মারিব মৎস্য, খাইব সুখে...
হাওরাঞ্চলের আকাশে এখন যখন তখন মেঘ, কিংবা ঝমঝম করে ঝরছে বৃষ্টি। আর প্রকৃতির যখন এমন পরিবেশ তখন খাল-বিল-হাওর-জলাশয়ের ভাসান পানিতে মাছেরা উজাতে শুরু করে। কত শত মাছ। গইন্যা, বোয়াল, শোল, গজার, পুঁটি, বাইল্যাকড়া, টেংরা, রানি—আরও কত-কী! সেসব মাছ ধরতে কুচ, হাত্তর, উছ্, তোরকুচ, জাল হাতে নেমে পড়ে বাড়ির বয়স্ক ব্যক্তি থেকে শুরু করে শিশু-কিশোরেরা। এই জ্যৈষ্ঠে এটাই হলো সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নেত্রকোনা জেলার হাওর-অধ্যুষিত এলাকার চিরায়ত দৃশ্য।
কেমনে শিকারি তির মারিল?
মাছশিকারিদের তো আর কায়দার শেষ নেই। জ্ঞান এবং বুদ্ধি খাটিয়ে বানানো নানা ধরনের লোকপ্রযুক্তির সাহায্যে হাওরের মানুষ কেউবা পেশাগতভাবে আবার কেউবা নিছক শখের বশে বংশপরম্পরায় মাছ শিকার করে আসছেন। চাঁই, উছ্, উইন্যা, কুচ, হাত্তর, পলো, তুরকুচ, পেলোইন, বেড় জাল, ছিপ, বড়শি, কাকরাইন, ঢুলা, হাতজাল, বাইর, ঝোপরা—এ রকম নানা জিনিস ব্যবহার করা হয় মাছ শিকারে।
হাওরে জন্ম নেওয়া কবি আল মাহমুদ তো তাঁর আত্মজৈবনিক উপন্যাস যেভাবে বেড়ে উঠিতে (২০১২, প্রথমা সংস্করণ) ‘কুচ বা চল দিয়ে ধাবমান মাছ গেঁথে’ ফেলার গল্প শুনিয়েছেন। বর্ষায় বোয়ালমাছ শিকারের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন এভাবে, ‘সাধারণত ঝোপ-জঙ্গলাপূর্ণ নালাতেই বোয়ালশিকারিরা রাতে তাদের বড়া বসিয়ে যায়। উগোল মাছের বড় টোপ গেঁথে পানি থেকে এক-দেড় হাত ওপর ঝুলিয়ে রাখে। ক্ষুধার্ত মাছটা যখন এই টোপ দেখতে পায়, তখন রাক্ষসের মতো ঝাঁপ দিয়ে টোপটা আস্ত গিলে ফেলে। আর অমনি বড়শিতে বিঁধে ঝুলে থাকে শূন্যে, বেশি নড়াচড়া করতে পারে না। কারণ, পানি থেকে মাথাটা অনেক ওপরে বড়শিতে বিঁধে থাকে।’
এ তো গেল কবির বয়ান। এর বাইরেও তো রয়েছে শিকারের নানা পদ্ধতি। ‘দড়াটানা’-এর মধ্যে অন্যতম। নদী কিংবা খালে কোমর বা বুকসমান পানিতে লোহার শিকল দুদিক থেকে দুজনে টেনে সামনের দিকে এগোতে থাকে। অপরদিকে একটি নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে কয়েকজন বিশাল এক জাল ধরে রাখে। লোহার শিকলের আঘাত পেয়ে মাছেরা দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে জালের মধ্যে আটকা পড়ে।
বর্ষায় বাঁশ ও শক্ত সুতা দিয়ে তৈরি ‘বাইর’, বাঁশের ফলি দিয়ে ফাঁকবিশেষ পাটির মতো তৈরি ত্রিভুজাকৃতির ‘উছ্’, চিকন ও মিহি বাঁশের তৈরি ‘চাঁই’, বাঁশ ও লোহা দিয়ে তৈরি ‘হাত্তর’সহ নানা ধরনের জাল মাছ শিকারের অন্যতম উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গভীর রাতেও কেউ কেউ শিকারে বেরোন। হাওরের ভাসান পানিতে ডিঙি নৌকা ভাসিয়ে লন্ঠন, হ্যাজাক কিংবা টর্চলাইটের আলো ফেলে দক্ষ শিকারিরা কুচের ঘায়ে বিদ্ধ করেন বোয়াল, আইড় কিংবা অন্য কোনো মাছ। তবে পানি যখন কম থাকে, অর্থাৎ ফাল্গুন-চৈত্র মাসে পলো দিয়ে মাছ শিকারের মহোৎসব হাওরে নতুন আমেজ পায়।
সরেজমিনে এক বেলা
নয়া পানিতে থইথই করছে হাওরাঞ্চল। সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের প্রয়াত লোকগীতিকার কামাল উদ্দিন (১৯০০-১৯৮৫) বর্ষার এমন পরিবেশ বোঝাতে এক গানে লিখেছেন, ‘দেশে আইল নুতন পানি, ঘুচে গেল পেরেশানি/ মাছের বাড়ল আমদানি, দুঃখ নাই রে আর’। ঠিকই, বর্ষা এলেই তো মাছের আমদানি বেড়ে যায়। আর এ কারণেই এমন মৌসুমে হাওরে-বাঁওড়ে শিকারিদের তৎপরতা থাকে বেশি। কয়েক দিন আগে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কটালপুর গ্রামের পাশের এক হাওরে দেখা গেল কয়েকজন শিকারিকে ‘তোরকুচ’ হাতে মাছ শিকার করতে। কাঠ ও টিনের পাত দিয়ে তৈরি তোরকুচ বড় মাছ শিকারের অন্যতম হাতিয়ার। কটালপুর গ্রামের শিকারি জহির মিয়া তখন মাছ শিকারে ছিলেন। বললেন, ‘বর্ষা মৌসুমে অনেক শৌখিন মানুষ মাছ ধরতে হাওর-খাল-বিলে নামেন। সেই মাছ বাড়িতে নিয়ে সবাই মিলেমিশে খান। আসলে তাজা মাছের স্বাদই আলাদা।’
শাহীন মিয়া নামের আরেক শৌখিন শিকারি জানান, ঘন বর্ষণ হলেই মাছ উজাতে শুরু করে। আধা ঘণ্টার ব্যবধানে তিনি দুটি বোয়ালমাছ শিকার করেছেন বলে জানালেন। সিলেট সদর উপজেলার চেঙ্গেরখাল নদে ‘উজাইমাছ’ শিকারে ব্যস্ত হাটখোলার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব রইস মিয়া জানান, ১০ থেকে ১২ বছর বয়স থেকেই তিনি এই মৌসুমে মাছ শিকার করে আসছেন। তাজা মাছের স্বাদই তাঁকে প্রতি বর্ষায় হাওরে নিয়ে আসে।
কত জাতের মাছ
এই সময়ে ও বর্ষাকােল হাওরে শিকারিরা নানা জাতের মাছ শিকার করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কাতলা, বুতিয়া, আইড়, চান্দা, পুঁটি, গজার, বাউশ, মৃগেল, কুইচ্যা, বোয়াল, লাছ, এলং, ভেদা, চেলা, শিং, মাগুর, বাইম, চিংড়ি, কাতলা, কাইক্যা, চিতল, রুই, কার্ফু, টাকি, গইন্যা, কাইল্লা, টেংরা, রানি, পাবদা, চাপিলা, বাছা, বাইল্যাকড়া।