একটা সোনা জিততে ১৫ বছর...কেন?
>একটা সময় সাফ গেমস ফুটবলে সোনার পদক ছিল বাংলাদেশের সোনার হরিণ। যোগ্য দল হয়েও এই সোনার পদকের জন্য ১৫টি বছরের দুঃসহ অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে জাতীয় দলকে। প্রতিবারই নানা কারণে সোনা হাতছাড়া হয়েছে দলের। সোনা হাতছাড়া হওয়ার সে কারণগুলোয় চোখ বোলালে অবাকই হবেন পাঠকেরা। ভুল থেকে না শেখার সংস্কৃতি চিরদিনই ক্ষতি করেছে এ দেশের খেলাধুলাকে, বিশেষ করে ফুটবলকে।
‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই’—রবি ঠাকুরের এই গানটি এক সময় বাংলাদেশ ফুটবলের থিম সংয়ে পরিণত হয়েছিল। এক সময় বলতে আশি ও নব্বইয়ের দশকের কথাই বলা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সাফ গেমসে যখনই জাতীয় ফুটবল দল খেলতে যেত, তখনই গোটা দেশের প্রত্যাশা থাকত আকাশে—এবার নিশ্চয়ই সোনা জিতে আসবে আমাদের দল। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে সোনার আশাটা খুব অবাস্তব কিছু ছিল না, বাড়াবাড়িও ছিল না। সেটি ফুটবলে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান বিচার করেই। একমাত্র ভারত ছাড়া সে অর্থে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে কেউ ছিলই না। কিন্তু তারপরেও ফুটবলে আরাধ্য সোনার পদকটা পেতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৫ বছর। এর মধ্যে বাংলাদেশ পাঁচবার সাফ গেমস ফুটবলের ফাইনালে খেলেছে। কোনো খেলায় রুপার পদকটি যে এত কষ্টের হতে পারে, সেটি বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল ছাড়া বোধহয় কারওরই জানার কথা নয়! সাফ গেমস ১৯৯৯ সালের আগ পর্যন্ত তো আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশের ফুটবলের দুঃখ!
অনেকেই বলেন, সাফ গেমস ফুটবলে সোনার পদকটা শুরুতেই পেয়ে গেলে বাংলাদেশের ফুটবলের চেহারাটা ভিন্নরকম হলেও হতে পারত। বারবার প্রতিযোগিতার সেরা দল নিয়ে সাফে গিয়েও আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। ১৯৮৪ সালে যে নেপালকে গ্রুপপর্বে ৫-০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ, সে দলের কাছেই ফাইনালে হারতে হয়েছে ৪-২ গোলে। ১৯৮৫-তে ঘরের মাঠে ভারতের কাছে বাংলাদেশ হেরেছে টাইব্রেকারে। এমনি করে ১৯৮৯ আর ১৯৯৫ সালে আরও দুইবার ফাইনালে উঠেও হতাশাই হয়েছে সঙ্গী। ১৯৮৭ আর ১৯৯৩ সালে সোনার প্রত্যাশায় ব্রোঞ্জটাও জোটেনি। ১৯৯১ সালে গ্রুপপর্বে ভারতকে হারিয়েও ব্রোঞ্জ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। ১৯৯৯ সালে এসে সেই আরাধ্য সোনার পদকটা এসেছিল ঠিকই কিন্তু তত দিনে ফুটবলের যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে। ২০০৬ সাল থেকে সাফ গেমস ‘এসএ গেমসে’ পরিণত হওয়ার পরে ফুটবল জাতীয় দল থেকে অনূর্ধ্ব-২৩ দলের প্রতিযোগিতা হওয়ার পরেও গল্পটা প্রায় একই। যদিও ২০১০ সালে ফুটবলে সোনা এসেছে, কিন্তু ফুটবলের জন্য দক্ষিণ এশীয় গেমস চিরকালীন দুঃখই হয়ে থেকে। ফুটবলপ্রেমী একটা প্রজন্মের কাছে এই গেমস একরাশ দুঃখ, হতাশা আর না পাওয়ার স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
