বিশ্বকাপ না জিতলেও সেরা দল বলা হয় যাদের
>ডিয়েগো ম্যারাডোনাই তো কিছুদিন আগে বলেছিলেন, ফেবারিটরা নাকি বিশ্বকাপ জেতে না। আর্জেন্টাইন ফুটবল কিংবদন্তির মন্তব্য শতভাগ সঠিক না হলেও এটা ঠিক যে ইতিহাসই বলে, বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী সেরা দলগুলোই যে সব সময় শিরোপা জিতেছে—এমন নজির নেই। কিছুটা ভাগ্য, বেশ খানিকটা চেষ্টা, পারফরম্যান্স আর নির্দিষ্ট দিনে কৌশলের কার্যকর প্রয়োগ—বিশ্বকাপ নির্ভর করে এসবের ওপরই। এ কারণেই যুগে যুগে অনেক দল দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলেও ম্যাচে হোঁচট খেয়ে বিশ্বকাপ ট্রফিটা নিজের করে নিতে পারেনি। কারা তারা?
১৯৩৮ বিশ্বকাপের ব্রাজিল
১৯৩৮ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইতালি। তবে বিশ্বকাপটা অনেকেই মনে রেখেছে ব্রাজিলের তুখোড় স্ট্রাইকার লিওনিদাস দা সিলভার দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের জন্য। সেবার প্রথম দুই রাউন্ডে ৬ গোল করে নিজেকে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন তিনি। ব্রাজিলের অসাধারণ পারফরম্যান্সের কারণেই কিনা কোচ আদেমার পিমেন্তো সেমিফাইনালের প্রতিপক্ষ ইতালিকে অতটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেননি। ফাইনালে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে ফর্মে থাকা লিওনিদাসকে সেদিন মাঠেই নামাননি। ভেবেছিলেন লিওনিদাসকে এক দিন বিশ্রাম দেবেন। তা ছাড়া ফাইনালে তো তারা উঠছেনই। বিধি বাম। ব্রাজিলকে ২-১ গোলে হারিয়ে ফাইনালে উঠে যায় ইতালি।
১৯৫০ বিশ্বকাপের ব্রাজিল
ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপের ফাইনালে মারাকানার লাখ লাখ ব্রাজিল সমর্থককে হতাশার সাগরে ডুবিয়ে ট্রফি নিয়ে উল্লাস করেছিল উরুগুয়ে। সেবার ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয় সম্পর্কে মোটামুটি সকলেই নিঃসন্দেহ ছিলেন। দলে ছিলেন আদেমির ও জিজিনিহোর মত তুখোড় খেলোয়াড়। ফাইনাল ম্যাচের দিন ব্রাজিলের দৈনিক ‘এল মুন্দো’ পুরো স্কোয়াডের ছবি প্রথম পাতায় ছেপে শিরোনাম দিয়েছিল ‘এরাই হলো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন’। সেই শিরোনামটাই মূলত তাতিয়ে দেয় উরুগুয়েকে। ফাইনালে ব্রাজিল অবশ্য প্রথমে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শিয়াফিনো ও আলসিদেস ঘিগিয়ার গোলে পুরো ব্রাজিলকে স্তব্ধ করে দিয়ে শিরোপা জেতে উরুগুয়ে।
১৯৫৪ বিশ্বকাপের হাঙ্গেরি
ফেরেঙ্ক পুসকাস, স্যান্দর ককসিস, ন্যান্দর হিদেকুটি, জোলতান জিবোর—এই নামগুলো দিয়ে যে দলের আক্রমণভাগ গড়া সে দলে সঙ্গে খেলাটা কতটা কঠিন, সেটা সবাই জানে। ১৯৫৪ বিশ্বকাপে হাঙ্গেরি যখন এই খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া দল বিশ্বকাপে নিয়ে এল, তখন বেশির ভাগ মানুষই বলেছিলেন, পুসকাসের হাঙ্গেরি বিশ্বকাপ না জিতে পারেই না। কিন্তু ঘটল ঠিক উল্টোটা। হাঙ্গেরি ফাইনালে উঠলেও তারা হেরে গেলে পশ্চিম জার্মানির কাছে ৩-২ গোলে হেরে যায়। প্রথমে ২ গোলে এগিয়ে থেকেও ম্যাচটা হাঙ্গেরি কীভাবে হারল, সেটি আজও এক রহস্য। অথচ গ্রুপ পর্বেই হাঙ্গেরি জার্মানিকে হারিয়েছিল ৮-৩ গোলে!
