চার বছরের সূর্য ঘরে ঢুকেই ম্যাক্সি ধরে টানাটানি শুরু করল। ‘চলো, খেলবে’। বিছানা থেকে উঠে প্রায় ৭০ বছর বয়সী রীতা গাইন সূর্যের পিছু নিলেন। তাঁদের এখন খেলার সময়। দুজনেই বসে গেলেন খেলতে।
এটি কোনো বাড়ির দাদি-নাতনির খেলার দৃশ্য নয়। রাজধানীতে অভিভাবকহীন প্রবীণদের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রের দৃশ্য এটি। মাত্র ১৮ মাস আগে আশ্রয়কেন্দ্রে আসা রীতা গাইন এখন আর ভাবতে পারেন না, সূর্য তাঁর নাতি নয়। রীতাসহ কেন্দ্রের ৩৫ জন প্রবীণ নারী ও পুরুষ সূর্যকে নাতি আর তার বাবা মিলটন সমাদ্দারকে ছেলে ও মা মিঠু হালদারকে ছেলের বউ বলেই মনে করেন। এই তো সেদিন মিঠুর একটি অস্ত্রোপচার হলো। বউয়ের সুস্থতা কামনা করে কেউ রোজা রাখেন, কেউ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী প্রার্থনা করেন।
এই প্রবীণদের একসময় নিজের সংসার ছিল। এখনো অনেকের ছেলেমেয়ে, নাতি–নাতনি আছে। কিন্তু সেই সংসারে তাঁদের ঠাঁই হয়নি। কেউ পড়েছিলেন রাজধানীর কোনো পথের ধারে, কাউকে আবার ছেলেমেয়েরাই এখানে দিয়ে গিয়েছেন। কেউ কেউ নিজেই যোগাযোগ করে চলে এসেছেন। এখানে আসার পর ছেলেমেয়ের আর সময় হয়নি খোঁজ নেওয়ার। প্রবীণদের কারও মৃত্যু হলে তাঁর ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সৎকারের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে মিলটন সমাদ্দারকেই। রাজধানীর কল্যাণপুর পাইকপাড়ায় (বাড়ি: ৪৬২, সড়ক: ০৮ দক্ষিণ পাইপাড়া) ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’–এ আশ্রয় পেয়েছেন এই প্রবীণেরা।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নেওয়া অলাভজনক এবং একক ব্যক্তি উদ্যোগে গঠিত এ কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী ও তত্ত্বাবধানকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মিলটন সমাদ্দার। প্রতিষ্ঠানটি তত্ত্বাবধানে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন তাঁর স্ত্রী মিঠু হালদার। প্রায় চার বছর ধরে এই কুড়িয়ে পাওয়া মা–বাবাদের নিয়েই তাঁর এক বৃহৎ পরিবার। খাওয়াদাওয়া সব একই সঙ্গে।
গতকাল শনিবার দুপুরে প্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে দেখা যায়, দুপুরের খাবার খেয়ে কেউ ঘুমাচ্ছেন। কেউ অলস দুপুরে বসে পত্রিকা পড়ছেন বা টেলিভিশন দেখছেন। কেউ কেউ পাশাপাশি বসে গল্প করছেন। সূর্যকে নিয়ে খেলা শুরু করা রীতা গাইন জীবনের গল্প বলতে গিয়েই কান্না শুরু করেন। তবে যতটুকু জানা গেছে, তাঁর একমাত্র সন্তান ভালো মাইনের চাকরি করেন। রাতে তাঁর বিছানায় প্রস্রাব হতো। তাই তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। পথে পড়ে ছিলেন। দুই যুবক তাঁকে এখানে রেখে গিয়েছিলেন। প্রবীণদের সবার জীবনেই আছে একটি করে গল্প,তাঁরা তা বলতে চান না। তাঁরা প্রায় সবাই বললেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরা মরে গেছে। এখন মিলটনই তাঁদের একমাত্র ছেলে। এটাই তাঁদের পরিবার। মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁরা এখানেই থাকতে চান।
