এমন 'খতরনাক উইকেটে' আর খেলেননি তামিম
তিন দিনে খেলা হয়েছে মাত্র ৭২.৪ ওভার। তারপরও আর বৃষ্টি না হলে এই টেস্টে রেজাল্ট হবেই।
কে করছেন এই ভবিষ্যদ্বাণী? তামিম ইকবাল।
প্রথম দুদিন খেয়ে ফেলার পর আজ তৃতীয় দিনে এসে টস করার সুযোগ দিয়েছে বৃষ্টি। এমন এক টস, দুই অধিনায়কের বুকই দুরুদুরু করছে। পাশেই সবুজ উইকেট। দুদিন ঢাকা থাকার পর ভেজা-স্যাঁতসেঁতে। সকালবেলায় যেটির বর্ণনায় ধারাভাষ্যকার স্কট স্টাইরিস ব্যবহার করেছেন ‘গ্রিন মনস্টার’ শব্দটা। এই ‘সবুজ দৈত্য’-এর বুকে কে প্রথমে ব্যাট নিয়ে নামতে চায়!
কেন উইলিয়ামসন কয়েনটা শূন্যে ছুড়লেন। মাহমুদউল্লাহ কল করলেন ‘হেড’, পড়ল ‘টেইল’। প্রথমে ব্যাটিং বা বোলিং—উইলিয়ামসনের এটা বলারই দরকার ছিল না। সবাই জানে, এই উইকেটে, মেঘলা আকাশের নিচে ভেজা বাতাসে আরও তীব্র এই ঠান্ডায় টসজয়ী অধিনায়কের সিদ্ধান্ত কী হবে!
দুই অধিনায়ক যখন টস করতে নামছেন, তামিম ইকবাল তখন কী করছিলেন? আর কী করবেন—অপেক্ষা! সবচেয়ে খারাপ যা হতে পারে, সেটির জন্য মানসিক প্রস্তুতি। দুই বছর আগে ওয়েলিংটনে এমনই সবুজ উইকেটে এমনই ঠান্ডায় প্রথমে ব্যাটিং করতে নেমে ৫০ বলে ৫৬ রানের যে ইনিংসটি খেলেছিলেন, সেটিকে তামিম মর্যাদা দেন তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসের একটি বলে। লাঞ্চের সময় বাংলাদেশের সে সময়ের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘এই ইনিংসটা খেলে পুরো দলের মানসিকতাই তুমি বদলে দিয়েছ।’
সেই ৫০ বলে ৫৬ রানের পাশে আজকের ১১৪ বলে ৭৪ রানের ইনিংসটি কোথায় থাকবে? পাশে নয়, থাকবে সেটিরও ওপরে। এটা বলার আগে ‘এমনই ঠান্ডা, এমনই সবুজ উইকেট’ কথাটা একটু সংশোধন করে দিলেন, ‘গতবার এত ঠান্ডা ছিল না। উইকেটেও এত ঘাস ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, সেবার তো টানা দুদিন বৃষ্টির পর ব্যাটিং করতে নামিনি। আজ কন্ডিশন সেদিনের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল।’
মাঠের মাঝখানে যে সবুজ আয়তক্ষেত্রটিকে স্কট স্টাইরিস ‘গ্রিন মনস্টার’ বলেছিলেন, তামিমের ভাষায় সেটি ‘খতরনাক উইকেট।’ কতটা খতরনাক, সেটি আসলে বাইরে থেকে বোঝা যায়নি, ‘বিশ্বাস করবেন কি না, বল উইকেটে পড়ার পর আধা আঙুল দেবে যাচ্ছিল। উইকেটের ওপরটা এমনই নরম হয়ে ছিল। এমন উইকেটে আগে কখনো খেলেছি বলে মনে পড়ে না।’ সেই উইকেটেই দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের আরেকটি তামিম-প্রদর্শনী!
