বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র

২০০২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ও পুরস্কৃত হয়েছে মাটির ময়না
২০০২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ও পুরস্কৃত হয়েছে মাটির ময়না

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের দুর্দিনের কথা শোনা যাচ্ছে বহুদিন থেকেই। এই শতকের শুরুতে এই মন্দা পরিণত হয় মহামন্দায়, যদিও গত প্রায় এক দশকে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু প্রেক্ষাগৃহ একের পর এক বন্ধ হয়েই চলেছে। খুব সম্প্রতি বন্ধ হয়ে গেল রাজশাহীর একমাত্র প্রেক্ষাগৃহটিও।তবে বিনোদনধর্মী বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের কারখানার বাইরে এবং স্বাধীন নির্মাতাদের হাত ধরে একটি সমান্তরাল যাত্রা চলছে। এখানে চিত্রটি প্রায় উল্টো। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের চিত্রটি যেমন হতাশার, এই চিত্র অনেকখানি আশাব্যঞ্জক। এ ক্ষেত্রে তরুণ স্বাধীন নির্মাতারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন এজেন্সির কাছে নিজের চিত্রনাট্য বা প্রকল্প নিয়ে আবেদন করছেন, প্রতিযোগিতা করে তহবিল সংগ্রহ করছেন, নামী বা আধা নামী বিভিন্ন উৎসবে এগুলো প্রদর্শিত হচ্ছে, বিদেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে এগুলো প্রচারিত হচ্ছে, এমনকি বিদেশের প্রেক্ষাগৃহে বাণিজ্যিকভাবে চলচ্চিত্রগুলো মুক্তিও পাচ্ছে। ধীরে হলেও এভাবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বৈশ্বিক মঞ্চে কিছুটা স্থান করে নিচ্ছে। চলচ্চিত্রগুলো হয়ে উঠছে বিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিস্বরূপ।

বাংলাদেশে স্বাধীন চলচ্চিত্রের এই ধারাটির সূচনা ঘটেছিল আশির দশকের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সেই সময়ে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ভারতের দশম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে স্বল্পদৈর্ঘ্য বিভাগে মোরশেদুল ইসলাম তাঁর আগামী ছবির জন্য সেরা পরিচালক হিসেবে পুরস্কৃত হন।‘আগামী’ চলচ্চিত্রের এই পুরস্কার স্বাধীন চলচ্চিত্রের ধারাকে গতি জুগিয়েছিল। ২০০২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে তারেক মাসুদের মাটির ময়নার প্রদর্শন ও ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট বিভাগে চলচ্চিত্রটির সমালোচক পুরস্কার প্রাপ্তি তারই ধারাবাহিকতার ফল।ছবিটি তৈরির জন্য তারেক মাসুদ ফ্রান্সের সাউথ ফান্ড পুরস্কার পান এবং এর আওতায় ফরাসি প্রযুক্তির সহায়তায় উন্নত একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। কান চলচ্চিত্র উৎসবে এমকে-টুর মতো বিখ্যাত বিপণন কোম্পানির উদ্যোগে ইউরোপ ও আমেরিকার প্রেক্ষাগৃহে বাণিজ্যিকভাবে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় এবং দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে। মাটির ময়নার আগে মোরশেদুল ইসলামের চাকা (১৯৯৩) এবং আবু সাইয়ীদের শঙ্খনাদ (২০০৪) সীমিতভাবে ইউরোপে মুক্তি পেয়েছিল। তবে মাটির ময়না একটি প্রভাবশালী চলচ্চিত্রে পরিণত হয় এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে যাওয়ার ধারণাকে অবমুক্ত করে ও তাদের পথ দেখিয়ে দেয়।

