>
স্থানীয় সরকার বিভাগের নেতৃত্বে সবার জন্য স্যানিটেশনের একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা হলো।
যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে স্যানিটেশনের হারের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। অনুমান করা হয়, সত্তরের দশকে গ্রামাঞ্চলে স্যানিটেশনের হার ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায় বা ১ শতাংশের নিচে। গ্রামাঞ্চলে ১৯৮১ সালেও স্যানিটেশনের হার ছিল মাত্র ০১ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ছিল মাত্র ২২ শতাংশ। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের জন্য বাজেটের প্রায় ২ দশমিক ৪৮ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তা ২ দশমিক ১৪ শতাংশে এবং তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ১ দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে আসে। নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন খাতে বাজেট বরাদ্দে ২০০৯ সালের উল্লম্ফনের আগ পর্যন্ত বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে একটি স্থিতাবস্থা বিরাজ করছিল। এমন পরিস্থিতি সত্ত্বেও গ্রামপ্রধান বাংলাদেশে খোলা মাঠে পায়খানার হারকে ১৯৮১ সালের ৯৯ শতাংশ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে শূন্যে নামিয়ে আনা উন্নয়ন ক্ষেত্রে একটি বিস্ময় বা ধাঁধা বলা যেতে পারে।
সত্তরের দশকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশে নলকূপ প্রচলনের উদ্যোগের পাশাপাশি ইউনিসেফ প্রদত্ত ভর্তুকি দিয়ে স্যানিটারি ল্যাট্রিন বিতরণেরও উদ্যোগ নেয়। নলকূপের ব্যাপারে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও স্যানিটারি ল্যাট্রিনের ব্যাপারে খুব একটা সাড়া পাওয়া যায়নি। আশির দশককে আন্তর্জাতিকভাবে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশনের দশক হিসেবে ঘোষণা করায় স্যানিটেশন কর্মসূচি জোরদার হয়।
১৯৯১ সালে নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশনের পরিস্থিতি যাচাই করতে প্রথম দেশব্যাপী চালানো সমীক্ষায় দেখা যায়, গ্রামাঞ্চলে ৩৩ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ৪২ শতাংশ পরিবার ল্যাট্রিন ব্যবহার করছে। এরপরও নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ তখনো খোলা মাঠে পায়খানা করছে।
২০০০ সালে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার মসমইল গ্রামে স্যানিটেশনে ভর্তুকির পূর্বশর্ত নির্ধারণ করতে গিয়ে হঠাৎ করেই গ্রাম সমাজ পরিচালিত সবার জন্য স্যানিটেশন নিশ্চিত করার একটি সামাজিক প্রক্রিয়ার উদ্ভাবন হয়, যাকে বলা হয় সিএলটিএস (কমিউনিটি লেড টোটাল স্যানিটেশন)। মসমইল গ্রামের প্রায় অর্ধেক মানুষ তখন খোলা মাঠে পায়খানা করত। গ্রামের সবাইকে—মুরব্বি থেকে শুরু করে তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী, এমনকি শিশুদেরও সমবেত করে একটি অঙ্ক কষতে দেওয়া হয়। ১ হাজার জনসংখ্যার একটি গ্রামে যদি প্রতিদিন অর্ধেক, অর্থাৎ ৫০০ জন খোলা মাঠে আধা কেজি করে পায়খানা করে, তাহলে প্রতিদিন কী পরিমাণ মনুষ্য বিষ্ঠা উৎপন্ন হয়; প্রতি সপ্তাহে তার পরিমাণ কত, প্রতি মাসে তার পরিমাণ কত। তা নিয়ে যেতে কতগুলো ট্রাক লাগতে পারে। স্কুলপড়ুয়া তরুণ-তরুণীরা লজ্জা–সংকোচে বিব্রত অবস্থায় এই অঙ্ক কষল।
কিন্তু এই পরিমাণ ট্রাক কখনোই গ্রামে আসে না মানুষের বিষ্ঠা বয়ে নিয়ে যেতে। তাহলে তা কোথায় যায়? বাঁশঝাড়, ঝোপঝাড়, আমবাগান, খেতখামারে রোদে শুকিয়ে বাতাসের সঙ্গে তা মিশে যাচ্ছে, যা মানুষ নিশ্বাসের সঙ্গে নিচ্ছে। কুকুর–বিড়াল–মুরগির পায়ে পায়ে তা চলে আসছে আমাদের বাড়িঘরে, উঠোনে। বৃষ্টির ধারার সঙ্গে তা যাচ্ছে গ্রামের একমাত্র পুকুরে, যেখানে গ্রামের গৃহবধূরা ধুচ্ছেন থালাবাসন; মসজিদের মৌলভি সাহেব নামাজের আগে সেই পুকুরের পানিতে করছেন অজু, ধুয়ে নিচ্ছেন তাঁর পোশাক। গ্রামের সবাই যখন এই বিষয়গুলো চাক্ষুষ করে বুঝতে পারলেন, তখন বিবমিষায় কেউ কেউ বমি করে ফেললেন। এই বিবমিষা আনার জন্য সচেতনভাবে ‘গু’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল।
