অধরা ধরা
‘অধরা, যাকে ধরা যায় না। তাই তো?’
প্রশ্নটা ছুড়েই একগাল হাসল ছেলেটা। খেয়াল করলাম, মাথায় ঝাঁকড়া চুলের হ্যাংলা–পাতলা ছেলেটির গালভরা হাসি অসম্ভব সুন্দর।
‘আমি নিলয়’, নিজের নাম বলে হাত বাড়িয়ে দিল।
আমি হাত মেলাতেই বলল, ‘অধরা এবার ধরা।’ তারপর সেই ভুবন ভোলানো হাসি।
বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রথম দিনটায় মুহূর্তেই এমন সহজ–সাবলীল কথায় বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। ক্লাসে পাশাপাশি বসতাম, ক্লাস লেকচার ভাগাভাগি করে টুকে নিতাম, চা-চত্বরে একসঙ্গে আড্ডা দিতাম, যার-তার ওপর ক্রাশ খেয়ে একজন অন্যজনকে পচাতাম। সেই পচানোই একসময় কাল হয়ে দাঁড়াল দুজনের বন্ধুত্বে।
দুজন নীলক্ষেত গিয়েছিলাম
বই কিনতে। ফেরার পথে চার হাতভরা বই। বাসে উঠে দেখি বসার মতো জায়গা নেই। আমাকে দাঁড়িয়ে আসতে হবে ভেবে বেশি মন খারাপ হলো নিলয়ের। নানা কথায় সারা পথে খেপালাম তাকে, ‘বেশি করে
হরলিকস খাবি বাবু, একটা পিচ্চি নিয়ে আসছি আমি সঙ্গে করে...আরও কত–কী!’
বলতে বলতেই হেসে গড়িয়ে পড়লাম। বসে পড়লাম পাশের
সিটের লোকের কোলে। কী লজ্জা! আমি উঠে ‘সরি’ বলতেই, লোকটির স্ত্রী রাগে হিসহিস করে বলে উঠল, ‘সরি! কোলে বসে সরি বলে কী
হবে? সুন্দর ছেলে দেখলে মাথা
ঠিক থাকে না! আজকালকার
মেয়েদের ন্যাকামি দেখলে গা জ্বলে যায়...।’
আমি প্রথমবারের মতো লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কাঁচুমাচু হয়ে বসা লোকটির বয়স প্রায় ৪৫ বছর। মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে, কাঁচা–পাকা দাড়িতে মুখের এক-তৃতীয়াংশ ঢাকা। তাঁর স্ত্রী তখনো আগুনঝরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
এতক্ষণ ধরে এত কিছু হয়ে গেলেও নিলয় একটি কথাও বলল না। আমার হাত ধরে টেনে নামাল বাস থেকে। বাসে আমি কোনো কথাই বলতে পারিনি, কিন্তু নামার পরই সব রাগ উগরে দিলাম নিলয়ের ওপর।
‘তুই একটা কথাও বললি না? এত কিছু হয়ে গেল, মহিলা
আমাকে অপমান করল। তুই কীভাবে পারলি?’
নিলয় আমার সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় যেতে চাইল না। কথা না বাড়িয়ে একটা রিকশা নিল। রিকশায় উঠে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখল, লজ্জায়, অপমানে আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। সেই কান্না চলল বাসায় ফিরেও, গভীর রাত পর্যন্ত। বাসের ঘটনা শুনে রুমমেটরা হেসে গড়াগড়ি খেল। তাদের হাসতে দেখে একসময় আমিও হাসতে শুরু করলাম।
কিন্তু সে হাসি চুপসে গেল পরদিন ক্লাসে গিয়ে। একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল ক্লাসে পৌঁছাতে। স্যার ক্লাস শুরু করে দিয়েছেন। তড়িঘড়ি করে ঢুকে বসে পড়ি। নিলয় কোথায় বসেছে খেয়াল করা হয়নি। স্যার বেরিয়ে যেতেই পুরো ক্লাস হো হো শব্দে কেঁপে উঠল!
আমি কিছুই বুঝলাম না। পাশে বসা সুজানা হাসি চেপে বলল, ‘কিরে তুই নাকি বাসে বসতে না পেয়ে এক টাকওয়ালার কোলে বসে পড়েছিলি? আর তার স্ত্রী...।’ এটুকু বলেই হাসতে শুরু করল।
রাগে আমার গা জ্বলে গেল। কাজটা নিলয় করেছে। আমি আর ভাবতে পারলাম না। পরের ক্লাস না করেই চলে এলাম হলে।
কী মানসিক যন্ত্রণা! সবাই ফালতু বিষয়টা নিয়ে হাসাহাসি করছে। ডিপার্টমেন্টের করিডরে কিংবা ক্যাফেটেরিয়া অথবা টিএসসি যেখানেই যার সঙ্গে দেখা হয়, সবাই হাসে। মনে মনে বলি, নিলয়টা এমন কেন। রাগে–ক্ষোভে ওর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। ঈদের ছুটিতে বাসায় গিয়েও নিলয়ের ফোন নম্বর ব্লক করে রাখলাম। দুজনের যোগাযোগ বন্ধ তখন।
এক সপ্তাহ পর
বাড়িতে থাকলে রাতে ছাদে যাওয়া হয়। সেদিন গিয়ে দেখি আকাশে থালার মতো চাঁদ উঠেছে। আমি বাসার ছাদে উঠলাম চাঁদের আলোয় ডুবতে। ছাদে রেলিং ধরে দাঁড়াতেই খেয়াল করলাম সামনের বাসায় আলোকসজ্জা। রঙিন আলো একবার জ্বলছে, একবার নিভেছে। আচমকা দেখি ভবনের হলুদ আলোকসজ্জার মাঝখানটায় সবুজ আলো জ্বলে ফুটে উঠল, ‘সরি’, এরপর তা নিভে লাল আলোতে ‘মিস উই’, এরপর ‘লাভ ইউ’।
কী হচ্ছে আমি বুঝতে পারলাম না। আমার পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠল, ‘অধরার হাতটা কি আমি সারা জীবন ধরে রাখতে পারি?’ বসন্তের বাতাস বয়ে গেল যেন চারপাশে। আমি এলোমেলো চুলে খেই হারিয়ে ফেলতেই নিলয় ধরে ফেলল আমাকে। তারপর একগাল হেসে বলল, ‘অধরা ধরা!’
আমি সেই ভুবন ভোলানো হাসিতে হারিয়ে গেলাম।
উত্তরা, ঢাকা