বরিশালের মিলটন সমাদ্দার নার্সিং পাস করেছেন। তবে চাকরি করা হয়নি। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে অসুস্থ প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য তাঁর একটি দল কাজ করছে রাজধানীতে। এ কাজ করতে গিয়েই একজন প্রবীণ সদস্যকে নিয়ে অসহায় প্রবীণদের আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলার তাগিদ অনুভব করেছিলেন তিনি। শুরু হয়েছে ২০১৪ সালে। ওই বছর ডিসেম্বর মাসে তিনি একজন পায়ে গ্যাংগ্রিনে আক্রান্ত বৃদ্ধকে আগারগাঁয়ের সড়ক থেকে তুলে এনেছিলেন নিজের বাসায়। চিকিৎসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু ১৪ দিনের মাথায় তিনি মারা যান।
সর্বশেষ এসেছেন রাবেয়া বশরী। গত ৩০ অক্টোবর ৯০ বছরের রাবেয়া বশরীকে তাঁর স্বজনেরা পথে ফেলে রেখে যায়। তাঁকে এখানে নিয়ে আসেন প্রবীণ বন্ধু ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং আগারগাঁও প্রবীণ হিতৈষী কেন্দ্রের চিকিৎসক মহসীন কবি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আগারগাঁও প্রবীণ হিতৈষী কেন্দ্রে যে প্রবীণেরা চলাফেরা করতে পারেন না, তাঁদের ভর্তি রাখা হয় না। বৃদ্ধাকে নিয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় গেলে সেখান থেকে কোনো সমাধান দিতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত এই কেন্দ্রে এসে হাফ ছেড়ে বাঁচি।’
এখন পাইকপাড়ায় অল্প দূরত্বে দুটি বাড়িতে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের মোট ১৬টি ঘরে থাকছেন ৩৫ জন প্রবীণ ব্যক্তি। এখানে মোট ৫৫ জনের আবাসনের ব্যবস্থা আছে। গত প্রায় চার বছরে ৮০ জন অসহায় প্রবীণ এখানে সেবা পেয়েছেন। বার্ধক্যজনিত কারণে ১৮ জন মারা গেছেন। কয়েজনকে পরিবার ফিরিয়েও নিয়েছে। যে প্রবীণেরা এখানেই মারা গেছেন, তাঁদের কয়েকজনের ছবি দেয়ালে টাঙানো আছে।
এখানে প্রবীণদের চিকিৎসার জন্য আছে প্রয়োজনীয় ওষুধের ছোট ডিসপেনসারি, যন্ত্রপাতি আর অক্সিজেন সিলিন্ডার। মিলটন জানালেন, একজন চিকিৎসকে নিয়োগ করা হয়েছে। সপ্তাহে দুই দিন তিনি চিকিৎসা দিতে আসেন। রান্না ও পরিচর্যার জন্য সার্বক্ষণিক কর্মী আছেন ৯ জন। সবার বেতন, বাড়িভাড়া, ওষুধ, খাবার ইত্যাদি মিলিয়ে মাসে প্রায় চার লাখ টাকার কাছাকাছি খরচ হচ্ছে।
গতকাল মিলটন প্রবীণ নিবাসটিতে ঢুকেই মা–বাবা বলে ডাক দেন। আর ছোট শিশুর মতোই সবার চোখ খুশিতে ঝিকমিক করতে থাকে। হাসতে হাসতে একজনকে দেখিয়ে মিলটন বললেন,‘মায়ের চুল বড় আর উঁকুন ছিল। তাই একদম ছোট করে কেটে দিয়েছি। তারপর থেকেই তাঁর সে কী রাগ।’ রাগ করে থাকলেও সেলফি তোলার কথা বলতেই শোয়া থেকে উঠে বসে এই নারী মিলটনের সঙ্গে হাসিমুখে ছবি তুললেন। মিলটনের স্ত্রী মিঠু হালদারও পেশায় নার্স। তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালের চাকুরে। কাজ শেষে প্রতিদিনই প্রবীণদের কাছে আসেন। কোনো দিন না এলে তাঁরা রীতিমতো মান–অভিমান করেন। জানা গেল পরিবার থেকে পরিত্যক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সাংবাদিকও (আর্থিকভাবে কিছুটা সচ্ছল) এখানে থাকছেন। তাঁরা চান না তাঁদের পরিচয় বা ছবি গণমাধ্যমে ছাপা হোক।
মিলটন বললেন,‘এই মা–বাবা আমাদের কাছে খুব ভালো আছে, তা বলার উপায় নেই। আমাদের ব্যক্তিগত সামর্থ্যের সঙ্গে বিভিন্নজনের সহায়তায় চলছে প্রতিষ্ঠানটি। কোনো সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য সহযোগিতা পাই না। এই মা–বাবাদের মাঝেমধ্যে ডাল-ভাত খাওয়াতেই কষ্ট হয়ে যাই। তবে ডাল–ভাত খাওয়ার পরও তাঁদের মুখে যখন হাসি দেখি, তখন সব কষ্ট ভুলে যাই। অন্যরা ফেলে দিলেও আমরা তাঁদের ফেলে দিতে পারছি না। আমার স্ত্রী, সন্তান ও মা–বাবাও (জন্মদাতা) আমাকে উৎসাহ দেন। তাই সবাইকে নিয়ে আমার পরিবারটি এখন বেশ বড়।’