সবাই তখন নিজ নিজ ঘরে ল্যাট্রিন বানানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। এনজিও প্রতিনিধিদের কাছে দাবি করলেন, ল্যাট্রিন দিয়ে যান। প্রত্যুত্তরে আবারও প্রশ্ন। এই ঘর বানিয়েছে কে; এই গোয়ালঘর বানিয়েছে কে; এই রান্নাঘর বানিয়েছে কে; আজ দুপুরে এই রান্নাঘরে যা রান্না হচ্ছে, সেই বাজার করেছে কে; বাজারের টাকা দিয়েছে কে; দুপুরের খাবার খাবে কে; সব কটি প্রশ্নেরই উত্তর ছিল—‘আমি’। আবারও প্রশ্ন করা হলো আপনি ঘর, গোয়ালঘর, রান্নাঘর—সব বানিয়েছেন, নিজের টাকায় বাজার করেছেন, খাবেনও আপনি। আর খেয়েদেয়ে যে পায়খানাটুকু করবেন, তার জন্য অর্থসাহায্য দেবে কোনো এনজিও কিংবা সরকার? মুহূর্তেই গ্রামের সবাই অনুধাবন করলেন, তাঁদেরই সামর্থ্য আছে নিজের ল্যাট্রিন নিজে বানানোর। এই অনুধাবনের পরিপ্রেক্ষিতেই কয়েক মাসের মধ্যে মসমইল গ্রামের ঘরে ঘরে ল্যাট্রিন হলো এবং তার পরপরই সবাই মিলে গ্রামের সামনে একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিলেন—‘এই গ্রামের কেউ খোলা মাঠে পায়খানা করে না।’ সিএলটিএস নামক এই প্রক্রিয়া বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ৬০টি দেশে অনুসরণ করা হয়।
গ্রামে–গঞ্জে মানুষ নিজ খরচেই ঘর, দরজা, গোয়ালঘর, রান্নাঘর—সবকিছু করেন। ল্যাট্রিনের ব্যাপারে মানুষ খানিকটা অসচেতন, তাই তাঁরা করেন না। সরকার, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে মানুষজনকে সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া হলো। এতে নিজ খরচেই লোকজন টয়লেট বানাবে। সিদ্ধান্ত হলো, তারপরও ১৫-২০ শতাংশ মানুষ থাকবেন, যাঁদের ল্যাট্রিন বানানোর সামর্থ্য নেই। তাঁদের জন্য এগিয়ে আসবে সরকার, এনজিও এবং নানা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান।
স্থানীয় সরকার বিভাগের নেতৃত্বে সবার জন্য স্যানিটেশনের একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা হলো। ঠিক একই সময়ে যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড ও ডেনমার্ক সরকার ইউনিসেফ, ব্র্যাকসহ কয়েকটি বড় বড় এনজিওকে সমাজের নেতৃত্বে গ্রামের সবার জন্য স্যানিটেশন নিশ্চিত করার জন্য কয়েকটি বড় বড় প্রকল্পের অর্থায়ন করে। এর মাধ্যমে দেশের প্রায় অর্ধেক উপজেলায় এই এনজিওগুলো স্যানিটেশন প্রসারে কাজ করতে পেরেছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাকে তাদের বার্ষিক অনুদান থেকে ২০ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্যানিটেশনের জন্য বরাদ্দ করার নির্দেশ দিয়েছে। সরকারের এই নীতির কারণেই উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশ দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের মধ্যে স্যানিটেশনের হার অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি ছিল। স্যানিটেশন কর্মসূচিকে সব সরকারই ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টে (এসডিজি) স্যানিটেশনকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে নিরাপদ স্যানিটেশন হিসেবে। অর্থাৎ ল্যাট্রিনের মল–বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যথাযথ হলেই কেবল নিরাপদ স্যানিটেশনের হিসাবে ধরা হবে। এসডিজির বেসলাইন অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন অনেক পিছিয়ে গেছে; নিরাপদ স্যানিটেশনের হার গ্রামাঞ্চলে এখন মাত্র ৩২ শতাংশ। এসডিজি অর্জনে বাকি আছে আর মাত্র ১২ বছর। বর্তমান অগ্রগতির ধারা দিয়ে তা অর্জন দুঃসাধ্য। স্যানিটেশনে এসডিজি অর্জনের জন্য আবারও একটি সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন; আর এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে হবে স্থানীয় সরকার বিভাগকেই।
মো. খায়রুল ইসলাম ওয়াটারএইড–এর কান্ট্রি ডিরেক্টর