বিশ্বমানের এক শিল্প খাত

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশের তািলকায় বাংলাদেশের স্থান এখন ৩ নম্বরে
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশের তািলকায় বাংলাদেশের স্থান এখন ৩ নম্বরে

আমাদের দেশের পোশাক খাত বিগত দশকগুলোতে তার ইমেজের চারটি পর্যায় পার হয়েছে। প্রথমত, জনবহুল দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিল্পপণ্য উত্পাদন ও রপ্তানির মাধ্যমে দেশের প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনে দৃষ্টান্ত স্থাপন। দ্বিতীয়ত একটি সাধারণ মানের শিল্প খাতের বিশ্বমানের অসাধারণ শিল্প খাতে উত্তরণ ঘটানো। তৃতীয়ত, এ খাতের অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রমস্বার্থের অগ্রগতি অর্জনে হোঁচট খাওয়া এবং উত্তরণের চেষ্টা এবং চতুর্থত, পোশাক খাতের আন্তর্জাতিক উত্পাদন চেইনে সুশাসন দৃঢ়তর করার প্রচেষ্টায় নজির স্থাপন।

প্রথম ইমেজ: আশির দশকের শুরুতে আমদানি করা কাটা কাপড়ের পিস সেলাই করে কতই-বা রপ্তানি হতো। ১৯৮২ সালে যেখানে ছিল মাত্র ৪২টি কারখানা, ১৯৮৫ সালে তা ৩৮৪টিতে দাঁড়ায়।১ লাখ ২০ হাজার শ্রমিকের এই শিল্পে মোট রপ্তানি ছিল ১১ কোটি ৬২ লাখ ডলার বা ৩০১ কোটি টাকা। অনভিজ্ঞ উদ্যোক্তা, তাঁদের স্বল্প পুঁজি, অদক্ষ শ্রমিক এবং ক্রেতাদের সঙ্গে স্বল্প পরিচিতি—কোনো কিছুই বাংলাদেশে এ খাত গড়ে ওঠার পক্ষে ছিল না। উদ্যোক্তাদের নিজেদের প্রচেষ্টা ও দক্ষতা, শ্রমিকদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম, স্বল্প মজুরি, পুরোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার আর বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে কম মূল্যে কাজের অর্ডার নিয়ে সময়, চাহিদা ও মান বজায় রেখে অর্ডার সাপ্লাই দিয়ে ধীরে ধীরে উদ্যোক্তারা গ্রহণযোগ্যতা ও পরিপক্বতা প্রমাণ দিয়েছেন। ২০০০ সালে কারখানা ও শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩ হাজার ২০০টি এবং ১৬ লাখ, যা ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৪ হাজার ৫৬০টি এবং ৪০ লাখ। রপ্তানির পরিমাণ ২০০০ সালে ছিল ৪৩৫ কোটি ডলার, যা ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৬১ কোটি ৪৮ লাখ ডলারে। মোট রপ্তানিতে অবদান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩ দশমিক ৫ শতাংশে। এ খাতের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।

দ্বিতীয় ইমেজ: পোশাক খাতের দ্বিতীয় ইমেজ সাফল্য হলো আশির দশকের একটি সাব–কন্ট্রাকিং বায়িং হাউসনির্ভর শিল্প খাতকে ব্র্যান্ড/রিটেইলার–নির্ভর শিল্প খাতে উত্তরণ ঘটানো। কোটাসুবিধার কারণে আশির দশকে বাংলাদেশে ছোট ছোট অর্ডার আসত স্থানীয় বা এশীয় অন্যান্য দেশের বায়িং হাউসের মাধ্যমে। রপ্তানিকারক হিসেবে এ দেশের তেমন পরিচিতি ছিল না। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের পরিচিতি বাড়ে। ২০০১ সালে বাংলাদেশ উঠে আসে মূল রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় ৭ম অবস্থানে, যা ২০১৮ সালে এসে দাঁড়ায় তৃতীয় অবস্থানে।