আরও একটি এস এ গেমস দুয়ারে কড়া নাড়ছে। এ সময় সাফ গেমস ফুটবলের সেই পুরোনো স্মৃতিতে ফেরা যেতেই পারে। কাঠমান্ডুতে ১৩তম আসরের শুরুতে সাফ ফুটবলে ব্যর্থতার কারণগুলোর কয়েকটি বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। একটি সোনার পদক আসতে কেন ১৫ বছর সময় লাগল, সেটি কিছুটা হলেও বুঝতে পারবেন, এ প্রজন্মের পাঠকেরা।
সেরা খেলোয়াড়েরা চলে গেল ভারতে
১৯৮৪ সাফ গেমস ফুটবলে ভারত অংশ নেয়নি। ফুটবল প্রতিযোগিতায় সোনার পদক জয়কে সময়ের ব্যাপারই মনে করছিল বাংলাদেশের ফুটবল প্রশাসকেরা। নেপাল, মালদ্বীপ আর ভুটানের সঙ্গে ‘কী খেলব’ জাতীয় হামবড়া ব্যাপারটিও ছিল। সে কারণেই হয়তো বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন জাতীয় দল গঠন করল মোহামেডানের সেরা তারকাদের ছাড়াই। মোহাম্মদ মহসিন, আশিস ভদ্র, সালাম মুর্শেদী, বাদল রায়ের মতো সে সময়ের বড় তারকারা খেলতেন মোহামেডানেই। কিন্তু জাতীয় দলের জন্য খেলোয়াড় না ছেড়ে মোহামেডান ভারতে চলে যায় আইএফএ শিল্ড খেলতে। ফল, সাফে ব্যর্থতা। তবে এটা ঠিক, মোহামেডানের খেলোয়াড় ছাড়াই সেবার জাতীয় দলের শক্তি অন্তত নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপকে হারানোর জন্য যথেষ্টই ছিল। গ্রুপপর্বে মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটানকে উড়িয়েও ফাইনালে দল স্বাগতিক নেপালের কাছে হেরে যায় ৪-২ গোলে। কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামের সে ফাইনালটাও ছিল ভুতুড়ে। ভাবা যায়, ফাইনালে নেপালের ৪ গোলের দুটিই বাংলাদেশের ডিফেন্ডাররা উপহার দিয়েছিলেন আত্মঘাতে।
ফাইনালের আগে শক্তিক্ষয়
সাফ গেমসের ফুটবলে বাংলাদেশ যতবার অংশ নিয়েছে ১৯৮৫ সালের দলটা ছিল সেরা। কাজী সালাউদ্দিনের কোচিংয়ে দলের অধিনায়ক ছিলেন ইমতিয়াজ সুলতান জনি। বেশ দাপটের সঙ্গে খেলেই ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ। গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানকে ২-১ আর মালদ্বীপকে ৮-০ গোলে হারানো দলটি ফাইনালেও খেলেছিল মোটামুটি ভালোই। ভারত গোল করে এগিয়ে গেলেও সেই গোল শোধ বাংলাদেশ দিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু তারপরেও সোনার পদকটা গেছে ভারতের ঘরেই। টাইব্রেকারে বাংলাদেশ হেরে গিয়েছিল ৪-১ গোলে।
বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ গোলের ব্যবধানে জয়—মালদ্বীপের বিপক্ষে ’৮৫ সালে ৮-০। অনেকেই গর্ব করে বলেন সে ইতিহাসের কথা। কিন্তু অনেকে আবার এই ম্যাচটিকেই দায়ী করেন সেবারের ভাগ্যবিপর্যয়ের জন্য।
