একটু ভেবে দেখবেন?
‘এগুলাতে বিশ্বকাপের খেলা দেখাইতে পারে না?’
‘হু?’ বলেই একটু ডানে-বামে তাকালাম। পল্টনে ওঠার পর অর্ধেক পথ নিঃশব্দেই গাড়ি চালিয়েছেন মাঝবয়সী রিকশাচালক। হঠাৎ করে এমন প্রশ্নে তাই পরিস্থিতি বুঝতে চাইলাম। ডান থেকে দৃষ্টি বাঁয়ে নিতেই বুঝলাম উনি কী নিয়ে কথা বলছেন।
রমনা পার্ক ধরে শেরাটন যাওয়ার পথে রাস্তার পাশ দিয়ে একটু পর পর ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে। খাম্বায় বসানো সেই ডিসপ্লেগুলোতে চলে বিজ্ঞাপন। গুলশান, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডসহ ঢাকা শহরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় এ ধরনের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। রিকশাচালক চাচা জানতে চান, এগুলোতে কী খেলা দেখানো হবে বিশ্বকাপের সময়?
কারণটাও ব্যাখ্যা করলেন, ‘এগুলাতে দেখাইলে বিশ্বকাপটা দেখতে পারতাম। কী কন, দেখাইব না?’ নিজের অজ্ঞতা স্বীকার করে নিলাম, ‘তা তো জানি না। তবে বেশ কয়েক জায়গায় বড় স্ক্রিনে দেখায় খেলা।’
‘হ, জানি তো। শাহবাগে! কিন্তু আমি তো এদিক দিয়াই বেশি যাই। আর অনেক জ্যাম পরে। রাস্তায় আটকায় থাকলে তখন খেলা দেখতে পারতাম।’
মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বিশ্বকাপ নিয়ে আমজনতার মধ্যে কতটা কৌতূহল, তা বোঝা যাবে অনেক রিকশায় লাগানো পতাকা থেকে। পতাকা ছড়িয়ে আছে আনাচকানাচে।
যে প্রশ্নটা এ সময়ে অবধারিত, সেটাও করে ফেললাম তাঁকে। ‘ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা?’ প্রশ্নটা করার জন্য করা। কয়েক দিন আগেই নাকি এক জরিপে দেখিয়েছে, বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার সমর্থক বেশি।
‘ব্রাজিল!’
আমি বললাম, ‘কেন? নেইমারের জন্য?’
‘আরেহ না। হেয় কি আর অমন পেলেয়ার হইল!’
‘কবে থেকে ব্রাজিলের সাপোর্টার?’
‘সেই ৯৪ থেকে।’ ব্যাস, আমি উত্তর পেয়ে গেলাম। তবু নিশ্চিত হতে প্রশ্ন, ‘তাহলে রোনালদোর জন্য?’
‘না।’ এবার বিপদে পড়ে গেলাম, ‘তাহলে?’ ‘ওগো পুরা দলের খেলা ভালো তাই।’
অন্য পথে গেলাম, ‘মেসিরে ভালো লাগে না? সবাই তো মেসির জন্য পাগল।’
চাচা সেদিন যেন শুধু ধাক্কা দেওয়ার খেলাতেই নেমেছিলেন। ‘আরে ধুর, কাদের কথা কন, মেসি-নেইমার। এগুলান কোনো পেলেয়ার!’
হার মেনে নিলাম। নিজে থেকে আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস হলো না। চাচা তাই নিজেই তাঁর ’পেলেয়ারে’র গল্প বলা শুরু করলেন, ‘আরে আসল লোক হইল ম্যারাডোনা।’ বিস্মিত হওয়ার সীমা আগেই শেষ হয়ে গেছে। তাই শুধু বললাম, ‘ওহ।’
‘আরে মাঠের এক সাইড থাইকা অন্য সাইডে গেছে, একবারে সাত-আটজনরে কাটায়া গোল দিছে। নেইমার-মেসি জীবনে এসব করতে পারছে?’