১৯৬৬ বিশ্বকাপের পর্তুগাল
বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় তখন ইউসেবিও। পেলে-গারিঞ্চার ব্রাজিল সেবার গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়, সেই গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হয়েই পরের রাউন্ডে যায় ইউসেবিওর অদম্য পর্তুগাল। মন মাতানো ফুটবল খেলে সেমিফাইনালে ওঠা পর্তুগালকে ২-১ গোলে হারিয়ে ‘অঘটন’ ঘটায় ববি চার্লটনের ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপ শিরোপাও ওঠে তাদের ঘরেই। ওদিকে বিশ্বমঞ্চে নিজের দেশের হয়ে কিছু না জেতার আক্ষেপ নিয়েই ক্যারিয়ার শেষ করতে হয় ফিগো-রোনালদো-পূর্ব যুগের সবচেয়ে বড় পর্তুগিজ তারকাকে।
১৯৭৪ বিশ্বকাপের হল্যান্ড
বিশ্বে তখন টোটাল ফুটবলের জয়জয়কার। কোচ রাইনাস মিশেলস ও তাঁর যোগ্য শিষ্য ইয়োহান ক্রুইফের নেতৃত্বে ডাচরা নিয়ে আসে ফুটবলের এমন এক তরিকা, যার জবাব ছিল না কারোর কাছেই। ‘টোটাল ফুটবল’ ছিল সে তরিকারই পোশাকি নাম। ক্লাব পর্যায়েও তখন ডাচ ক্লাব আয়াক্স আমস্টার্ডামের স্বর্ণযুগ, সেটি এই ক্রুইফ-মিশেলসের কল্যাণেই। ১৯৭৪ বিশ্বকাপে সবার চোখে তাই ডাচরাই ছিল বিশ্বকাপের যোগ্য দাবিদার। কিন্তু ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, জার্ড মুলাররা তা মানবেন কেন? ফাইনালে হল্যান্ডকে থামিয়ে দেয় তারা ২-১ গোলে জিতে। বলা হয়ে থাকে, সেই ম্যাচের আগে ক্রুইফদের বিরুদ্ধে মেয়েদের নিয়ে উদ্দাম পার্টির মিথ্যা অভিযোগ তোলে জার্মান পত্রিকা ‘বিল্ড’, যা দেখে মারাত্মক খেপে যান ক্রুইফের স্ত্রী। ফাইনালের আগের রাতের প্রায় পুরোটাই ক্রুইফ ব্যয় করেন ফোনে স্ত্রীকে বোঝাতে। এমনটা করতে হলে প্রস্তুতিটা ভালো হবে কীভাবে!