ফাইনালের একদিন আগে মালদ্বীপের মতো দুর্বল দলের বিপক্ষে (১৯৮৫ সালে মালদ্বীপ ফুটবলে এতটাই দুর্বল দল ছিল যে তাদের হারাতে ঢাকার ফুটবলের যেকোনো মাঝারি সারির ক্লাবই যথেষ্ট ছিল বলে অনেকে মনে করেন) পূর্ণশক্তির দল খেলানোর ব্যাপারটি নিয়ে সমালোচনা আছে। সে ম্যাচে রীতিমতো গোলের নেশায় পেয়ে বসেছিল বাংলাদেশের ফুটবলারদের। সে কারণে অনেকটা শক্তি ব্যয় করে ফেলেন তারা। এই ম্যাচে দ্বিতীয় সারির দল খেলানোই যথেষ্ট ছিল। বাংলাদেশ যে মালদ্বীপের বিপক্ষে ট্যাকটিক্যাল ভুল করেছিল, সেটা বোঝা যায় অন্য গ্রুপের শেষ ম্যাচটির দিকে তাকালেই। সে ম্যাচে ভারত ভুটানের বিপক্ষে সাইড বেঞ্চের খেলোয়াড়দের খেলিয়েছিল। সে সময়ের জনপ্রিয় ক্রীড়া সাময়িকী ক্রীড়াজগতে লেখা হয়েছে, ভুটানের বিপক্ষে ঠান্ডা মাথায় খেলে জয় তুলে নিয়েছিল ভারত। সত্তর মিনিট পর্যন্ত যে ম্যাচ গোলশূন্য, সে ম্যাচে ভারত শেষ অবধি জিতেছিল ৩-০ গোলে। অথচ, মালদ্বীপের বিপক্ষে বাংলাদেশ খেলেছিল ঠিক উল্টো কৌশল নিয়ে —‘গোলের বন্যা বইয়ে দাও।’ ফাইনালে সেটার ছাপ ছিল বাংলাদেশের খেলায়। খেলোয়াড়েরা ছিলেন ক্লান্ত। চনমনে ভারত, বাংলাদেশের বিপক্ষে সে সুযোগটাই নিয়েছিল। দুর্ভাগ্য, ফাইনালে টাইব্রেকারে হারতে হয় বাংলাদেশকে।
ক্লাব-বাফুফে দ্বন্দ্ব, বলি জাতীয় দল
১৯৮৭ সালে কলকাতা সাফ গেমসের আগে তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছিল বাংলাদেশের ফুটবলে। আবাহনী ও মোহামেডানের মধ্যকার লিগের শেষ ম্যাচে গোলযোগের বলি হয়েছিলেন দেশের সেরা ফুটবলাররা। দুই দলেরই অধিনায়কসহ কয়েকজন ফুটবলারকে বিভিন্ন মেয়াদে নিষিদ্ধ করেছিল বাফুফে। ফলে সাফের দলে সেটার প্রভাব ছিল। সেবার লিগের শিরোপা-নির্ধারণী ম্যাচটি হয়েছিল আর্মি স্টেডিয়ামে; দর্শকবিহীন অবস্থায়। ম্যাচটি খেলা নিয়ে আবাহনীর আপত্তি ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত খেলাটি হয়, কিন্তু তাতে বিভিন্ন কারণে পূর্ণশক্তির দল খেলাতে পারেনি আবাহনী। শিরোপা যায় মোহামেডানের ঘরে। সাফের দল ঘোষিত হলে আবাসিক ক্যাম্পে আবাহনীর খেলোয়াড়েরা যোগ দেন অনেক পরে, সেটি বাফুফের কড়া অবস্থানের পরই। এসব ঘটনাগুলো প্রভাব পড়ে সাফ ফুটবলে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে। নেপালের কাছে প্রথম ম্যাচে দলকে হারতে হয় ১-০ গোলে। মাঝখানে ভুটানকে ৩-০ গোলে হারালেও ব্রোঞ্জ পদকের ম্যাচে পাকিস্তানের কাছে ১-০ গোলে হেরে গোটা দেশকে হতবিহ্বল করে দেয় জাতীয় দল। দল গঠন, প্রস্তুতি—সবকিছুতেই সেবার ছিল হ-য-ব-র-ল অবস্থা। ফলে যা হওয়ার হয়েছিল তা-ই।
বিশ্বকাপ খেলা কোচ, ব্যর্থতা আবারও
১৯৮৯ ইসলামাবাদ সাফ গেমসে জাতীয় দলের কোচ নিয়োগ করা হয় নাসের হেজাজিকে। ইরানের হয়ে ১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপ খেলা হেজাজি মোহামেডানের কোচ হিসেবে তখন দারুণ সফল। দুইবার সাদা-কালে শিবিরকে লিগ জিতিয়েছেন, এশীয় পর্যায়েও ক্লাবকে এনে দিয়েছেন ঈর্ষণীয় সাফল্য। সেই হেজাজিকে যখন কোচ করা হলো তখন সবাই আশায় বুক বাঁধল। প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময়ও পেলেন এই বিখ্যাত ইরানি কোচ। দলটা মোটামুটি ভালো হলেও একটা কিন্তু থেকেই