ভারতে জোয়ার, বাংলাদেশে?

দারিদ্র্য ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে জলপাইগুড়ির মেয়ে স্বপ্না বর্মনের সোনালি সাফল্য। রয়টার্স
দারিদ্র্য ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে জলপাইগুড়ির মেয়ে স্বপ্না বর্মনের সোনালি সাফল্য। রয়টার্স
>

এশিয়ান গেমসে হেপ্টাথলনে এই প্রথম ভারতকে সোনা এনে দিয়েছেন জলপাইগুড়ির মেয়ে স্বপ্না বর্মন। ভারতকে ১০০ ও ২০০ মিটারে রুপাজয়ী ভারতের দ্যুতি চাঁদ ওডিশার মেয়ে। নিকট প্রতিবেশী হওয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁদের শারীরিক গঠন, খাদ্যাভ্যাসসহ সবই প্রায় এক। কিন্তু ভারতের মেয়েরা পারে, বাংলাদেশ পারে না। ভারত একটা জাতীয় লক্ষ্য স্থির করছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও সেটি পারেনি।

কত অ্যাথলেটের জীবনই রাঙিয়ে দিচ্ছে এশিয়ান গেমস। স্বপ্না বর্মণকে বোধ হয় একটু বেশিই রাঙাল। এশিয়ান গেমসে হেপ্টাথলনে এই প্রথম সোনা এনে দিয়েছেন ভারতকে। রাঙানোর জন্য সেটিই যথেষ্ট।

জলপাইগুড়ির মেয়ে স্বপ্নার দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াইয়ের গল্পটা অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণার। নিজের প্রথম এশিয়াডে সোনা। স্বপ্নার দুই পায়ে ১২টি আঙুল। ১২ আঙুল নিয়ে জন্ম নেওয়া ভারতে সৌভাগ্যের প্রতীক। তবে স্বপ্নার জীবনে তা হয়েছে যন্ত্রণার কারণ। সঠিক মাপের কেডস পেতেন না। তাই সোনা জেতার পর বলেছেন, জীবনের যন্ত্রণাই তাঁকে এত দূর নিয়ে এসেছে। জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে আবেদন করে বিশেষ জুতা বানিয়েছেন।

স্বপ্না ছাড়া অ্যাথলেটিকসে ৪০০ মিটার রিলেতে সোনা জিতেছেন ভারতের মেয়েরা। সঙ্গে ছেলেদের ৮০০, ১৫০০, শটপুট, বর্শা, ট্রিপল জাম্পের সোনা যোগ করলে সেটি হয়ে যাচ্ছে ৭টি, যা ২০০২ বুসান এশিয়াডে অ্যাথলেটিকসে পাওয়া (৭টি সোনা) সাফল্যের সমান। দেশের বাইরে এটিই এশিয়াডে অ্যাথলেটিকসে ভারতের সর্বোচ্চ সাফল্য।

১৯৫১ সালে প্রথম এশিয়াডের আয়োজক ভারত অ্যাথলেটিকসে জেতে সর্বোচ্চ ১০টি সোনা। সেই থেকে ভাঙা-গড়ায় এগোতে হয়েছে। ১৯৯০ ও ১৯৯৪ এশিয়াডে কোনো পদক আসেনি। ১৯৯৮ গেমসে ২টি, ২০০৬-এ ১টি। হারিয়ে যাওয়া সেই ভারতের অ্যাথলেটিকস আবার পথ ফিরে পেয়েছে জাকার্তায়। কাবাডি-হকির মতো ইভেন্টে সোনা হারালেও অ্যাথলেটিকস দল ভরিয়ে দিয়েছে। গতবারের চেয়ে এবার ২টি সোনা বেশি জিতেছে এই খেলায়। ৭টি সোনার সঙ্গে ৬টি রুপাসহ এবার এশিয়ার অ্যাথলেটিকসে ভারতের মোট পদক ১৯টি।

ভারতের এই সাফল্য যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ফসল, তা নতুন করে বলার নেই। তবে জ্যামাইকায় তরুণ অ্যাথলেটদের পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়াটা বড় কাজে এসেছে। এশিয়াডের আগে অ্যাথলেটদের পাঠানো হয়েছে ভুটানের পাহাড়ে। সাফল্য তো ভারতই পাবে! এত বড় দেশ। অনেক অ্যাথলেট বেরিয়ে আসছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে সবার চাকরি আছে। মাস গেলে বেতন। খেলোয়াড়দের কাজ শুধু খেলা।

