যেবার প্রথম বাংলাদেশে এসেছিল জিম্বাবুয়ে
>বাংলাদেশের মাটিতে জিম্বাবুয়ের প্রথম সফরটা ছিল ভীষণ অন্যরকম। ডেভ হটনের জিম্বাবুয়ে তখন উদীয়মান ক্রিকেট শক্তি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। সমীহ জাগানিয়া এক দল। সে দলটাই ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দুটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে ঢাকায় এসেছিল। তীব্র লড়াই করে বাংলাদেশ হেরেছিল দুটি ম্যাচেই। আজ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ওয়ানডের আগে ফিরে দেখা হলো ২৫ বছর আগের সেই সফর
২৫ বছর আগে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর ছিল পুরোপুরিই অন্যরকম। সেটি জিম্বাবুয়ে দলের প্রথম বাংলাদেশ সফর। হালে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দল বাংলাদেশের মাটিতে এতটাই নিয়মিত যে এই প্রজন্ম তো বটেই, পাঁড় ক্রিকেটপ্রেমীদের একটা বড় অংশের কাছেই জিম্বাবুয়ের প্রথম বাংলাদেশ সফর রীতিমতো বিস্মৃত।
১৯৯৩ সালের নভেম্বরে পুরোপুরি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত সেই সফরে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দলের বিপক্ষে বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল কেবলই ‘ভালো খেলা’। এর বছর দেড়েক আগেই (১৯৯২) টেস্টের নবম সদস্য দেশ হিসেবে নাম লিখিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। আর বাংলাদেশ তখনো প্রথম বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন খুঁজে ফেরা নিতান্তই দুর্বল এক দল। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের অভিজ্ঞতা অর্জনের সেই সিরিজটি কিন্তু ছিল দারুণ জমজমাট। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত দুটি ম্যাচেই হাড্ডাহাড্ডি লড়েছিল ফারুক আহমেদের বাংলাদেশ। একটি ম্যাচে তো দুর্ভাগ্য আর অনভিজ্ঞতাই জিততে দেয়নি দলকে।
বাংলাদেশ তখন বড় এক স্বপ্নের পেছনে ছুটছিল। ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে কেনিয়াতে অনুষ্ঠিত হয় আইসিসি ট্রফি। প্রথম তিন দলের মধ্যে থাকতে পারলে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ মিলবে—এমন লক্ষ্য সামনে রেখেই ডেভ হটন, অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল, অ্যান্ড্রু ওয়ালার, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, এডো ব্রান্ডেজ, গ্রান্ট ফ্লাওয়ারদের জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নিজেদের বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিল বাংলাদেশ। মহিন্দর অমরনাথ তখন বাংলাদেশ দলের কোচ। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই দুটি ম্যাচের পর বাংলাদেশ দল নিয়ে প্রত্যাশার মাত্রা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। সবাই আশায় বুক বেঁধেছিলেন জিম্বাবুয়ের মতো শক্তিশালী দলের চোখে চোখ রেখে লড়াই করা বাংলাদেশের বিশ্বকাপ-স্বপ্ন পূরণ হবেই।
১৯৯৩ সালের ৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের প্রথম ম্যাচটি ছিল বৃষ্টি-বিঘ্নিত। বৃষ্টির কারণে ৩৮ ওভারে নেমে এসেছিল সেই ম্যাচ। টস জিতে জিম্বাবুয়েকে ব্যাটিংয়ে পাঠান বাংলাদেশের অধিনায়ক ফারুক আহমেদ। দুই ভাই অ্যান্ডি ও গ্রান্ট ফ্লাওয়ার জিম্বাবুয়েকে ভালো শুরু এনে দিতে পারেননি। দলীয় ২১ রানের মাথাতেই বাঁ হাতি পেসার জাহাঙ্গীর আলম তালুকদার দুলুর বলে মিনহাজুল আবেদীনের ক্যাচ হয়ে ফেরেন অ্যান্ডি। গ্রান্ট আউট হন ব্যক্তিগত ২৯ রানে—প্রয়াত অফ স্পিনার শেখ সালাউদ্দিনের বলে আতহার আলী খানের ক্যাচ হয়ে।
৫৪ রানে ২ উইকেট হারানো জিম্বাবুয়েকে স্বস্তি দেন অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল। তিনি খেলেন ৫৪ রানের ইনিংস। জিম্বাবুয়ের অভিজ্ঞতম ক্রিকেটার ডেভ হটন ২১ রানে আকরাম খানের হাতে ক্যাচ দেন আতহারের বলে। অ্যান্ড্রু ওয়ালারকে বোল্ড করেন বাঁ হাতি স্পিনার এনামুল হক। জিম্বাবুয়ের সংগ্রহ যখন ৩৮ ওভারে ৭ উইকেটে ১৪০, তখনই বৃষ্টির কারণে বন্ধ হয়ে যায় খেলা।
