হেইডেনকে ফেরানো সেই নাজমুলকে মনে রাখেনি কেউ
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এমন ক্রিকেটার তো কত এল-গেল! সাত বছর আগে দেশের হয়ে শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা কাউকে নিয়ে শোরগোলের কী আছে? আর খেলেছেনও এমন এক সময়ে যখন জাতীয় দলে ক্রিকেটার মানেই আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকা। কেউ একটু ভালো খেললেই যাচাইয়ের ‘গিনিপিগ’ বানানো হতো তাঁকে। না পারলে অনেকটাই পত্রপাঠ বিদায়। যে কারণেই হোক না কেন বেশির ভাগই পারত না, ঠিক যেভাবে বাংলাদেশ দলও তখন বেশির ভাগ ম্যাচ হারত। সেই সময়ে ২ টেস্ট, ৩৮ ওয়ানডে এবং ৪ টি-টোয়েন্টি খেলা একজন পেসারকে তাই ক্রিকেটপ্রেমীদের খুব মনে রাখার কথা নয়।
কিন্তু মনে রাখা উচিত। সেটি তাঁর প্রাপ্যই। হালে খেলা বদলেছে, মানসম্মত ক্রিকেটারও বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘নস্টালজিক’ সমর্থকেরা সৌভাগ্য বয়ে আনা সেই সেই ক্রিকেটারটিকে ভুলতে পারবে না। পারবে না ড্রেসিংরুমে তাঁর সেই সময়ের সতীর্থরাও। ২০০৪, ২০০৫ ও ২০০৬-এই তিনটি বছরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম জয়ের সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। হ্যাঁ, পেসার নাজমুল হোসেনের নামই বলা হচ্ছে।
স্মৃতির পাতা উল্টে দেখুন, ২০০৪ সালে বাংলাদেশ সফরে এল ভারত। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে আগে ব্যাট করে ৯ উইকেটে ২২৯ রান তুলল বাংলাদেশ। শেবাগ, সৌরভ, যুবরাজ, কাইফ, ধোনিদের জন্য ওই রান টপকে যাওয়া কোনো ব্যাপার ছিল না। কিন্তু মাশরাফি, তাপস বৈশ্য, খালেদ মাহমুদ ও রফিকদের দুর্দান্ত বোলিংয়ে পারেনি ভারত। এই চারজনের স্পেলে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল একটি স্পেল—৭ ওভারে বিনা উইকেটে ২৬ রান। আহামরি কোনো স্পেল নয় তবে জয়ের পেছনে বড় ভূমিকা ছিল।
ওই স্পেলটি করার পরেও নাজমুলকে আহামরি কোনো পেসারের চোখে দেখা হয়নি। কিন্তু দলের প্রয়োজনে তাঁকেই খোঁজা হতো। মাশরাফি চোটে পরেছেন, ওকে ডাক দাও...সিমিং কন্ডিশনে দুই পেসারের পর তৃতীয় পেসার কে? আচ্ছা, ওকে রাখলেই তো হয়! কিংবা প্রতিপক্ষের উইকেট পড়ছে না...ছেলেটি এসে ‘ব্রেক থ্রু’ এনে দিল। লাল-সবুজে এই ছিল তাঁর খেলার দিনগুলি।
২০০৫ কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয় মনে আছে তো? আগে ব্যাট করা অস্ট্রেলিয়া অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ও রিকি পন্টিংকে দ্রুতই হারিয়ে চাপে পড়ে যায়। ডেমিয়েন মার্টিন ও ম্যাথু হেইডেন মিলে চাপ কাটিয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ১৬তম ওভারে হেইডেনকে তুলে নিয়ে দারুণ এক ‘ব্রেক থ্রু’ এনে দিয়েছিলেন নাজমুল। পরের বছর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও প্রথম ওয়ানডে জয়েও অংশীদার ছিলেন। আর ঠিক এ কারণেই ড্রেসিং রুমে তাঁকে ডাকা হতো ‘লাকি চার্ম’ হিসেবে। কিন্তু তাঁর নিজের ক্যারিয়ারের সঙ্গে বরাবরই সৌভাগ্য শব্দটির যেন আড়ি!
