সালাহ, আপনার সঙ্গে আমিও কেঁদেছি

সালাহ বেরিয়ে গেছেন শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে! এএফপি ফাইল ছবি
সালাহ বেরিয়ে গেছেন শিশুর মতো কাঁদতে কাঁদতে! এএফপি ফাইল ছবি
লিভারপুল তারকা মোহাম্মদ সালাহকে নিয়ে বিশেষ কলাম লিখেছেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী কবরী
কবরী
কবরী

ফুটবল আমার প্রাণের খেলা। চট্টগ্রামে ছোটবেলায় ভাইদের সঙ্গে পাড়ার ফুটবল খেলা দেখতে যেতাম। অনেক সময় তাদের দেখতাম ফুটবলের পরিবর্তে জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলত। এখনো ফুটবল নিয়ে আবেগ এতটুকু কমেনি। আর আমি লিভারপুলের সমর্থক।

ছেলে সাকের অক্সফোর্ডে পড়তে যাওয়ার পর লিভারপুলকে বেছে নিয়েছিল তার ভালোবাসার দল হিসেবে। ওর সঙ্গে বিভিন্ন সময় খেলোয়াড়, কোচ; কর্নার, পাসিং; রক্ষণাত্মক, আক্রমণাত্মক ফুটবল—এসব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লিগের খেলা বসে দেখতাম। আমাকে সাকের খেলা দেখার সঙ্গী করেছে। আর মোহাম্মদ সালাহর খেলায় আমি মুগ্ধ। এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল দেখতে বসেছিলাম অনেক আশা নিয়ে।

আমরা চাইতাম প্রতিটি খেলায় যেন সালাহ গোল করতে পারেন। তাঁর খেলার মধ্যে এমন এক জাদুকরি শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যাঁরা ফুটবল দেখেন, তাঁরা মুগ্ধ না হয়ে পারেন না। ছোট ছোট পায়ে তিরতির করে বল এগিয়ে নিয়ে যান যখন, এত দ্রুত, তাঁর পা-ই দেখা যায় না। খেলা শুরু হওয়ার আগে তাঁর প্রার্থনা এতই নিবেদিত যে দর্শকসারিতে পর্যন্ত একটা শব্দঝড় শোনা যায়—সালাহ, সালাহ, সালাহ!

মাঠে ফাউলের শিকার হলে শিশুর মতো অসহায় মুখভঙ্গি করে উঠে দাঁড়ান তিনি। কখনোই তিনি রাগ করেন না। ফাইনাল খেলার জন্য তাঁর মানসিক প্রস্তুতি ছিল। শান্ত, সৌম্য, তেজদীপ্ত ও আস্থার ছায়া ফুটে উঠছিল। হঠাৎ অতর্কিত ‘দানব’ রামোসের আঘাতে সালাহর সমস্ত আশা ভঙ্গ হয়ে গেল। ককিয়ে উঠলেন ব্যথায়। অসহায় হয়ে ছোট্ট শিশুর মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। খেলতে না পারার তীব্র বেদনা তাঁর চেয়ে কে বেশি বুঝতে পেরেছেন! মাঠ থেকে যখন তিনি চলে যাচ্ছিলেন, উফ্‌, তাঁর বুকের ভেতরের কষ্ট, তাঁর বুকফাটা কান্নাও চেপে রেখেছিলেন।

তাঁর মুখে কোনো প্রতিবাদ আসেনি, এমনকি হলুদ কার্ড, লাল কার্ড পর্যন্ত সেই খেলোয়াড়কে দেখাননি রেফারি। আমাদের চোখে পানি এসে গিয়েছিল। ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। খেলা দেখার আর কোনো উৎসাহ নেই। ভাবছিলাম, ভবিতব্য নিষ্ঠুর, প্রতারক! প্রথম আলো লিখেছে ক্লপ নাকি ‘হারের বিশেষজ্ঞ’। এই কথার সঙ্গে একমত নই।

ক্লপের সবকিছু দুর্দান্ত। নিবেদিত জার্মান কোচ তাঁর টিমকে জেতানোর জন্যই সবটুকু উজাড় করে দেন। স্বল্পভাষী ক্লপকে লক্ষ করেছি অত্যন্ত ভদ্র, মার্জিত। আনন্দ যেমন প্রতিপক্ষকে কষ্ট দেয় না, আবার হেরেও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় না। একজন নিবেদিত পেশার মানুষকে অনেক গুণের সমন্বয়ে তৈরি হতে হয়। এত বড় শক্তিশালী দল রিয়াল মাদ্রিদ। তার বিপক্ষে তরতাজা কয়েকজন তরুণ খেলোয়াড়কে নিয়ে ক্লপ যে মোকাবিলা করেছেন, এ জন্য তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিতে হয়। সাহসী ও নিবেদিত সালাহ এই দলের সেই মাপের বড় তারকা। তাঁর বদলি আর সমকক্ষ আর কোনো খেলোয়াড় নেই লিভারপুলে।

অথচ রিয়াল মাদ্রিদে রোনালদো ছাড়াও অনেক তারকা খেলোয়াড় ছিলেন। প্রথমার্ধের পর মাঠে নেমে গ্যারেথ বেলই এসে দুইটা গোল দিয়েছেন। এতেই বোঝা যায়, সালাহ কিংবা ক্লপ কাদের সঙ্গে লড়েছেন। কম বাজেটের পরিণামের কাছে ক্লপের যে পরাজয়, এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। সালাহর আঘাতের পর পুরো দল এক অসহায় ও অশনিসংকেতের মুখোমুখি হয়। এই ধাক্কা আর সামলাতে পারেনি লিভারপুল।

ভয়টা আরও বড়। সালাহকে আগামী বিশ্বকাপে পুরো সামর্থ্যে খেলতে দেখা যাবে কি না, সে প্রশ্ন থাকছে। তবু আমাদের মতো আরও অনেক ক্রীড়ামোদী দোয়া করছেন, অপার সম্ভাবনার এই খেলোয়াড় সালাহ যেন বিশ্বের মুখ উজ্জ্বল করতে পারেন। সৎ, নিবেদিত সুন্দর মানুষ সালাহর জন্য আমাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা সব সময় থাকবে। কোনো ‘অপশক্তি’ যেন ছিনিয়ে নিতে না পারে। এমন মানুষের জন্য আমাদের আশীর্বাদ থাকবে। সব ‘অপশক্তি’র বিরুদ্ধে ক্লপ-সালাহ ও আমরা।

লেখক: প্রখ্যাত অভিনেত্রী