আপনি যেভাবে খেলেছিলেন, তাতে তো উইকেট এতটা কঠিন মনে হয়নি! মোবাইলের ও প্রান্ত থেকে তামিমের মৃদু হাসি, ‘আপনি টের পাবেন কীভাবে! আমি ঠিকই টের পেয়েছি। নামার আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, একটু মারার বল পেলেই মেরে দেব। কারণ এই উইকেটে শুধু টিকে থাকার চেষ্টা করে লাভ নেই। যেকোনো সময় একটা বল আমাকে খেয়ে দিতে পারে।’
এমন উইকেটে, এমন আবহাওয়ায়, এমন বোলিংয়ের বিপক্ষে এই ৭৪ কি তাহলে অনেক সেঞ্চুরির চেয়েও দামি? তামিম নিজে তা-ই মনে করেন। তবে নিষ্ঠুর বাস্তবতাটাও তাঁর জানা, ‘এটা কেউ মনে রাখবে না। ওই ৫০ বলে ৫৬-ই বা কে মনে রেখেছে? হয়তো আমার টিমমেটরা রেখেছে। যারা দেখেছে, তারা মনে রেখেছে। অন্য কেউ ওটার মূল্য বোঝেনি। এটারও বুঝবে আমি আশা করি না। শেষ পর্যন্ত মানুষ সেঞ্চুরিই মনে রাখে।’
সেই সেঞ্চুরিটা করতে না পারার দুঃখটা তামিমকে বেশি পোড়াচ্ছে। সবচেয়ে বেশি পোড়াচ্ছে, কঠিন সময়টা পার করে আসার পর যখন সবকিছু একটু সহজ মনে হচ্ছে, তখনই আউট হয়ে যাওয়া। এ যেন শ্বাপদসংকুল এক অরণ্য নিরাপদে পেরিয়ে যাওয়ার পর যখন সবুজ উপত্যকায় পা, তখনই উল্টো হুমড়ি খেয়ে পড়া। তামিমের এমনই মন খারাপ হয়েছে যে, বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা দিন শেষের সংবাদ সম্মেলনে তাঁকেই চান—এটা জেনেও তিনি আসেননি। ‘আউট হওয়ার পর খুব খারাপ লেগেছে। শুধু নিজের সেঞ্চুরির জন্য নয়, আমি থাকলে আমাদের ইনিংসটা আরও বড় হতো’—এটা তো জানা কথাই। ওয়েলিংটনের প্রথম ইনিংসটাও অনেকটা হ্যামিল্টনের প্রথম ইনিংসের মতোই হয়ে গেল। তামিম যেখানে নিঃসঙ্গ শেরপার মতো লড়াই করে গেলেন।
হ্যামিল্টনের সঙ্গে বড় একটা পার্থক্যও অবশ্য আছে। সেই টেস্টের ২৩৪ রানের চেয়ে এই টেস্টের ২১১ রান সংখ্যায় পিছিয়ে থেকেও তাৎপর্যে এগিয়ে। ৮ রানের মধ্যে নিউজিল্যান্ডের ২ উইকেট তুলে নিয়ে যেটি খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছেন আবু জায়েদ। অনভ্যস্ততার কারণে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কাছে একটু বেশি চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, তবে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের জন্যও এই উইকেট সহজ নয়। যে কারণে তামিম ইকবালের ওই ভবিষ্যদ্বাণী, ‘বৃষ্টি না হলে এই টেস্টে রেজাল্ট হবেই।’
বাস্তবে টেস্টের প্রথম দিন হয়ে যাওয়া কাগজে-কলমের তৃতীয় দিন শেষে স্কোরবোর্ডের যে অবস্থা, তাতে সেই ‘রেজাল্ট’ কোন দলের গলায় জয়মাল্য পরাবে, তা কেউ জানে না!
তামিম ইকবাল কি আর এমনিতেই বলছেন, ‘বৃষ্টি না হলে ম্যাচটা খুব ইন্টারেস্টিং হবে।’