৮ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। খেলেছেন দুটি প্রজন্মের সঙ্গে। হাবিবুল বাশার, মাশরাফি, মুশফিক, তামিমদের সতীর্থ ছিলেন। কিন্তু অপরিহার্য হয়ে ওঠা দূরে থাক গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও হয়ে উঠতে পারেননি নাজমুল। কেউ চোট পেলে জায়গা মিলত দলে। অথচ, বলে মোটামুটি পেসের সঙ্গে সুইং ছিল, সঙ্গে অ্যাঙ্গেল—বাঁ হাতি ব্যাটসম্যানদের জন্য খেলা যা বেশ কঠিন হয়ে পড়ত। উইকেট পেলে আঙুল তুলে একটা লাফের সঙ্গে উঁকি দিত গলার চেইন, মনে পড়ে?
২০০৪ সালে ওয়ানডে অভিষেকের পর ওই বছরই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করেছিলেন ক্যারিয়ার সেরা বোলিং। ৪০ রানের বিনিময়ে ৪ উইকেট। নিউজিল্যান্ড গুটিয়ে যায় ২২৪ রানে। কিন্তু বাংলাদেশ মাত্র ৮৬ রানে অলআউট হওয়ায় তাঁর সেরা বোলিংয়ের সুখস্মৃতিটা অনেকেই ভুলে গেছেন। কিন্তু ২০০৯ সালে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে সেই বোলিং কি ভোলা সম্ভব? ১৫২ রানে অলআউট হয়েছিল বাংলাদেশ। তাড়া করতে নেমে শ্রীলঙ্কা শুরু করল ৬ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে! এর মধ্যে ৩ উইকেটই ছিল তাঁর। হৃদয়ভঙ্গের গল্প লিখে বাংলাদেশ সেই ম্যাচও জিততে পারেনি।
সৌভাগ্য ধরা দেয়নি, তবে নিজ চেষ্টায় একবার তার ছোঁয়া পেয়েছিলেন। ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ডকে ‘বাংলা ওয়াশ’ করার সিরিজে প্রথম ম্যাচে গোটা বাংলাদেশেরই সৌভাগ্য বয়ে এনেছিলেন নাজমুল। শেষ ওভারে ১৮ রান দরকার ছিল নিউজিল্যান্ডের। বল করতে এসে দিলেন মাত্র ৯ রান। খুলে গেল বাংলা ওয়াশের দুয়ার। কিন্তু ১১ বছরের ক্যারিয়ারে তিন সংস্করণ মিলিয়ে মাত্র ৪৪ ম্যাচ খেলাই বলে দেয় জাতীয় দলের দুয়ার নাজমুলের জন্য খুব বেশি খোলেনি কিংবা খোলা হয়নি।
অনেকে বলেন নাজমুল জন্মেছিলেন ভুল সময়ে। তখন বাংলাদেশ দল পুরোপুরি স্পিন নির্ভর। অবস্থা এমন যে, দুই পেসার খেলানোই দায়! সেখানে তৃতীয় পেসার খেলানো তখন বিলাসিতা। সে যতই পুরোনো বলে মুভমেন্ট পাক কোনো পেসার। নাজমুল তা পারতেন, তবে এত সময় ধরে থেকেও এত কম ম্যাচ খেলার পেছনে দায় শুধু চোট-প্রবণতা। বাকি যেসব দায় অফফর্ম, বাজে বোলিং—এসব তো দুনিয়ার সেরা পেসারেরও থাকে!
জাতীয় দলের বাইরে চলে যাওয়ার পর পেশাদার ক্রিকেটে নাজমুলকে সবশেষ দেখা গিয়েছিল গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে। এবার প্রিমিয়ার লিগে লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের অঘোষিত পেস বোলিং কোচ। শরীর মুটিয়ে গেছে, একত্রিশ পার করেছে বয়সও। নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের মতোই অনেকটা নিভৃতেই সব ধরনের ক্রিকেট থেকে বিদায় বললেন নাজমুল।
বিদায় বেলায় বেশ খানিকটা অভিমান কি তাঁকে ঘিরে ধরেনি!