মুক্তিযোদ্ধা বশির কাকা

বশির কাকার কথা আমার বাবার মুখে শুনেছিলাম। একাত্তরে তাঁর বয়স ছিল ১৪–১৫ বছর। পড়াশোনায় ছিলেন উদাসীন। একদিন শিক্ষকের হাতে বেদম মার খেয়ে লেখাপড়ায় ইতি টানেন। তারপর তাঁর বাবার চায়ের দোকানে বসে যান। যখন তাঁর ১৩ বছর বয়স, তখন বাবাকে হারান। সংসারের ভার এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। 

বশির কাকার নাকি ছিল পত্রিকা পড়ার নেশা। তবে পত্রিকা কেনার সামর্থ্য ছিল না। রোজ হকার এসে এলাকার কয়েকটি বাসার পত্রিকা তাঁর চায়ের দোকানে রেখে যেত। যাদের পত্রিকা, তারা এখান থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করে বাসায় নিয়ে যেতেন। এই সুযোগে বিনা খরচে বশির কাকা পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ে নিতেন। তাঁর পত্রিকা পড়ার অভ্যাসের কথা এলাকার অনেকেই জানতেন। তাই তাঁর চায়ের দোকানে এসে অনেকেই চা খাওয়ার পাশাপাশি দেশের খবরাখবর জানতে চাইতেন। তিনিও খুশি মনে যেটুকু জানতেন, সেটুকু সুন্দর করে বলতেন। এই কারণে এলাকায় তাঁর আলাদা একটা কদর ছিল। 

প্রতিদিন বশির কাকার চায়ের দোকানে অনেকের আনাগোনা। এলাকার যুবকেরা তাঁর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে জমিয়ে আড্ডা দেয়। আড্ডায় চলে দেশের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা। তিনি সবার কথাই কমবেশি শুনতেন। তবে বিশেষ করে দেশের রাজনীতি বিষয়ে আলোচনা হলে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। মাঝেমধ্যে নিজেও আলোচনায় যোগ দিতেন। এলাকার যুবকদের কাছে তিনি ‘বিবিসি নিউজ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক খবরাখবর তিনি এলাকার যুবকদের জানাতেন। সবাই খুব গুরুত্ব দিয়ে তাঁর কথাগুলো শুনত এবং মূল্যায়ন করত। পত্রিকায় প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের পুরো ভাষণটি তিনি মুখস্থ করে ফেলেন। কেউ শুনতে চাইলে অনর্গল বলতে পারতেন। এলাকার স্বাধীনতার সপক্ষের লোকজন দেখলেই বলে উঠতেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি কিশোর বয়সী হয়েও এলাকার স্বাধীনতাকামী যুবকদের বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করেন। নিজেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। 

নিজের পরিবারের ভার তাঁর কাঁধে থাকায় তিনি ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে পারেননি। তবে থেমেও থাকেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে গেছেন। এলাকার যেসব যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। তিনি শত্রুপক্ষের খবরাখবর সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন। বশির কাকার গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর মুক্তিযোদ্ধারা দুটি গুরুত্বপূর্ণ গেরিলা হামলা করেন। এসব কথা গোপন থাকেনি। এলাকার কজন রাজাকার একদিন সন্ধ্যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিয়ে বশির কাকার চায়ের দোকানে আসে। তারা তাঁর দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারপর তাঁকে গাড়িতে তুলে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দিতে সেখানে চলতে থাকে তাঁর ওপর অমানবিক নির্যাতন। তিনি মুখ খোলেননি; বরং সবকিছুই অস্বীকার করে গেছেন। নিজের জীবন বাঁচাতে তিনি তাদের বারবার বোঝাতে চাইলেন, কেউ শত্রুতা করে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে। তাঁর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবু তারা তাঁর কথা বিশ্বাস করেনি। বশির কাকাকে এরপর আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

আমি কল্পনায় বশির কাকার অবয়ব কল্পনা করি। একজন কিশোর, যে কিনা দেশের জন্য জীবন দিল, তার কথা ভাবি। এমন কতশত বশির কাকা জীবনের বিনিময়ে আমাদের জন্য একটা স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন।

সৈয়দ আসাদুজ্জামান
ঢাকা