এই দুই ভাইয়ের গল্পটা একটু অন্য রকম
এক দলে দুই ভাই ক্রিকেট অনেক দেখেছে। একই সঙ্গে তিন ভাইকেও। ভাইদের কীর্তিগাথা ক্রিকেটের রোমান্টিক এক গল্প এবং সেই গল্প একটি নয়। বলতে গেলে যা সহজে শেষ হওয়ার নয়। পাকিস্তানের মোহাম্মদ ভাইদের কথা আসবে। অস্ট্রেলিয়ার তিন চ্যাপেল, দুই ওয়াহ, জিম্বাবুয়ের দুই ফ্লাওয়ার, দুই স্ট্র্যাং—এমন আরও কত!
নিউজিল্যান্ড দলেও ভাইদের গল্পে অনেক অধ্যায়। জেফ ক্রো ও মার্টিন ক্রো একসঙ্গে খেলেছেন। এরও আগে খেলেছেন হ্যাডলিদের তিন ভাই। কিছুদিন আগেই দুই ম্যাককালাম ভাই ব্রেন্ডন ও নাথান। নিকোলস ভাইদের গল্পটা এঁদের সবার চেয়ে আলাদা। হেনরি নিকোলস ও উইলি নিকোলসও একই সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের ড্রেসিংরুমে থাকেন। তবে দুজন দুই ভূমিকায়। হেনরি নিকোলসের পরিচয়—নিউজিল্যান্ড দলের বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ও অনিয়মিত অফব্রেক বোলার। বড় ভাই উইলি নিকোলসের—নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের মিডিয়া কর্মকর্তা। এই সিরিজের প্রেক্ষাপটে মিডিয়া ম্যানেজার বললে আরও ভালো বোঝানো যায়।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে হেনরি নিকোলসের টেস্ট অভিষেক। উইলি এর মাস পাঁচেক আগে যোগ দিয়েছেন নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের চাকরিতে। ড্রেসিংরুমে ঢুকেই বড় ভাইকে পেয়েছেন হেনরি। একটু কি অদ্ভুত লেগেছিল তাঁর? হেনরি নিকোলস হাসেন, ‘শুরুতে একটু লেগেছিল। তবে আমি তো আগে থেকেই জানতাম, এমন হবে। ছেলেবেলায় বাড়ির পেছনের আঙিনায় একসঙ্গে খেলে, ঝগড়া করে-মারামারি করে বড় হয়েছি। এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞতাটাও একসঙ্গেই নিচ্ছি। ভালোই তো!’
গত বুধবার ওয়েলিংটনে নিউজিল্যান্ডের টিম হোটেলে আগের প্রতিশ্রুতিমতো হেনরি নিকোলসকে এনে সামনে বসিয়ে দিয়েছেন উইলি। দিয়েই নিজে সরে গেছেন। দুই ভাইকে একসঙ্গে বসিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলাম। উইলি রাজি হননি। তাতে অন্য ক্রিকেটাররা যদি ভাবেন, মিডিয়া কাভারেজ পাওয়ার জন্য নিজেই এমন কিছুর ব্যবস্থা করেছেন। হেনরি নিকোলসের সঙ্গে কথা শেষ হওয়ার পর আবার এলেন। দুই ভাইকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে ছবিটা তখনই তোলা।
একসঙ্গে সাক্ষাৎকার যে আগে দেননি, তা নয়। ইন্টারনেটে গিয়ে স্কাই স্পোর্টসে দুই ভাইয়ের একটা টেলিভিশন সাক্ষাৎকার পেয়ে গেলাম। হেনরি নিকোলসের অভিষেকের কদিন পরই যা নেওয়া। সেই হেনরি নিকোলসের সঙ্গে এই হেনরি নিকোলসের অনেক পার্থক্য। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অভিষেক টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৯ রান করেছিলেন। তাতে এমন কিছু হয়ে যায়নি। দলে জায়গাটা পাকা হয়েছে আরও বছরখানেক পর। সেটির সূচনা বাংলাদেশকে দিয়েই। দুই বছর আগে বাংলাদেশের বিপক্ষে ক্রাইস্টচার্চ টেস্টের স্মৃতিটা অবশ্য শেষ পর্যন্ত প্রীতিকর হয়ে থাকেনি। প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি থেকে ২ রান দূরে থাকতে তাঁকে বোল্ড করে দিয়েছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। কদিন আগে হ্যামিল্টন টেস্টেও মিরাজের বল ছেড়ে দিয়ে বোল্ড হয়েছেন। ওয়ানডে সিরিজে তিন ম্যাচের মধ্যে দুবারই মিরাজের শিকার। মিরাজের ‘বানি’ তো আপনাকে বলাই যায়, নাকি? মনে যা-ই থাক, মুখে হাসি নিয়ে মিরাজকে ভালো বোলারের স্বীকৃতি দেওয়ার পর হেনরি দাবি করলেন, এটা নেহাতই ঘটনাচক্র। এ নিয়ে তিনি একদমই ভাবছেন না।