এভাবে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর টেলিভিশন (২০১৩) জার্মান প্রযোজক পায় এবং ৭ম এশিয়া-প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ড জুরি গ্র্যান্ড প্রাইজ পায়। তাঁর ডুব (২০১৭) দুবাই ফিল্ম মার্কেট অ্যাওয়ার্ড পায় এবং বাংলাদেশ, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ায় মুক্তি পায়। রুবাইয়াত হোসেনের আন্ডার কনস্ট্রাকশন (২০১৫) ফ্রান্সে রিলিজ হয়। কামার আহমাদ সাইমনের শুনতে কি পাও (২০১২) মুম্বাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে স্বর্ণশঙ্খ, ফ্রান্সের সিনে দু রিল উৎসবে গ্রাঁ প্রি পায় এবং বহু আন্তর্জাতিক উৎসব সফর করে। আবু শাহেদ ইমনের জালালের গল্প (২০১৪) পর্তুগালের আভাঙ্কা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ লাইভ ফ্রম ঢাকা (২০১৬) সিনেমার জন্য সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালকের পুরস্কার পান। ফ্রান্সের বিপণন প্রতিষ্ঠান স্ট্রে ডগস চলচ্চিত্রটির বিপণনের দায়িত্ব নিয়েছে।

বিশ্ব-চলচ্চিত্রের আঙিনায় প্রবেশের জন্য বিরাট সুযোগ হিসেবে হাজির হয়েছে সুইজারল্যান্ডের লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবের ‘ওপেন ডোরস’ কর্মসূচি। যেসব দেশে বাণিজ্যিক ধারার বাইরে স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করে, তাদের জন্য এই কর্মসূচি। তিন বছরের (২০১৬-১৮) এই কর্মসূচির মধ্যে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ভবিষ্য-চলচ্চিত্র নির্মাণ-তহবিল পেয়েছে, প্রকল্পগুলো প্রয়োজনীয় পরিচর্যা পেয়েছে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উৎসবে প্রদর্শিত হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছে এবং সম্ভাব্য বিপণনকারী খুঁজে পাচ্ছে। এসব চলচ্চিত্র যখন নির্মিত হয়ে যাবে, তখন বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের অনেকগুলো চলচ্চিত্র পরপর আত্মপ্রকাশ করবে এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র একটি অবয়ব নিয়ে বিশ্ব-আঙিনায় আবির্ভূত হবে। মূলত মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, কামার আহমাদ সাইমন, রুবাইয়াত হোসেন প্রমুখের সামনের সব কটি প্রকল্পই বিদেশি তহবিল সংগ্রহ করে নির্মিত হচ্ছে, যা নামী উৎসবে অংশগ্রহণ এবং বিশ্ববাজারে বাণিজ্যিক মুক্তিকে নিশ্চিত করে। এসব প্রকল্পের বেশির ভাগই আবার বাংলাদেশ সরকারের অনুদান পাচ্ছে, যার মাধ্যমে স্বাধীন নির্মাতাদের আর্থিক সংস্থান সংহত হচ্ছে। এদিকে নানা উপায়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকারেরা কান চলচ্চিত্র উৎসবেও যোগ দিচ্ছেন।

অস্কারের মতো আয়োজনগুলোতেও পুরস্কার ও মনোনয়নপ্রাপ্তদের তালিকায় বাংলাদেশিদের নাম আসছে। বাংলাদেশি তরুণ প্রকৌশলী নাফিস বিন জাফর ২০০৭ সালে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ক্যাটাগরিতে এবং ২০১৫ সালে ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট ক্যাটাগরিতে একাডেমি অ্যাওয়ার্ড জেতেন। বাংলাদেশের আরও এক তরুণ ওয়াহিদ ইবনে রেজাও অস্কার দৌড়ে ছিলেন।

বিদেশের দর্শক ও চিত্রসমালোচকেরা সাধারণত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নিজস্ব একটি অবয়ব খুঁজে পান না। প্রায়ই তাঁরা ভারতীয় চলচ্চিত্র বা ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে মিলিয়ে ফেলেন। কিন্তু মাটির ময়না, টেলিভিশন, শুনতে কি পাও বাংলাদেশের গ্রাম ও আন্ডার কনস্ট্রাকশন, লাইভ ফ্রম ঢাকা ঢাকা শহরকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেছে এবং এভাবে বাংলাদেশের অনন্য সমাজ-সংস্কৃতিনির্ভর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একটা নিজস্ব পরিচয় ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে।

ফাহমিদুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগােযাগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও চলচ্চিত্র পর্যালোচক