ক্রিকেট নিয়ে আফগানদের পাগলামির 'নজির' নাজির
বাংলাদেশের টাইগার শোয়েব-টাইগার মিলন, ভারতের সুধীর যেমন; আফগানিস্তানেও আছেন এমন ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ এক দর্শক। পরিচিত হন সেই নাজির খানের সঙ্গে।
নাজির খান নাকি নিজের বয়স জানেন না! তা হলে পাসপোর্ট হলো কী করে? তাতেই তো বয়স লেখা আছে? কথাটা বলতেই ফিক ফিক করে হাসলেন। তারপর, ‘পথের পাঁচালী’র ইন্দির ঠাকরুণের মতো নানি-দাদিরা যেমন ফোকলা মুখে থুতনি নেড়ে হেসে বলে থাকেন, ওই তিন কুড়ি কি চার কুড়ি হবে, তেমনই সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে ভাঙা হিন্দিতে বললেন, ‘পঞ্চাশ হতে পারে, ষাটও। বয়স নিয়ে বেশি ভাবি না। ভাবি সুস্থ থাকার কথা। সুস্থ না থাকলে টিমের সঙ্গে এখানে-সেখানে যাব কী করে?’
টিম মানে আফগানিস্তানের জাতীয় ক্রিকেট দল। বয়স না জানার মতোই নাজির খান ভুলে বসেছেন কবে থেকে আফগানিস্তানের জাতীয় দলের সঙ্গে তাঁর ঘোরাফেরা শুরু। যদিও এটা মনে আছে, আবুধাবিতে প্রথম খেলা দেখার পর থেকে কী জানি কী হয়ে গেল, জীবনের একটা নতুন বাঁকের সামনে এসে তিনি দাঁড়ালেন।
প্রতি ম্যাচে ট্রেড মার্ক পোশাক পরে দেশের পতাকা হাতে নিয়ে দেরাদুনের রাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আসা ওঁকে দেখতাম। গ্যালারিতে বসে পতাকা দোলাতেন। ওই যেমন ভারতের টাক-মাথা সুধীর অথবা বাংলাদেশের ওই ‘রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার’ সাজা শোয়েব যা করে থাকেন। ওঁদের মতো নাজির খানও আফগান ক্রিকেটের একমাত্র ‘মাসকট’। যেখানে আফগানিস্তান, সেখানেই নাজির খান।
সিরিজ শেষে ফেরার দিন আলাপ হলো বিমানবন্দরে। দেরাদুন থেকে দিল্লি ফিরছেন। সেখান থেকে কাবুল। কটা দিন কাবুলে কাটিয়ে ফের ফিরবেন ভারতের বেঙ্গালুরুতে। সাক্ষী থাকবেন ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের প্রথম টেস্ট ম্যাচের।
বিমানের অপেক্ষায় থাকা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সঙ্গে খোশগল্প করছিলেন। ডাকতেই উঠে এলেন। সেই জানলাম, মানুষটির নাম নাজির খান। সাকিন কাবুলের দক্ষিণ-পুবে পাকটিয়া প্রদেশে। বেশ গর্ব করে বললেন, ওই পাকটিয়া থেকেই শপুর জাদরান, দৌলত জাদরান, নাজিবুল্লাহর মতো ক্রিকেটার উঠে এসেছেন। এই প্রদেশটি ছাড়া আর যে প্রদেশগুলো আফগান ক্রিকেটারদের আঁতুড়ঘর, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে কাবুল, নানগড়হার, লোগার, খোস্ত ও জালালাবাদ। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের ১০ বছরে যাঁরা উদ্বাস্তু হয়ে পাকিস্তানের নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্সে ডেরা বেঁধেছিলেন, যুদ্ধ শেষে দেশে ফেরার সময় তাঁরাই সঙ্গে নিয়ে যান ক্রিকেটকে। নামে আফগানিস্তান হলেও জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে এই প্রদেশগুলোর আধিক্যই বেশি।
চার ছেলে ও তিন মেয়ের বাবা নাজির খান। পেশায় রাজমিস্ত্রি। ১৭ বছর আগে দুবাই চলে যান। সেখানে কনস্ট্রাকশন এলাকায় মাটি কাটার ব্যবসা শুরু করেন। মাসে নাকি রোজগার হতো ১০ হাজার দিরহাম! আবুধাবিতে আফগানিস্তানের খেলা দেখার পর কী যে হলো, একটা খেলা বাদ তো দিলেনই না, একদিন কাজ-কারবার শিকেয় তুলে ফিরে গেলেন দেশে। লেপ্টে গেলেন দলের সঙ্গে।
খরচপত্র? সংসার? চলে কী করে?
প্রশ্নগুলো শুনলেন, তবে উত্তরটা মুখে না দিয়ে আকাশের দিকে হাত তুলে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে হাসলেন সেই অমায়িক হাসি। তারপর ভাঙা হিন্দিতে বললেন, ‘ও সব আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি।’
সাদা সালোয়ার-কুর্তার ওপর আফগান জাতীয় পতাকার রঙে বানানো স্পেশাল জ্যাকেট। সেই জ্যাকেটের পকেট থেকে বের করলেন তাঁর মোবাইল ফোন। সেই ফোনে হাজারো ছবি। কিন্তু আফগান ক্রিকেটারদের সঙ্গে ছবি ছাড়া আর কিছুই নেই। হাসতে হাসতে বললেন, ‘এটাই আমার শখ। টিমের ছেলেরা সবাই বাবার মতো সম্মান করে। আমায় কিছুই করতে হয় না। আসা-যাওয়ার টিকিট, থাকা-খাওয়ার খরচ কিচ্ছু না। বোর্ড দিনে ৫০ ডলার করে দেয়। আর কী চাই?’
বিমানে ওঠার আগে নাজির খান বললেন, ‘প্রায় ৪০ বছর ধরে দেশে লড়াই চলছে। সেই লড়াই ক্রিকেটকে শেষ করতে পারেনি। বরং ক্রিকেটই দেশটাকে জুড়ছে। ইনশা আল্লাহ, ক্রিকেটই একদিন আমাদের দেশে শান্তি আনবে। সেই দিনটা দেখে যেতে চাই।’