হুমকি-ধমকিও দমাতে পারেনি ফুটবলের রাজকন্যাকে
মিসরাত জাহান মৌসুমীর ফুটবলার হওয়াটা কঠিনই ছিল। খেলার জন্য হুমকি-ধমকিও পেতে হয়েছে তাঁর পরিবারকে। রংপুরের পালিচড়ার রামজীবন গ্রামের এই মেয়েটিই এখন বাংলাদেশের ফুটবলের পরিচিত নাম।
তখনো সকালের নাশতা খেতে হোটেলের লবিতে আসেননি। কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনকে অনুরোধ করতেই ডেকে আনলেন মিডফিল্ডার মিসরাত জাহান মৌসুমীকে। আগের দিনই দলের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জ্বলে উঠে ভুটানের বিপক্ষে মূল্যবান গোলটি করেছিলেন। লাজুক স্বভাবের তরুণীকে হোটেলের সোফায় বসে কথাটা মনে করিয়ে দিতেই লজ্জায় আরও লাল হয়ে গেলেন। যেন গোল করে মহা অন্যায় করে ফেলেছেন!
মাঝমাঠের কুশলী খেলোয়াড় মৌসুমী। ফরোয়ার্ডদের বল জোগান দেওয়ায় তাঁর আসল কাজ। কিন্তু কখনো কখনো দলের প্রয়োজনে দারুণ সব গোল করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন।
২০১১ সালে বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবলের আবিষ্কার মৌসুমী। রংপুরের পালিচড়ার রামজীবন গ্রামের নির্মাণশ্রমিক আবদুল কাদেরের ছয় সন্তানের মধ্যে চতুর্থ মৌসুমী। নির্মাণশ্রমিক আবদুল কাদের মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন লেখাপড়ায় শিক্ষিত করতে। কিন্তু খেলার নেশায় কখন যে মৌসুমী ফুটবলের প্রেমে পড়ে গেলেন, তা নিজেই জানেন না, ‘আমাদের স্কুলের স্যার যখন বললেন, তোমাদের বঙ্গমাতা ফুটবল খেলতে হবে, আমি খুশিতে আটখানা হয়ে গেলাম।’
শুরুর দিকে ফুটবল খেলতে গিয়ে কম কথা শুনতে হয়নি মৌসুমীকে। মেয়ে হয়ে ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন। ছেলেদের মতো জার্সি, ট্র্যাকস্যুট পরতেন বলে এলাকার লোকজন মৌসুমীর মা–বাবাকে হুমকি দিতেন। মাঝে এক বছর তো খেলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন মৌসুমী। কিন্তু ফুটবল যার রক্তে, সে কি আর খেলা ছেড়ে থাকতে পারে? তাইতো পরের বছর আবারও বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবলে অংশ নেন। এবার এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌসুমীর খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে মা–বাবাকে বলেছিলেন, ‘আপনাদের মেয়েকে ফুটবল খেলতে দেন। আমি ওর নিরাপত্তার ব্যাপারটা দেখব।’
এরপর মৌসুমীর খেলা দেখে জাতীয় দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন ডেকে নেন অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে। সেই শুরু, এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে খেলেছেন নেপালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে। ঢাকায় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে, থাইল্যান্ডে এই টুর্নামেন্টের চূড়ান্ত পর্বে, ভারতের এসএ গেমসে। জাতীয় দলে অভিষেক ২০১৪ ইসলামাবাদে, এরপর সর্বশেষ সাফে খেলেছেন ভারতের শিলিগুড়িতে। এবারও নেপালে বাংলাদেশ দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার মৌসুমী। খেলার সুবাদে ঘুরেছেন মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভারত, নেপাল, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান ও সিঙ্গাপুরে।
পাঁচ তারকা হোটেলের অভিজাত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন মৌসুমী। কিন্তু মৌসুমীর মন পড়ে থাকে সাভারে, বাবা যেখানে প্রতিদিন ইট, সুরকি, কংক্রিট নিয়ে অন্যের ভবন তৈরিতে ব্যস্ত, আর মৌসুমী ব্যস্ত মাঠে ফুটবল নিয়ে দলের জয়ের ভিত তৈরিতে।
ফুটবলই বদলে দিয়েছে মৌসুমীর জীবন। আজ হোটেলের অভ্যর্থনা কক্ষের সোফায় বসে বলছিলেন, ‘আমি ফুটবল খেলে সম্মান পেয়েছি। বাবার হাতে টাকা তুলে দিতে পারছি। এই আনন্দ বলে বোঝাতে পারব না।’ রীতিমতো তারকাই হয়ে গেছেন মৌসুমী, ‘এলাকায় গেলে সবাই আমাকে দেখতে আসে। বলে তুই তো আমাদের এলাকার গর্ব।’
মৌসুমীর প্রিয় ফুটবলার স্ট্রাইকার সাবিনা খাতুন। কাল এই দুজনের গোলেই সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। সাবিনার মতো অত গোল না পেলেও বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে বেশ কয়েকটি গোল করেছেন। ২০১৫ সালে কাঠমান্ডুতে ভুটানের বিপক্ষেই হ্যাটট্রিক করেছিলেন এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে। ঢাকায় ২০১৬ সালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে ইরান ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে করেন ১টি করে গোল। আর কাল জাতীয় দলের হয়ে প্রথম গোল করে ভীষণ উচ্ছ্বসিত, ‘আমার গোলে দল জিতেছে বলে বেশি ভালো লাগছে। আর এই গোলটা এমন সময় করেছি,যখন চেষ্টা করেও আমরা গোল পাচ্ছিলাম না।’
জাতীয় দলের পাশাপাশি মৌসুমী অনূর্ধ্ব-১৬ দলেরও নিয়মিত ফুটবলার। এ বছর সেপ্টেম্বরে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপের বাছাইয়ে খেলবে বাংলাদেশ। মৌসুমী স্বপ্ন দেখছেন এখন থেকেই, ‘আমরা বয়সভিত্তিকে যেভাবে ধারাবাহিক সাফল্য পাচ্ছি, একদিন বিশ্বকাপ জয়েরও স্বপ্ন দেখি।’
ছেলেদের ফুটবলে বিশ্বকাপের স্বপ্ন দূর আকাশের তারা। কে জানে মৌসুমীদের হাত ধরেই হয়তো মেয়েদের বিশ্বকাপ খেলবে বাংলাদেশ।