বৃষ্টির পর ৩৮ ওভারই ব্যাট করার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। ৩৮ ওভারে ১৪১ রানের লক্ষ্য। বর্তমান সময়ে খুব কঠিন কিছু নয়। কিন্তু সে সময় জিম্বাবুয়ের বোলিং আর বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের অভিজ্ঞতার বিচারে যথেষ্ট কঠিনই ছিল সে লক্ষ্য। বাংলাদেশের শুরুটাও খুব ভালো হয়নি। দলীয় ২৪ রানে ফেরেন তরুণ ওপেনার সাজ্জাদ আহমেদ। ৩৫ রানে ফেরেন আতহার। এর নিয়মিত বিরতিতেই উইকেট হারিয়েছে বাংলাদেশ। একে একে ফেরেন ফারুক আহমেদ, জাহাঙ্গীর আলম তালুকদার ও শাহনেওয়াজ শহীদ শানু। ৫৮ রানে ৬ উইকেট হারানোর পর আকরাম খান ও মিনহাজুল আবেদীনের একটা দুর্দান্ত জুটি বাংলাদেশকে প্রায় জয়ের দ্বারপ্রান্তেই নিয়ে গিয়েছিল। আকরাম করেন ৩৪। মিনহাজুল অপরাজিত থাকেন ৩১ রান নিয়ে। ৮ উইকেটে ১৩১ রান করে ৯ রানে হার মানে বাংলাদেশ।
এ ম্যাচে বাংলাদেশের সেরা বোলার ছিলেন এনামুল হক। ৬ ওভার বোলিং করে ২০ রানে ৩ উইকেট নেন তিনি। একটি করে উইকেট নেন জাহাঙ্গীর আলম দুলু, শেখ সালাউদ্দিন ও আতহার আলী খান। জিম্বাবুয়ের স্টিভেন পিল নেন ৩ উইকেট। গ্রান্ট ফ্লাওয়ার ২ উইকেট ও হিথ স্ট্রিক ১ উইকেট।
পরের দিনই, ৪ নভেম্বর ১৯৯৩ ছিল দ্বিতীয় ও শেষ ম্যাচটি। এ ম্যাচটি অনেকের স্মৃতিতেই স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে বাংলাদেশের ভয়াবহ এক ব্যাটিং বিপর্যয়ের জন্য। প্রথমে ব্যাটিং করে ৪৮ ওভারে ৭ উইকেটে ১৮৭ রান করা জিম্বাবুয়ের সঙ্গে সেদিন বাংলাদেশ ছিল জয়ের পথেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দল হারে ১৩ রানে। মাত্র ৪ রানে শেষ ৫ উইকেট হারিয়েছিল বাংলাদেশ।
আগের ম্যাচের ব্যর্থতা ঝেড়ে দারুণ ব্যাটিং করেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। ৫০ রানের ইনিংস খেলে আগে ব্যাটিং করা জিম্বাবুয়েকে ভালো শুরু এনে দেন তিনি। এদিন ফিফটি করেন ডেভ হটন (৫৪)। অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল করেন ২৭। বাংলাদেশের পক্ষে ২ উইকেট নেন পেসার সাইফুল ইসলাম। একটি করে উইকেট পান আমিনুল ইসলাম, আতহার আলী খান ও এনামুল হক।
বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের শুরুটা এদিনও ভালো হয়নি। দলীয় ১ রানেই পড়ে প্রথম উইকেট। ৫৪ রানে দ্বিতীয়। তৃতীয় উইকেটে অধিনায়ক ফারুক আর মিনহাজুল আবেদীনের মধ্যে একটা জুটি গড়ে ওঠে। ফারুক ৩২ রানে ফেরার পর মিনহাজুলের সঙ্গে তিনটি ছোট ছোট জুটি হয় আমিনুল ইসলাম, আকরাম খান আর এনামুল হকের। ৫ উইকেট ১৭০ রান তুলে বাংলাদেশ যখন জয়ের স্বপ্ন দেখছে, তখনই শুরু হয় বিপর্যয়। মিনহাজুল ও এনামুল রান আউট হন। এরপর সংগ্রহটা ১৭০ থেকে ১৭৪-এ যেতেই অলআউট বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়ের হিথ স্ট্রিক ২৫ রানে নেন ৩ উইকেট। ওমর শাহ নিয়েছিলেন ২ উইকেট। ২ উইকেট নিয়েছিলেন স্টিভেন পিল।
এরপর গত ২৫ বছরে অনেকবারই বাংলাদেশে এসেছে জিম্বাবুয়ে। এই সিকি শতকে বদলে গেছে অনেক দৃশ্যপটই। একটা সময় যেখানে শক্তিমত্তায় জিম্বাবুয়ে বাংলাদেশের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিল, সেখানে এখন ব্যাপার তার ঠিক উল্টো। এই সময় বাংলাদেশের ক্রিকেট অনেক ওপরে উঠে গেছে, জিম্বাবুয়ে ধরে রাখতে পারেনি তার অবস্থান। এক সময়ের তারকায় ভরা জিম্বাবুয়ে দল আজ ভাঙা হাট। শক্তি খুইয়ে তলানিতে এসে দাঁড়ানো জিম্বাবুয়ে দলের কোনো সফর ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে খুব বেশি আলোড়ন আজ আর তোলে না।
২৫ বছর আগে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহটা কিন্তু ছিল পুরোপুরি অন্যরকম।