গেল। জাতীয় দলে নেওয়া হলো না শেখ আসলাম, ওয়াসিম ইকবাল ও মোহাম্মদ মহসিনের মতো অভিজ্ঞ তিন তারকাকে। সে সময়কার ক্রীড়া সাময়িকী ক্রীড়াজগতে দল গঠন নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল। একটি নিবন্ধে হেজাজির বিপক্ষে প্রচ্ছন্ন পক্ষপাতের অভিযোগও তোলা হয়। লেখা হয়, ‘হেজাজি এমন একজন খেলোয়াড়কে নিয়ে গেলেন, যাকে নিজের দলের পক্ষেই ষাট শতাংশ ম্যাচ খেলিয়েছেন কিনা সন্দেহ।’ ক্রীড়াজগতে আরও লেখা হলো, ‘হেজাজি এমন কিছু খেলোয়াড়কে ইসলামাবাদ নিয়ে গেলেন, আবার এমন কিছু খেলোয়াড়কে সেখানে নিয়ে গেলেও খেলালেন না, যাতে তাঁর পক্ষপাতই ফুটে বেরোয়।’
এত কিছুর পরেও এই দলটাই হয়তো শিরোপা জিতত, যদি ভাগ্য একটু সুপ্রসন্ন হতো। প্রথম ম্যাচে এলোমেলো ফুটবল খেলে শ্রীলঙ্কাকে ৩-০ গোলে হারালেও দ্বিতীয় ম্যাচে ভালো খেলে ভারতের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে নূরুল হক মানিকের গোলে ৩৪ মিনিটেই ১-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল দল। মানিকের গোলটা ছিল প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে করা দূরপাল্লার শটে। ভারত খেলায় ফেরে বিতর্কিত এক পেনাল্টি গোলে। সেটি নিয়ে হয় তুলকালাম। অধিনায়ক ইলিয়াস হোসেন রেফারির সঙ্গে বাজে ব্যবহার করেন। যে ব্যবহারের জের টানতে হয় ৩ বছরের জন্য সাসপেন্ড হয়ে। ফলে ফাইনালে উঠেও দলকে খেলতে হয় অধিনায়ককে ছাড়া। পাকিস্তানের বিপক্ষে ফাইনালে পাকিস্তানিদের মারকাটারি ফুটবলের সামনে যে মানসিক দৃঢ়তার দরকার ছিল, সেটি দেখাতে পারেননি কায়সার হামিদ, সাঈদ হাসান কানন, রিজভি করিম রুমি, মোনেম মুন্না, ইমতিয়াজ সুলতান জনিরা। ম্যাচের একেবারে শেষ মুহূর্তে মোনেম মুন্না আর কায়সার হামিদের ভুল বোঝাবুঝির খেসারত দিতে হয় গোল খেয়ে। আরও একটি সাফে বাংলাদেশকে সন্তুষ্ট থাকতে হয় রুপার পদক নিয়ে।
আবারও পাকিস্তান-দুঃখ
১৯৯১ সালে কলম্বো সাফে বাংলাদেশ গ্রুপপর্বে ভারতকে ২-১ গোলে হারিয়েছিল। কিন্তু এ ম্যাচের আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল ফাইনালে খেলার আশা। কারণ প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ হেরে গিয়েছিল পাকিস্তানের কাছে ১-০ গোলে। সে সময় সাফ গেমস ফুটবলের ফরম্যাট এমনই ছিল। দুই গ্রুপের শীর্ষ দল খেলতে ফাইনালে। তিন দলের গ্রুপ হওয়াতে একটি ম্যাচ হারলে ফাইনালের স্বপ্নভঙ্গই হতো। একানব্বইয়ের ডিসেম্বরে সেটিই হয়েছিল। কোচ শহীদউদ্দিন সেলিমের দলগঠন নিয়েও সমালোচনা ছিল। প্রথম ম্যাচে দুই-একজন অভিজ্ঞ খেলোয়াড়কে তিনি খেলাননি। আনকোরা খেলোয়াড়েরা আন্তর্জাতিক ম্যাচের চাপ নিতে পারেননি। পাকিস্তানের বিপক্ষে যে গোলটি হজম করতে হয়, সে গোলের পেছনে একজন নতুন খেলোয়াড়ের অনভিজ্ঞতাকে দায়ী করা হয়। রক্ষণভাগ অফসাইড ট্র্যাপ দিলেও সেই খেলোয়াড় পাকিস্তানের ফরোযার্ডকে চেজ করেন। সে আক্রমণেই গোল পেয়ে যায় পাকিস্তান। পরে ব্রোঞ্জের লড়াইয়ে নেপালকে দাপটের সঙ্গে খেলে ২-০ গোলে হারায় বাংলাদেশ। কিন্তু সাফ গেমস ফুটবলে সোনার হাহাকারটা সেবারও থেকে যায়।