বর্তমানে দেশে ৪০টি নিট ও ওভেন পণ্য রযেছে, যার প্রতিটির রপ্তানিমূল্য ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি (৮০০ কোটি টাকার বেশি)। এরপর আরও ৭০টি পণ্য রয়েছে, যাদের প্রতিটির রপ্তানিমূল্য ১ মিলিয়ন ডলারের বেশি (৮ কোটি টাকার বেশি)। পণ্য তালিকায় ধীরে ধীরে স্বল্প মূল্যের পণ্য থেকে মধ্য ও উচ্চ মূল্যের পণ্য যুক্ত হচ্ছে।

তৃতীয় ইমেজ: পোশাক খাতের তৃতীয় ইমেজটি সব সময় ছিল চ্যালেঞ্জিং ও সংকটপূর্ণ। বিগত দশকে এ খাতে যত ব্যবসায়িক অগ্রগতি হয়েছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামাজিক বিষয়াদির অগ্রগতি হয়নি। বিশেষত, শ্রমিকদের কর্মসংস্থান, মজুরি, কর্মপরিবেশ এবং সংগঠিত হওয়ার অধিকার—এ চার বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে অনেক কাটখড় পুড়িয়ে—আন্দোলন, সংগ্রাম আর শ্রমিকের মৃত্যুর বিনিময়ে। বিগত এক দশকে তিনবার মজুরি সমন্বয় হওয়ার মাধ্যমে (২০১০, ২০১৩ ও ২০১৮) মজুরির পার্থক্য কমানোর চেষ্টা হয়েছে। অন্যদিকে কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নের বড় উদ্যোগ নেওয়ার দাবি বিগত দশকগুলোতে তোলা হলেও তা নেওয়া হলো রানা প্লাজা এবং তাজরীন ফ্যাশনস গার্মেন্টসের দুর্ঘটনার পর। ব্র্যান্ড/বায়ারদের পাশাপাশি স্থানীয় উদ্যোগে প্রায় ৩ হাজার ৮০০ কারখানার কর্মপরিবেশের অগ্নি, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা চিহ্নিত করে তা সংস্কারের উদ্যোগ বেশ ভালোভাবেই এগিয়েছে। যদিও এখনো ছোট ছোট বেশ কিছু কারখানা এ উদ্যোগের বাইরে রয়ে গেছে, যেখানে সংস্কার আনা জরুরি।

চতুর্থ ইমেজ: বাংলাদেশের চতুর্থ ইমেজ হলো পোশাক খাতের আন্তর্জাতিক উত্পাদন চেইনে সুশাসন দৃঢ়তর করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। রানা প্লাজা দুর্ঘটনা সে পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত কারখানায় উত্পাদন পর্যায়ের কমপ্লায়েন্স–সংক্রান্ত দায়দায়িত্ব পুরোপুরি উত্পাদকের দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হতো। দুর্বল কমপ্লায়েন্স উপেক্ষা বা পাশ কাটিয়ে লেনদেন অব্যাহত থেকেছে উত্পাদক এবং বায়ারদের মধ্যে। ক্রেতার চাপে ও শ্রমিকদের দাবির মুখে ধীরে ধীরে কমপ্লায়েন্সের চাপ বেড়েছে।

পাশাপাশি ক্রেতাদের কাছে কম মূল্যে পণ্য বিক্রির প্রতিযোগিতা শুরু করে বায়াররা এবং এ জন্য কম মূল্যে পণ্য সরবরাহ করতে চাপ দিতে থাকে উত্পাদকদের। ফলে বাংলাদেশে ২০০৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পণ্যমূল্য কমেছে ৪০ শতাংশ। কিন্তু উদ্যোক্তা বা ব্র্যান্ড বায়ারদের মুনাফা বা উত্পাদন বা বিক্রি কমেনি, বরং বেড়েছে। অথচ দুর্বল কমপ্লায়েন্সের কারণে শ্রমিকের নিরাপত্তাঝুঁকি বেড়েছে। স্বল্প মজুরির জন্য শ্রমিকের জীবিকার উন্নতি হয়নি। বাংলাদেশ প্রতিটি ধাপে সাফল্যের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এসেছে। এটা সম্ভব হয়েছে উদ্যোক্তা, শ্রমিক, ক্রেতা, সরকার, পণ্য ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান, দেশ এবং সাহায্যদাতা সরকার ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে তার এ ইমেজকে বৈশ্বিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে চায়।

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক