দক্ষতা বিকাশে তারুণ্যের মুক্তি

রংপুরের উৎসবে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। ছবি: প্রথম আলো
রংপুরের উৎসবে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। ছবি: প্রথম আলো
রংপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, ঢাকার ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ও নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ পর্ব নিয়ে বিশেষ আয়োজন


‘দশটার অনুষ্ঠান কি আর দশটায় শুরু হবে?’ এমন সংশয়ে হেলেদুলে সকাল সাড়ে ৯টায় রংপুর শীতল কমিউনিটি সেন্টারে তারুণ্যের জয়োৎসবে হাজির হন আহসানুল মাহবুব। রংপুর সরকারি কলেজে পড়ছেন তিনি। ভবিষ্যতে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী পদে কাজ করতে চান বলে বেশ আগ্রহ নিয়ে এসেছিলেন। ভেন্যুতে পা রেখেই চমকে গেলেন। সাড়ে ৯টার আগেই বসার জায়গা শেষ, ছয় শর বেশি তরুণ ততক্ষণে দখল করে নিয়েছেন মিলনায়তনের সবগুলো আসন! সেদিন কোনো মতে এক কোণে বসার বন্দোবস্ত করে নিয়েছিলেন মাহবুব।

আহসানুল মাহবুবের মতো এমন হাজারো তরুণ অংশ নিচ্ছেন ক্রাউন সিমেন্ট-প্রথম আলো তারুণ্যের জয়োৎসবে। রংপুর ছাড়াও ময়মনসিংহ, কুমিল্লা এবং ঢাকার ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ও নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে সম্প্রতি আয়োজন করা হয় জয়োৎসব। দেশের তরুণদের একুশ শতকের পেশাদক্ষতা বিকাশের জন্য চলছে এই মহাযজ্ঞ। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অঞ্চলে একেকটি পর্ব আয়োজন করা হচ্ছে। তরুণেরা কীভাবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের দক্ষতা বিকাশ করতে পারে, এ-সংক্রান্ত পরামর্শ দিচ্ছেন অভিজ্ঞ পেশাজীবীরা।

চাকরির জন্য প্রস্তুতি

কীভাবে সিভি লিখতে হয়, সে সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা ছিল না ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী রাফিন আহমেদের। বন্ধুবান্ধবের সিভি নকল করে অনেক প্রতিষ্ঠানে জমা দিয়েছেন, কিন্তু সাক্ষাৎকারের ডাক পাননি। ক্যারিয়ারের পথ খুঁজতে তারুণ্যের জয়োৎসবের ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ পর্বে অংশ নেন তিনি। গত ১৮ জুলাই এই আয়োজনে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা ছাড়াও অন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের তরুণেরা অংশ নেওয়ার সুযোগ পান। পেশাজীবনের বিভিন্ন দক্ষতা বিকাশের জন্য সৃজনশীল মন তৈরি ও বাস্তবের সমস্যা সমাধানের জন্য তরুণদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ক্যারিয়ার বিষয়ে দিকনির্দেশনা পেতে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পান অংশগ্রহণকারীরা।

ময়মনসিংহ পর্বে তরুণদের উচ্ছ্বাস
ময়মনসিংহ পর্বে তরুণদের উচ্ছ্বাস

এই পর্বে অতিথি ছিলেন লেখক ও সাহিত্যিক আনিসুল হক। যে বিষয়, যে কাজ ভালো লাগে, তা নিয়েই পড়ালেখা করার পরামর্শ দেন তিনি। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ইশরাত শারমিন বলেন, ‘আমি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরে কোন বিষয়ে পড়ব, তা বুঝতে পারিনি। ভর্তিযুদ্ধ আর ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার প্রতিযোগিতায় হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার বেশ চাপও আছে। কী করব, এই নিয়ে দ্বিধায় ভুগছি। সেই দ্বিধা কাটাতেই এখানে এসেছি।’

১০ জুলাই তারুণ্যের জয়োৎসবের নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ পর্বে মানবীয় দক্ষতা বৃদ্ধি, ভাবনার পরিবর্তন এবং পারসোনাল ব্র্যান্ডিং সম্পর্কে শেখার সুযোগ পেয়েছেন তরুণেরা। ব্র্যান্ডিং নিয়ে সেশন পরিচালনা করেন আমরা নেটওয়ার্কসের হেড অব স্ট্র্যাটেজিক প্রজেক্টস সোলায়মান সুখন।

শুরু হোক বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকেই

‘অভিজ্ঞতা ছাড়া কি চাকরি হয়?’ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রোকনুজ্জামান প্রশ্ন করেছিলেন ক্রাউন সিমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান মোল্লাহকে। গত ২৯ জুলাইয়ের কথা। উত্তরে অভিজ্ঞ এই পেশাজীবী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে যুক্ত থাকতে হবে। পড়ার পাশাপাশি এসব কাজে যুক্ত থাকলে দলের সঙ্গে কাজ করা শেখা যায়, কীভাবে দল নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তা জানা যায়, সংকটপূর্ণ মুহূর্তে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করার চর্চা হয়। এসবই তো অভিজ্ঞতা। সিভিতে এ ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ড যুক্ত করলে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকা যায়।’

ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ পর্বে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ
ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ পর্বে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ

১ আগস্ট অনুষ্ঠিত তারুণ্যের জয়োৎসবের কুমিল্লা পর্বের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন ক্রাউন সিমেন্ট গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ খান। ‘ভাইবা বোর্ডে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কী দেখতে চান চাকরিদাতারা?’ প্রশ্ন ছুড়ে দেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থী কামরুল হাসান চৌধুরী। মাসুদ খান উত্তরে বলেন, ‘যেকোনো চাকরির জন্য সিজিপিএ সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। ভাইবা বোর্ডে তরুণদের মধ্যে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সাহস, নতুনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করার প্রত্যয় দেখা হয়। যে তরুণ নিজেকে দারুণভাবে প্রকাশ করতে পারে ভাইবা বোর্ডে তাকে বেশি গুরুত্ব দেন চাকরিদাতারা।’

বিকল্প পথেও হাঁটতে হবে

২৯ জুলাই, রংপুরের জয়োৎসবে উদ্যোক্তা ও ফটোগ্রাফার প্রীত রেজা ব্যক্তিগত দুর্বলতা কাটিয়ে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করার নানা কৌশল সম্পর্কে ধারণা দেন। নাচের দল তুরঙ্গমীর পরিচালক পূজা সেনগুপ্ত জীবনকে উপভোগ করে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন কুমিল্লার তারুণ্যের জয়োৎসবে। রংপুর ও কুমিল্লা পর্বে সফল কয়েকজন তরুণ উদ্যোক্তা নতুন করে ভাবনার পথ বাতলে দেন।

নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ পর্বে প্রশ্ন করছেন এক শিক্ষার্থী
নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ পর্বে প্রশ্ন করছেন এক শিক্ষার্থী



কাজ শেখার বিকল্প নেই

৩০ জুলাই ময়মনসিংহের তারুণ্যের জয়োৎসবে যোগাযোগবিশেষজ্ঞ হামিদ এইচ খান নিজেদের চিন্তাশক্তি বিকাশের নানা সুযোগের কথা বলেন। করপোরেট প্রশিক্ষক গোলাম সামদানী ধারণা দেন নেটওয়ার্কিংয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে। আজকাল দলে কাজ করার অভিজ্ঞতা, দলকে নেতৃত্ব দেওয়া—এগুলোকেই চাকরিদাতারা বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে মনে করেন। চাপ নিয়ে সৃজনশীল উপায়ে কাজ শেখার কৌশল সম্পর্কে তরুণেরা জানার সুযোগ পান বিভিন্ন জয়োৎসব থেকে।

উচ্চশিক্ষার দারুণ সুযোগ

রংপুরের কারমাইকেল কলেজে শিক্ষার্থী ফারজানা চৌধুরী বলেন, ‘সরাসরি অভিজ্ঞ পেশাজীবীদের কাছ থেকে আমরা চাকরির জন্য তৈরি হওয়ার পরামর্শ পেয়েছি। এ ছাড়া ছিল বিদেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ সম্পর্কে আলোচনা।’ আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার জন্য কী কী করতে হবে তা নিয়ে দিকনির্দেশনা দেন রুহুল আমিন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে সময় ঠিক করে নিতে হবে। তাড়াহুড়ো করে জিআরই-জিম্যাট ও টোয়েফল-আইইএলটিএস পরীক্ষা দেওয়া যাবে না।

কুমিল্লা পর্বে হাত হাত মিলিয়ে তরুণদের দেশ গড়ার প্রত্যয়
কুমিল্লা পর্বে হাত হাত মিলিয়ে তরুণদের দেশ গড়ার প্রত্যয়



সরকারি চাকরির জন্য

মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজের শিক্ষার্থী সৈয়দা শারিকা আরেফিন বিসিএস, ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরির নিয়োগ ও পরীক্ষা সম্পর্কে জানতে অংশ নেন তারুণ্যের জয়োৎসবের নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় পর্বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক শেখ আজম আলী তরুণদের পরামর্শ দেন। তিনি তরুণদের ধৈর্য ধরে প্রস্তুতি নেওয়ার কৌশল শেখান। রংপুর পর্বে বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে কথা বলেন ৩৭ তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রশাসন ক্যাডারের সুপারিশপ্রাপ্ত শেখ মাহবুবে সোবহানী। তরুণদের বিতর্কসহ বিভিন্ন কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সৃজনশীলতা বিকাশের পরামর্শ দেন পাবলিক সার্ভিস কমিশনে যোগ দেওয়া তরুণেরা।

পথ খুঁজতে হবে নিজেকেই

প্রথম আলোর যুব কর্মসূচি সমন্বয়ক মুনির হাসান ও ক্রাউন সিমেন্ট গ্রুপের উপদেষ্টা এ মজিদ চৌধুরী তরুণদের হুজুগে না ছোটার পরামর্শ দেন। তাঁদের বক্তব্য—একটু স্থির হয়ে, পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগোলে নিজেকে যেকোনো পেশার জন্য তৈরি করা যায়। অনলাইনের বিভিন্ন টুলস ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নিজের দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। থেমে থাকলে পথ দেখা যাবে না। তারুণ্যের জয়োৎসবের মাধ্যমে এভাবেই তরুণেরা নিজেরাই নিজের পথ খুঁজে নিতে প্রত্যয়ী হচ্ছেন।