সেই কাতারই জেতে এশিয়ান কাপ, আর বাংলাদেশ?
>গত বছরই এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-২৩ দলের সঙ্গে হেরে গিয়েছিল কাতারের অনূর্ধ্ব-২৩ দল। সেই দলেরই বেশ কিছু খেলোয়াড় নিয়ে গড়া কাতারের মূল দল এবার হারিয়ে দিল চার বারের এশিয়ার সেরা জাপানকে, জিতে নিল এশিয়ান কাপ!
তামিম আল মুহাজা, তারেক সালমান, আবদেল রহমান ফাহমি মুস্তাফা, মোহামেদ আল বাকরি— কাতার জাতীয় দলের এই খেলোয়াড়গুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের কি সম্পর্ক বলুন তো?
এরা প্রত্যেকেই গত বছর এশিয়ান গেমসে অংশ নিয়েছিলেন, খেলেছিলেন বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচটায়। যে ম্যাচে বাংলাদেশের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়ার শেষ মুহূর্তের গোলে কাতারকে হারিয়ে অঘটন ঘটিয়েছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ফুটবল সেদিনের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত কতটুকু এগিয়েছে, সেই আক্ষেপের কথায় একটু পর আসছি, ওপরে উল্লেখ করা চারজন কিন্তু ঠিকই এর মধ্যে মূল দলে সুযোগ পেয়ে জিতে নিলেন এশিয়ান কাপ! এশিয়ার পরাশক্তি ও চারবারের এশিয়ান কাপ জেতা জাপানকে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এশিয়া সেরা হলো ২০২২ বিশ্বকাপের স্বাগতিক কাতার। ফাইনালে জাপানকে ৩-১ গোলে হারিয়েছে তারা। কাতারের হয়ে গোল করেন আলময়েজ আলি, আবদুল আজিজ হাতেম ও আকরাম আফিফ। জাপানের একমাত্র গোলটি করেন তাকুমি মিনামিনো।
মাত্র কয়েক দিন আগেই বাংলাদেশের সঙ্গে হেরে যাওয়া কাতারের খেলোয়াড়েরা যেখানে এশিয়া-সেরার মুকুট পরছেন, সেখানে বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে বেশি কিছু না বলাই ভালো। কাতারকে হারানো সেই ম্যাচের পরে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে সাতটা। সাত ম্যাচে তিন জয়ের পাশাপাশি হেরেছে চারটিতে— শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ফিলিপাইন ও ফিলিস্তিনের সঙ্গে। জিতেছে ভুটান, পাকিস্তান ও লাওসের সঙ্গে। অন্যান্য দেশগুলো এই সময়ে শক্তিশালী সব প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেললেও বাংলাদেশ নাকি নেপাল-ভুটান-শ্রীলঙ্কার বাইরে প্রতিপক্ষ পায় না! তাও ভাগ্য যে বঙ্গবন্ধু কাপ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার কল্যাণে ফিলিপাইন, লাওস ও ফিলিস্তিনের সঙ্গে খেলার সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল। এরপর থেকে বাংলাদেশ জাতীয় দল অবসরেই আছে। মার্চ পর্যন্ত অবসরেই থাকবে। আগামী ৯ মার্চ কম্বোডিয়ার বিপক্ষে মাঠে নেমে আড়মোড়া ভাঙবে বাংলাদেশ জাতীয় দল।
কাতারের কথা বাদ দিন। প্রতিবেশী ভারত ফুটবলের কোথায় এগিয়ে গেছে, সে দিকেই তাকালেই হতাশার দিকটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ভারত এশিয়ান কাপের চূড়ান্তপর্বে কোয়ালিফাই করে কী দুর্দান্ত ফুটবলটাই না খেলল। দুর্ভাগ্য তাদের দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠতে দেয়নি। তবে এশীয় ফুটবলে ভারত যে উঠে আসছে, সেটি কিন্তু স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এশিয়ান কাপের মধ্য দিয়ে। প্রথম ম্যাচেই তারা থাইল্যান্ডকে ৪-১ গোল হারিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল। আরব আমিরাত আর বাহরাইনের বিপক্ষে পরের দুটি ম্যাচে নিতান্তই অনভিজ্ঞতা ভারতকে ডুবিয়েছে। বাহরাইনের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটি তো ভারতীয় সমর্থকদের জন্য আক্ষেপ হয়েই থাকবে। আমরা যেখানে নেপাল-ভুটানের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ খেলি, সেখানে ভারতের নিয়মিত প্রতিপক্ষ এশিয়ার শীর্ষ পর্যায়ের দেশগুলি। চীন, জর্ডান, ওমানের মতো দলের সঙ্গে খেলেই তারা গিয়েছিল এশিয়ান কাপে।
বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে তো আক্ষেপ আর হতাশার শেষ নেই। দিনের পর দিন ফুটবলের অভাব-অভিযোগ গুলির কথা বলা হয়, লেখা হয় পত্রিকা আর অনলাইনে। কিন্তু বাফুফে কর্তাদের কোনো হেলদোল নেই। এই তো ক’দিন আগে প্রিমিয়ার লিগ শুরু হলো, তাও একের পর এক তারিখ বদলে। একটি ফুটবল একাডেমির অভাবে রীতিমতো হাহাকার দেশের ফুটবলে। কিন্তু সেটি চালু হয়নি এত বছরেও (২০০৮ সালে বাফুফে সভাপতির পদে বসেছিলেন কাজী সালাউদ্দিন, হিসেবটা এর পর থেকেই)। প্রতিবারই সভাপতি হবে, হচ্ছে করেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সম্প্রতি তিনি আবারও একাডেমি নিয়ে সোচ্চার। সেটি কবে আলোর মুখ দেখে, প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশ্ব ফুটবলে বাংলাদেশের র্যাঙ্কিং এখন ১৯২। এটি ১৯৭-তেও নেমেছিল। ফুটবলের পুরো চিত্রটাই হতাশার!