সুইস কোচের পরিকল্পনায় সর্বনাশ
সেবার আন্তর্জাতিক অলিম্পিক সংস্থার (আইওসি) কাছ থেকে একজন সুইস কোচ পেয়েছিল বাংলাদেশ। ওল্ডরিখ সোয়াব নামের সেই কোচের নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সাফ গেমসের জন্য ফুটবল দল সাজাতে চেয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো দ্বিরুক্তি ছিল না। সমস্যা ছিল তাঁর পরিকল্পনার ধরন নিয়ে। সেপ্টেম্বরে লিগ শেষ হওয়ার পর ডিসেম্বরে ছিল সাফ গেমস। আড়াই মাসের প্রস্তুতিতে সোয়াব কেবল দলকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাই করে গেছেন। খেলোয়াড়দের খাওয়া-দাওয়া, জীবনাচার নিয়েও তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মেতেছিলেন। এক পজিশনে অভ্যস্ত খেলোয়াড়কে খেলিয়েছেন অন্য জায়গায়। চিরদিন স্টপার ব্যাক হিসেবে খেলা কায়সার হামিদকে খেলানো হয় রাইট ব্যাকে। রক্ষণের তারকা মোনেম মুন্না খেলেন মধ্যমাঠে। সাফের আগে মিয়ানমারের বিপক্ষে দুটি প্রীতি ম্যাচে বাংলাদেশ জিতলেও সে দলটাও তিনি বদলে ফেলেন চূড়ান্ত আসরে। সামান্য চোটের কারণে বাদ পড়েন সাব্বির, আসলামের মতো তারকারা। সেবার প্রথম ম্যাচে মালদ্বীপের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র করা বাংলাদেশ দ্বিতীয় ম্যাচে নেপালের কাছে হেরে যায় ১-০ গোলে। সে ম্যাচে বক্সের মধ্যে একটি ভুল পাস ধরেই গোল করে নেপাল। যিনি ভুল পাসটি দিয়েছিলেন তিনি ছিলেন দলের অধিনায়ক। দলের বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ ফুটবলার থাকার পরেও সেই খেলোয়াড়কে অধিনায়ক করায় সমালোচনা ছিল ব্যাপক। জাতীয় দলের অধিনায়ক হওয়ার মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞ খেলোয়াড় তিনি ছিলেন না।
মাদ্রাজে দুর্ভাগ্য
১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ সাফ গেমসেও ফাইনালে খেলেছিল বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে হারতে হয় ১-০ গোলে। তবে সে ম্যাচে সত্যিকার অর্থেই দুর্ভাগা ছিল অটো ফিস্টারের দল। ফাইনালের আগে মাইল খানিক হাঁটিয়ে দলকে স্টেডিয়ামে নেওয়ার অভিযোগ ছিল। মাদ্রাজের (এখন চেন্নাই) দুপুরের রোদে এক মাইল হেঁটে ম্যাচ খেলতে নামা যেকোনো বিচারেই কঠিন। সেদিন দিয়ে আয়োজকদের বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার হতে হয় বাংলাদেশকে। ফাইনালে তারপরেও বাংলাদেশ যথেষ্ট ভালো খেলেছিল। মোট কথা মাদ্রাজে দুর্ভাগ্যেরই শিকার হতে হয় মোনেম মুন্নার দলকে।
১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডুতে এসে ১৫ বছরের অধরা সোনার পদক হাতে পায় বাংলাদেশ। কিন্তু সাফ গেমসের ফুটবলে একটি সোনা জিততে কেন ১৫ বছর লেগে গেল, সেটির আরও বিস্তারিত গবেষণা হতেই পারে। তবে এটা সত্যি সাফের ব্যর্থতাগুলি আমাদের ভুল থেকে না শেখার চিরায়ত সেই বাজে সংস্কৃতিকেই সামনে নিয়ে আসে।