকা ছেড়ে খুলনা চলে যান এলিনা। বিশ্রামের শেষ দিকে খুলনা রূপসা সেতুর ওপর গিয়ে দৌড়াতে শুরু করেন। একসময় ধীরে ধীরে সেরে উঠতে থাকেন এলিনা। যোগ দেন এসএ গেমসের ক্যাম্পে। জেতেন ব্রোঞ্জ।
খেলোয়াড়ের সঙ্গে গাঁটছড়া
এলিনার স্বামীও একজন খেলোয়াড়; ব্যাডমিন্টনের সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন এনায়েত উল্লাহ খান। তাঁর সহযোগিতায় এত দূর এসেছেন। সে কথাটাই বলছিলেন, ‘শুধু স্বামী নয়, আমার মা–বাবা, শাশুড়ি সবাই সমর্থন দেয়। তাদের জন্যই আজ এখানে এসেছি।’
খেলোয়াড় স্বামী বেছে নেওয়ার গল্পটা বেশ মজার। অনেকে ভাবতে পারেন, দুজনের ভালো লাগা থেকেই বিয়ে! আসলে ঘটনা মোটেও তা ছিল না। এনায়েতকে সিনিয়র ভাই হিসেবেই দেখতেন। কিন্তু অনুশীলন করাতে গিয়েই এলিনার প্রতি ভালো লাগা জন্মে যায় এনায়েতের। লাজুক হেসে এলিনা বলছিলেন, ‘একদিন এনায়েত আমাকে ফোন করে গড়গড় করে বলতে শুরু করেন, “তোমাকে আমি অনেক পছন্দ করি। বাড়ি থেকে আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। আমি তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়েই করব না।”’
এলিনা ভাবারও সময় পান না। পুরো বিষয়টা ছেড়ে দেন পরিবারের ওপর। ২০১১ সালের ৮ জুলাই দুই পরিবারের সিদ্ধান্তে ঘটা করে বিয়ে হয় দুজনের। বিয়ের পর এনায়েতের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ চলে আসেন।
বিরতির দিনগুলি, ফেরার দিনগুলি
বিয়ের পর এক বছর খেলেছিলেন নিয়মিত। কিন্তু সন্তানসম্ভবা এলিনা টানা তিন বছর বিরতি দেন খেলায়। বসে থাকার দিনগুলো ভীষণ যন্ত্রণার ছিল এলিনার জন্য। বলছিলেন, ‘আমি তখন টেলিভিশনে বাংলাদেশ গেমস দেখতাম। সবাই যখন খেলছে, আমি তখন ঘরে বসে। খুব খারাপ লাগত। পরে ভাবতাম ওরা হয়তো ট্রফি পাবে ঠিকই, কিন্তু আমাকেও তো আল্লাহ আরশির মতো জীবন্ত ট্রফি দিয়েছে।’
মেয়ে আরশির জন্ম হয়। মেয়ের জন্মের সাত মাসের মাথায় আবারও ব্যাডমিন্টন কোর্টে ফেরেন এলিনা। নিজেকে প্রমাণ করার জন্য করতে থাকেন ঘামঝরানো অনুশীলন। শেষমেশ নিজের মতোই ফেরেন। এবং ফিরেই ২০১৪ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন!
চ্যাম্পিয়নের দুঃখ, চ্যাম্পিয়নের সংগ্রাম
দেশের বাইরে কোনো অনুশীলনে যাওয়ার সুযোগ দেয় না ফেডারেশন। শুরুতে এটা নিয়ে ফেডারেশন কর্মকর্তাদের ওপর ক্ষোভ জন্মেছিল এলিনার। ২০০৮ সালে একবার তাঁকে চীনে অনুশীলনে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতে চেয়েছিল ফেডারেশন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর বদলে আরেক খেলোয়াড়কে পাঠানো হয়। এরপর মনের ক্ষোভে দেশেই কঠোর অনুশীলন করেন তিন মাস। পরের ঘরোয়া টুর্নামেন্টে চীন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা সেই শাটলারকে হারিয়ে মনের যন্ত্রণা জুড়িয়েছিলেন এলিনা!
চার বছর ধরে বাংলাদেশের কোনো মেয়েকে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নিতে দেশের বাইরে পাঠায় না ফেডারেশন। অথচ অলিম্পিকে রুপাজয়ী ভারতের পি ভি সিন্ধুর সঙ্গে ক্যারিয়ারের শুরুতে খেলেছেন। সেই আক্ষেপ আর নিজেদের দৈন্যের কথা মনে করে শুধুই কষ্ট পান এলিনা, ‘এসএ গেমসে আর এশিয়ান গেমসে আমি পি ভি সিন্ধুর সঙ্গে খেলেছি। ওরা আজ কোথায় আর আমরা কোথায় পড়ে আছি। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলতে পারি না বলে তালিকায় আমাদের অবস্থানও নেমে গেছে। আমরা ফেডারেশনের কাছে কতবার বলেছি দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ দিক মেয়েদের। অথচ নিজেদের উদ্যোগেই খেলে যাচ্ছি।’
এলিনার এক মাসের শাটল খরচ ১০ হাজার টাকার ওপর। অন্যরা তাহলে কীভাবে এই খেলায় আসবে? নিজেই প্রশ্নটা ছুড়ে দেন, ‘আমি খেলোয়াড় তৈরি করার জন্য একাডেমি দিয়েছি। কিন্তু অভিভাবকেরা বলে, এখানে এসে আমরা কী পাব? এত টাকা খরচ করে কী হবে? এমন দুর্দান্ত একাডেমিক রেজাল্ট আমার, কিন্তু সৈনিক পদে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয় আমাকে!’
এলিনা বলেন আর চোখের পানি মোছেন। এত কিছুর পরও শুধু মানুষের ভালোবাসার জন্য খেলাটা চালিয়ে যাচ্ছেন এলিনা, ‘সিলেটে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে গিয়ে বুঝেছি, কত মানুষ আমার ভক্ত। খেলার পর বিশ্রাম নেওয়ার সময় পেতাম না। ওয়াশরুমে ঢুকলে বেরিয়ে দেখতাম, ভিড় জমে গেছে বাইরে। সবাই আমার অটোগ্রাফ নেবে, একটা ছবি তুলবে। আমি তো মুগ্ধ।’
যত দিন ফিট থাকবেন, খেলে যেতে চান। এখনো স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশের জন্য এসএ গেমসে একটা সোনা জিতবেন, ‘যখন জার্সিতে বাংলাদেশের পতাকা লাগিয়ে খেলতে যাই কোথাও, একটাই স্বপ্ন থাকে, এই পতাকা আরও উঁচুতে রাখতে হবে। এখনো বাংলাদেশ ব্যাডমিন্টনে এসএ গেমসে সোনা জেতেনি। পুরস্কারের মঞ্চে উঠে একবার হলেও জাতীয় সংগীতের সঙ্গে গলা মেলাতে চাই।’