লা লিগায় মেসির অমন এক গোল আছে বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। বিশ্বকাপের এক গোলের সঙ্গে লিগ গোলের তুলনা দিতে গেলে এই ব্রাজিল সমর্থক ম্যারাডোনাপ্রেমী মেনে নেবে বলে মনে হয় না।
চাচার গল্প শেষ হয়নি তখনো, রিকশা চালাতে চালাতেই ম্যারাডোনা-স্তুতি চলছে, ‘বলটা একবার পায়ের থন হাঁটুতে নেয়, সেখান থাইকা মাথায়, তারপর ঘাড়ে ফেলে, সেখান থেকে আবার বুকে। নেইমার-মেসি পারব এসব করে দেখাইতে?’
উত্তর দেওয়ার ফুরসত পাচ্ছিলাম না। চাচা কথার টানেই শেরাটনের মোড় পার হচ্ছেন। ডানে-বামে গাড়ির মাঝখান দিয়ে রিকশা ছোটাতে ছোটাতেই ম্যারাডোনার স্কিল বুক-পা-কাঁধ ব্যবহার করেই দেখাচ্ছিলেন। রিকশা চালিয়ে ওই স্কিল কীভাবে দেখাচ্ছেন সে চিন্তা নয়, মাথায় তখন, ‘এই বুঝি গেল গেল’ চিন্তা।
একটু পর চাচার হাত পা শান্ত হয়ে হলেও মুখ কিন্তু চলছেই। ‘মেসি-নেইমার নিয়া পোলাপান লাফায়। এগুলা কোনো দিন ম্যারাডোনারে দেখলে বুঝত। গেরামে কারেন ছিল না। স্টেশনের পাশে জেনারেটর আইনা টিভি দেখছি, আহ কী সুন্দর দৌড়, কেমনে গোল দেয়। কেমনে কাটায়। এগুলা এরা পারে? পারে না। ম্যারাডোনা সবাই হয় না।’
আমাকেও মাথা দুলাতে হলো, আসলেই ম্যারাডোনা সবাই হয় না।
‘আইচ্ছা মেসির সঙ্গে ম্যারাডোনার কী সম্পর্ক?’ থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করতে হলো, ‘মানে?’ ‘মানে মেসি বলে ম্যারাডোনার মাইয়ার জামাই!’ এক দেশের সেরা দুই ফুটবলারের এত কাছাকাছি আসার এমন অপরূপ ভুল ভাঙাতে হলো, ‘না, মেয়ের জামাই ছিল আগুয়েরো।’
‘এটা কোনটা? কত নম্বর পরে?’ আবার আমতা-আমতা করে স্বীকার করতে হলো, ‘তা তো ঠিক জানি না, ১৭ বা ১৯!’ (মেসির গোল আর হিগুয়েইনের মিস নিয়ে আলোচনার ফাঁকে আগুয়েরোর জার্সি নম্বর খুব একটা খেয়াল করা হয় না।)
ম্যারাডোনার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই শুনে মেসির ব্যাপারে চাচা একেবারেই আগ্রহ হারালেন। বললেন বিশ্বকাপে ম্যারাদনার জামাইর খেলাই দেখবেন। নামার আগে শেষ প্রশ্ন, ‘কে জিতবে বিশ্বকাপ?’ ‘এবার ব্রাজিলই জিতব। ম্যারাডোনা তো আর নাই!’
নিজের দলের ভবিষ্যদ্বাণীতেও ব্রাজিল সমর্থকের ম্যারাডোনার প্রতি এমন ভালোবাসা! ফুটবল বলেই হয়তো সম্ভব।
একটা অনুরোধ: বিশ্বকাপ উপলক্ষে রাস্তার পাশের বিজ্ঞাপনী বোর্ডে কি আসলেও খেলা দেখানো সম্ভব? সেটা যদি নাও হয়, গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গায় বাড়তি কিছু জায়ান্ট স্ক্রিন বসিয়ে খেলা দেখার ব্যবস্থা কি করা যায় না? ট্রাফিক জ্যামে বসে থাকা হাজার হাজার মানুষ অন্তত কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও অসহনীয় কষ্টের কথা ভুলে যাবেন ফুটবল-প্রেমে মজে।