১৯৮২ বিশ্বকাপের ব্রাজিল
মিডফিল্ডে ফ্যালকাও-জিকো-সক্রেটিস-টোনিনহো আর স্ট্রাইকিংয়ে সার্জিনহোর মতো তারকা। ফুটবলপ্রেমীদের কাছে ১৯৮২ সালের ব্রাজিল দলটি ছিল অন্য রকম রোমান্টিকতায় ভরা। একধরনের মাদকতাও ঘিরে ছিল তাদের নিয়ে। বিরাশির ব্রাজিল বিশ্বকাপ জেতেনি। অথচ তর্কযোগ্যভাবে তাদের বিশ্বকাপ না জেতা শ্রেষ্ঠতম দল বলে থাকেন অনেকেই। জিকো-সক্রেটিসদের দৃষ্টিনন্দন ফুটবল, সেই ‘জোগো বোনিতো’ দশৃকদের মন ভারালেও শিরোপার জন্য যথেষ্ট হয়নি। সেটা পেতে যে ভাগ্য লাগে অনেকটাই। সেই ভাগ্য সেবার ছিল ইতালির সঙ্গে।
১৯৯৮ বিশ্বকাপের ব্রাজিল
বিশ্ব ততদিনে দেখে ফেলেছে রোনালদো নাজারিও দা লিমা নামের এক তারার উত্থান। পরপর দুবার বিশ্বের সবচেয়ে দামী খেলোয়াড় হয়ে বার্সেলোনা ও ইন্টার মিলানের হয়ে নাম লেখানো এই স্ট্রাইকারের ওপরেই ছিল ব্রাজিলের সব আশা–ভরসা। সঙ্গে কাফু, দুঙ্গা, তাফারেল, রিভালদো, রবার্তো কার্লোস, বেবেতোর মতো তারকারা। এই দলই ছিল ১৯৯৮ ফ্রান্স বিশ্বকাপের টপ ফেবারিট। প্রত্যাশামতো ফাইনালে ওঠা ব্রাজিল মুখোমুখি হয়েছিল স্বাগতিক ফ্রান্সের। কিন্তু পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলা রোনালদো কোন এক রহস্যময় অসুখে পড়ে যান ফাইনালের আগে। বলা হলো, ফাইনালের চাপ নিতে পারেননি তিনি। ফাইনালের মূল একাদশে প্রথমে রাখা হলো না, পরে আবার একাদশ পরিবর্তন করে রোনালদোকে ঢোকানো হলো। কিন্তু রোনালদো থাকলেন নিজের ছায়া হয়ে। ওদিকে ফ্রান্সের হয়ে জিনেদিন জিদান নামের আরেক অসাধারণ তারকা মিডফিল্ডার জোড়া গোল করে ফ্রান্সকে এনে দিলেন শিরোপা।
২০০৬ বিশ্বকাপের ফ্রান্স
এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে আলোচিত, সমালোচিত ঘটনা হয়ে আছে জিদানের সেই বিখ্যাত ঢুস। হৃদয়বিদারক ছবিটি এখনো দর্শকদের মনে গাঁথা আছে—বিশ্বকাপকে পাশে রেখে লাল কার্ড দেখা জিদান মাথা নিচু করে টানেলে ঢুকে যাচ্ছেন। সেবার বিশ্বকাপ জয়ের ব্যাপারে ফেবারিট ছিল ফ্রান্সই। দলকে দ্বিতীয় শিরোপা জেতাতে অবসর ভেঙে ফেরেন জিদান, লিলিয়াম থুরাম, ম্যাকালেলেরা। সঙ্গে ছিলেন থিয়েরি অঁরি আর প্যাট্রিক ভিয়েরার মতো খেলোয়াড়। দুর্ধর্ষ খেলেই ফাইনালে ওঠা ফ্রান্স ইতালির কাছে হেরে শিরোপা হারা। ফাইনালে পেনাল্টি থেকে গোল করে এগিয়ে গিয়েছিল ফ্রান্সই। কিন্তু এরপরই ইতালির ডিফেন্ডার মার্কো মাতারাজ্জি জিদানকে উত্যক্ত করে ঢুস খান। সেই ঘটনায় লাল কার্ড দেখেন জিদান। ফরাসি তারকা মাঠ থেকে বেরিয়ে না গেলে সেদিন ফল অন্য রকম হতে পারত বলেই ধারণা অনেকের। মাতারাজ্জির গোলে ইতালি সমতা ফিরিয়ে পরে টাইব্রেকারে জিতে নেয় নিজেদের চতুর্থ বিশ্বকাপ।