সেই খেলার কাজটা এবার ভালোভাবেই সেরে ভারতের অ্যাথলেটিকস দল গতকাল ফিরে গেছে দেশে। জাকার্তা ছাড়ার আগে অ্যাথলেটিকস দলের ম্যানেজার রবীন্দ্র চৌধুরী ফোনে প্রথম আলোকে বলেন ভারতের এই সাফল্যের রহস্য, ‘আমাদের এই সাফল্যের বড় কারণ দীর্ঘ মেয়াদে ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ। ১৪ বছর বয়সে অ্যাথলেটদের আমরা বাছাই করে টানা প্রশিক্ষণে রেখেছি। সিনিয়র ও জুনিয়র দুটি দলকে সার্বক্ষণিক দুটি কোচ দিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। শারীরিক সক্ষমতা বাড়াতে আমরা ওদের বিদেশে পাঠাই।’

বাংলাদেশে বিদেশে পাঠানোর মতো তেমন সম্ভাবনাময় অ্যাথলেটই তো নেই। যাঁরা আছেন, তাঁরাও অনেক পিছিয়ে। অথচ ১০০ ও ২০০ মিটারে রুপাজয়ী ভারতের দ্যুতি চাঁদ ওডিশার মেয়ে। স্বপ্না বর্মণের মতোই বাংলাদেশের আরেক নিকট প্রতিবেশী। শারীরিক গঠন, খাদ্যাভ্যাসসহ সবই প্রায় এক। কিন্তু ভারতের মেয়েরা পারে, বাংলাদেশ পারে না। ভারত একটা জাতীয় লক্ষ্য স্থির করছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও সেটি পারেনি। এই গেমসে ভারত এনেছে ৫০ জন অ্যাথলেট। বাংলাদেশের ১৪টি খেলায় ১১৭ জনের বিশাল বহরে দুজন মাত্র অ্যাথলেট, যাঁরা হিটেই বাদ।

বাংলাদেশে সমস্যা অনেক। অ্যাথলেটশূন্যতা তীব্র হয়েছে আরও। এখানে এসে ৫০ টাকার একটি মেডেলের জন্য কেউ লালায়িত হচ্ছে না বলেই সংশ্লিষ্টদের ধারণা। ১০ হাজার টাকা মূল্যের একটা চাকরির আশায় মেয়েরা চলে যাচ্ছে অন্যদিকে। মূলত বাহিনীগুলো আর বিকেএসপি যা একটু পৃষ্ঠপোষণা করছে অ্যাথলেটদের। কিন্তু বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকস কোচ রাজিয়া সুলতানা অনু মনে করেন, সরকারি নানা সংস্থা এগিয়ে না এলে চলবে না। বাংলাদেশ লক্ষ্যহীন, খেলোয়াড়ের জন্য ৪০০ টাকা খাওয়ার বরাদ্দে ২০০ টাকাই ‘হাপিস’ হয় বলে অভিযোগ আসে প্রায়ই!

অথচ অনেক দেশই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে। দেশে প্রতিভা না থাকলেও ভাড়া করে আনছে। যেমনটা করেছে বাহরাইন। জাকার্তায় চীনের মতো অ্যাথলেটিকসে তারাও জিতেছে ১২টি সোনা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি আফ্রিকার নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, মরক্কোর উঠতি অ্যাথলেটদের নাগরিকত্ব দিয়ে জাতীয় দলে নিচ্ছে। এরাই দিচ্ছে সাফল্য। বিশেষ করে দৌড়ের ইভেন্টে। এবার বাহরাইনের ১২টি সোনার ১০টিই দৌড়ে।

আফ্রিকানরা উন্নত জীবনযাপনের আশায় বাহরাইনে ভিড় জমাচ্ছে। ১৫০০ ও ৫০০০ মিটার দৌড়ে সোনাজয়ী ইথিওপিয়ার অ্যাথলেট কালকিদেম বেফকাদু সেটাই বলেন, ‘বাহরাইন আমাদের ভালো টাকা, সুযোগ-সুবিধা দেয়। তাই এখানে ইথিওপিয়ানরা আসে। আমি এই দেশের হয়ে খেলে খুবই খুশি।’ বাংলাদেশে সুযোগ-সুবিধা নেই। তাই বিদেশিরা তো প্রশ্নই আসে না, স্থানীয়রা খুব অল্পতেই তুষ্ট থাকলেও তাদের জন্য বলার মতো সেই ব্যবস্থাও নেই। তৃণমূল স্তরেও চলছে তীব্র খেলোয়াড়-সংকট, যার প্রমাণ গত জাতীয় অ্যাথলেটিকসে জেলা থেকে কোনো অ্যাথলেটের উল্লেখযোগ্য সাফল্য না পাওয়া।