না-ই ভাবতে পারেন। স্পিনটা খুবই ভালো খেলেন। গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাকিস্তানের বিপক্ষে ঐতিহাসিক সিরিজ জয়েও হেনরি নিকোলসের বড় ভূমিকা। ২টি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন, শেষ টেস্টে সেঞ্চুরি। সেই সিরিজে স্পিনের বিপক্ষে তাঁর ব্যাটিং গড় ৬৪। সুইপ শটটা খুব ভালো খেলেন। যেটি রপ্ত করায় একবার চেন্নাইয়ে ট্রেনিং ক্যাম্প করে আসার বড় ভূমিকা। আর আমিরাতে ভালো করায় ভূমিকা সেখানে যাওয়ার আগে প্রস্তুতির। ক্রাইস্টচার্চের শহরতলি লিঙ্কনে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের হাইপারফরম্যান্স সেন্টারে দুবাই-আবুধাবির মতো উইকেট বানিয়ে দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েছে নিউজিল্যান্ড দল। যা শোনার পর একবার মনে হলো, হেনরি নিকোলসকে জানিয়ে দিই, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কেমন দুঃসাহসী! নিউজিল্যান্ডের ভিন্ন কন্ডিশনের জন্যই কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই কী সুন্দর পাঠিয়ে দিয়েছে দলকে!
হেনরি নিকোলসের কথাতেই বোঝা যাচ্ছিল, ওয়েলিংটন টেস্টের জন্য তাঁর তর সইছে না। হ্যামিল্টনে অমন ব্যাটিং উইকেটে সেঞ্চুরি করার সুযোগ হারানো একটা কারণ, আরেকটা কারণ বেসিন রিজার্ভে খেলাটা তাঁর কাছে সব সময়ই ভিন্ন কিছু। এই মাঠেই তাঁর টেস্ট অভিষেক, এখানেই প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি, সেটি বাংলাদেশের বিপক্ষে ৯৮ রানে আউট হওয়ার দুই মাস পরই। মাঝখানে শুধু একটা টেস্ট। এরপর টেস্টে আরও তিনটি সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন, তিনটিই গত এক বছরের মধ্যে এবং তিনটিতেই অপরাজিত। এর মধ্যে গত বছর মার্চে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অপরাজিত ১৪৫ একটু আলাদা হয়ে আছে। অকল্যান্ডের ইডেন পার্কের সেই টেস্টটি যে এক অর্থে ঐতিহাসিক। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথম দিবারাত্রির টেস্ট। যেভাবে সেঞ্চুরিটা এসেছে, সে কারণেও তা মনে রাখার মতো। ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে ৫৮ রানে অলআউট হয়ে যাওয়ার পর প্রথম দিনেই ব্যাটিং করতে নেমেছিলেন। আর সেঞ্চুরি হয়েছে কিনা চতুর্থ দিনে গিয়ে! বৃষ্টির কারণে মাঝখানের দুই দিন যে খেলা হয়েছে মাত্র ২৬ ওভারের মতো।
ছোট ভাই যখন ব্যাটিং করেন, উইলির একটু নার্ভাস লাগে। আবার আনন্দও। স্কাই স্পোর্টসের সেই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি তো এমনিতেও ওর খেলা দেখতে আসতাম। আর এখন এটা চাকরির অংশ। এক অর্থে এর জন্য টাকা পাই।’ তিন ভাইয়ের মধ্যে হেনরি সবচেয়ে ছোট। বড় ভাই অ্যান্ড্রু তাঁর চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। উইলি পিঠাপিঠি। দেখতে অবশ্য হেনরিকেই উইলির চেয়ে বড় লাগে। হেনরি তাই মজা করে বলেন, ‘হি ইজ স্মলার বাট ওল্ডার।’ ছেলেবেলায় তিন ভাইকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের কাছে উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান উইলিকেই বেশি সম্ভাবনাময় মনে হতো। হেনরি অবশ্য মজা করে বলেন, ‘এটা ওর দাবি। আমি ছিলাম সবার ছোট, নিজেকে ওদের চেয়ে ভালো দাবি করলে আমার বাঁচার উপায় থাকত নাকি!’
শুনে উইলি নিকোলস হাসেন। ছোট ভাইয়ের জন্য স্নেহ ঝরে পড়া বড় ভাইয়ের হাসি!