মৌমাছির ওড়াউড়ি দেখে নৌকা থেকে নেমেছিলেন আশরাফুল আলম। মৌয়ালজীবনের অভিজ্ঞতা তাঁকে নিশ্চয়তা দিয়েছিল, আশপাশেই আছে মৌচাক। তাই সরু লাঠি হাতে মাছির পথ অনুসরণ করে সুন্দরবনের ঘন জঙ্গলে এগিয়ে চলেন। বেশি দূর যেতে হয়নি। কাছাকাছি একটা গাছের ডালেই পেয়ে যান মৌচাক।
গাছের নিচের সময়টা কয়েক সেকেন্ডের। ৩৫ বছরের আশরাফুল নিশ্চিত হয়ে যান, মৌচাকে মধু নেই। জোয়ার শুরু হয়েছে। ফিরে যেতে হবে নৌকায়। যেই না ফেরার জন্য মাথাটা ডান দিকে ঘুরিয়েছেন, অমনি বাঘের থাবা। কানের লতি থেকে মুখের বাঁ অংশের চোয়ালে নখের আঁচড়ে ক্ষত হয়ে গেল। আঁচড় লাগল ঠোঁটের অন্য পাশেও। আঁচড় মানেই মাংস ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া।
আশরাফুল ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গেলেও তৎক্ষণাৎ সাহস ফিরে পেলেন। তখনই অসুরের মতো শক্তি নিয়ে লাঠির অনেকটা অংশ ঢুকিয়ে দিলেন বাঘের মুখে। তাঁর হাতের লাঠির অগ্রভাগ ছিল সুচালো। কিছুটা কাজ হলো। কিন্তু বাঘ তো এত সহজে পরাস্ত হওয়ার প্রাণী নয়। গর্জে উঠে আবারও আঘাত করল। আশরাফুল লাঠির অগ্রভাগ দিয়ে এলোপাতাড়ি খোঁচাতে থাকলেন।
‘সম্ভবত সেই খোঁচা বাঘের চোখেমুখে লেগেছিল। তখন তো এত কিছু খেয়াল করি নাই। মাথায় নিশ্চিত মরণের চিন্তা নিয়া এত কিছু খেয়ালও করা যায় না।’ কথাটুকু বলে থামেন আশরাফুল আলম। বাঘের আক্রমণে সেদিন শ্বাসনালিতে ক্ষত হয়েছিল। সংক্রমিত হয়ে সেখানে ছিদ্র হয়েছে। তাই গলার স্বর হয়ে গেছে ফ্যাসফ্যাসে। কথা বলা বারণ। প্রয়োজনীয় কথা হাতে লিখে জানান।
রাজধানীর উত্তরার একটি ক্লিনিকে বসে আশরাফুলের সেদিনের বেঁচে ফেরার বাকি কথা শোনালেন বাপ্পি রাজ। ২৩ বছরের এই তরুণ আশরাফুলের ছোট ভাই। তিনিও বনজীবী। তাঁর বর্ণনায় ছবির মতো ভেসে উঠল সেদিনের ঘটনা, ‘১ মে কাঁকড়া ধরতে দুই নৌকা নিয়ে আমরা সুন্দরবনে যাই। ভাই আর বাবু (একই গ্রামের মোশারফ হোসেন) ছিল একটা নৌকায়। তারা চলে যায় অন্যদিকে। ঘটনা ঘটে দুই দিন পর।’
সেই দিনটা ছিল ৩ মে। ঘূর্ণিঝড় ফণীর আগমনবার্তায় সবাই যখন শঙ্কিত, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পাইস্যাখালী গ্রামের আশরাফুল আলম আর মোশারফ হোসেন তখন সুন্দরবনে। তাঁরাও প্রকৃতির হঠাৎ রূপবদলের সাক্ষী হচ্ছিলেন।
জোয়ারের মুহূর্ত তখন। ধীরে ধীরে জোড়া ভাই খালে পানি বাড়ছে। কাঁকড়া সংগ্রহের এক ফাঁকে মৌমাছির ওড়াউড়ি দেখে সেখানে গিয়েছিলেন। তারপরই তো বাঘের মুখে।
আশরাফুল যখন বাঘের সঙ্গে লড়ছিলেন, নৌকায় বসা নিরুপায় মোশারফ হোসেন তা দেখছিলেন আর চিৎকার করছিলেন। কিন্তু নির্জন বনে কে আসবে সাহায্য করতে। একসময় বাঘ হেরে যায় আশরাফুলের কাছে। রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন মুখ নিয়ে নৌকায় আসেন আশরাফুল। বিকৃত মুখ আর রক্তপাত দেখে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন মোশারফ।
আশরাফুল আরও ঘাবড়ে যান। শরীরের এতটুকু শক্তি তখন অবশিষ্ট নেই। কোনোমতে গামছা দিয়ে মাথা-গলা-মুখ বাঁধেন। রক্তপাত কিছুটা কমে। নির্জন সুন্দরবনে মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক নেই। সরু খালে কোনো মানুষও নেই। জোয়ারের পানি তখন দুকূল ছাপিয়েছে। তাঁদের ডিঙিনৌকা বাতাসে এগিয়ে চলল।
বাপ্পি রাজ বলে যান, ‘খাল থেকে বড় নদীতে আসার আগেই মোবাইলে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। তখন ভাই কথা বলতে না পেরে পরিচিতদের মেসেজ দেয়। তাদের উদ্ধার করার জন্য মানুষ পাঠাতে বলে।’
মুহূর্তেই বাঘের আক্রমণের খবর এলাকায় চাউর হয়ে যায়। স্থানীয় মানুষসমেত ট্রলার নিয়ে উদ্ধার করতে ছুটে যান শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম। এই ইউপি সদস্য আবার সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ওয়াইল্ড টিমের টেংরাখালী ভিটিআরটির (ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম) দলনেতাও। তাঁরাই গিয়ে উদ্ধার করেন আশরাফুল আলমকে।
মৃতপ্রায় আশরাফুল আর আতঙ্কিত মোশারফকে গ্রামে আনা হয়। গ্রাম্য চিকিৎসক আর কবিরাজি চিকিৎসা চলে। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হননি আশরাফুল। সে সময় ঢাকার মধু ব্যবসায়ী আবদুল মালেক সেই গ্রামে গিয়েছিলেন মধু সংগ্রহের কাজে। তিন বছর ধরে আশরাফুল আলমদের কাছ থেকে মধু নেন। তিনিই উদ্যোগী হয়ে আশরাফুলকে ঢাকায় আনেন উন্নত চিকিৎসার জন্য।