গত ১০ বছরে টানা চারটি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছে বাংলাদেশ। রাশিয়া বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে আট ম্যাচে হজম করেছে ৩২ গোল। ভুটানের বিপক্ষে ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো হেরে এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বেও খেলা হয়নি। এর বাইরে মালদ্বীপের কাছেও ৫-০ গোল হারের লজ্জা মাথায় নিতে হয়েছে। গত বছর জাকার্তা এশিয়ান গেমস (যদিও এশিয়ান গেমসে অনূর্ধ্ব-২৩ দল খেলে) আলোর ঝলকানি হয়ে এসেছিল। কাতারকে হারানোর পাশাপাশি থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্রও করেছিল বাংলাদেশ। এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলাটাকেও দেশের ফুটবলপ্রেমীরা প্রাণভরে উদ্যাপন করেছিল। দ্বিতীয় রাউন্ডে উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে ৩-১ গোলে হারের ম্যাচেও ছিল প্রতিশ্রুতি। কিন্তু এরপর সাফে সেমিতে উঠতে না পারাটা আবারও হতাশা হয়েই দেখা দিয়েছে। সাফের সেমিফাইনালে খেললে পরিস্থিতি হয়তো অন্যরকমই হতো! বঙ্গবন্ধু কাপের সেমিতে উঠলেও প্রতিপক্ষ ছিল শক্তিশালী ফিলিস্তিন। তবে সে ম্যাচে খুব খারাপ করেনি বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের ফুটবলের সমস্যাই হচ্ছে, গতি ধরে রাখতে না পারা। ছন্দপতন আসবেই। এর মধ্যে বাফুফে যদি জাতীয় দলকে খেলার মধ্যে রাখতে পারত! প্রীতি ম্যাচের জন্য মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া কিংবা থাইল্যান্ড মানের প্রতিপক্ষ পাওয়া কী এতই কঠিন!
ফুটবল তাঁর গ্ল্যামার হারিয়েছে অনেক দিন হলো। আসলে ‘তারকা’ না থাকার কারণে মাঠে গিয়ে খেলা দেখার আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছেন ফুটবলপ্রেমীরা। তারকা সৃষ্টি করার উদ্যোগও নেই। ক্লাব গুলির দায় নিতান্তই কম নয়। সম্প্রতি ঘরোয়া ফুটবলে নবাগত বসুন্ধরা কিংস, সাইফ স্পোর্টিং প্রভৃতি দলগুলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ফুটবল উন্নয়নে আমাদের ক্লাব গুলির করণীয়তে কোন কোন জায়গায় ঘাটতি। আবাহনী-মোহামেডানের ঐতিহ্যবাহী দ্বৈরথ মৃতপ্রায়। সে কারণেই মূলত ফুটবল নিয়ে বড় জনগোষ্ঠীর আগ্রহও সীমিত হয়ে গেছে। এসব উদ্যোগের ব্যাপার। কিন্তু বাফুফে কিংবা ক্লাব-কর্তৃপক্ষ কারওরই যেন মাথাব্যথা নেই এসব নিয়ে।
ভাবা যায়, এই যুগে এসে ক্লাব গুলির খেলোয়াড় তৈরির কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের নিজস্ব কোনো একাডেমি তো দূরের কথা, বয়সভিত্তিক কোনো দলই নেই। বাফুফের একাডেমি নেই। সব ‘নেই’ ‘নেই’ এর ভিড়ে আমাদের আসলে কাতারের এশিয়ান কাপ জেতা, কিংবা ভারতের এশিয়ান কাপ সাফল্য নিয়ে আক্ষেপ করা ছাড়া কোনো উপায়ই নেই।
প্রশ্নটা হচ্ছে, এই আক্ষেপ আর কত দিন! বাফুফের ঘুম কি কখনোই ভাঙবে না?